মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪ ।। ৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ৯ রমজান ১৪৪৫

শিরোনাম :

‘আনা আফছাহুল আরব’ ও বাংলা ভাষা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

bangla_vasaহাওলাদার জহিরুল ইসলাম

কোনো জাতি ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে পৃথীবিতে এমন দৃষ্টান্ত কেবল বাংলাদেশেই রয়েছে৷ বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্মরণীয় একটি দিন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি৷ এ দিনে ঢাকার রাজপথে 'মাতৃ ভাষা বাংলা চাই'-এর দাবি আদায় করতে গিয়ে জীবন দিতে হয়েছিলো রফিক, বরকত, আবদুল জব্বারসহ আরো অনেককেই৷ সে রক্তমাখা ইতিহাস কম বেশি সবারই জানা৷

মাতৃভাষা 'বাংলা'র জন্য জীবনে দেয়া সেই বীর শহীদদের আজ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি৷ সস্তা ফুলের তোড়া দিয়ে নয়, দোয়া-মোনাজাতের মাধ্যমেই হতে পারে শহীদদের প্রকৃত স্মরণ৷ মহামহিমের দরবারে প্রার্থনা আমাদের, সকল ভাষা শহীদদের তিনি ক্ষমা করে দিয়ে বেহেশতবাসী করুন! আমিন!

বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে ২১শের গুরুত্ব সবার মধ্যেই থাকা চাই৷ একটি উন্নত ভাষা একটি জাতি-গোষ্ঠীকে পৃথীবির দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সুযোগ করে দেয়৷

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা 'জেনারেল' 'মাদরাসা'-এই দুই ভাগে বিবক্ত হওয়ায় একটি পক্ষ তুলনামূলক মাতৃভাষার চর্চার সুযোগটা কমই পায়৷ অবশ্য এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষেরও কিছুটা দায়বোধের ব্যাপার রয়েছে৷

তবে মজার ব্যাপার হলো মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় বর্তমানে বাংলা ভাষার চর্চা-প্রশিক্ষণ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে৷ তবে চর্চাটা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তি পর্যায়ে রয়েছে৷ কোথাও কোথাও হয়তো কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা বা তত্ত্বাবধান করছে৷ যা অবশ্যই ইতিবাচক বিশেষত কওমিয়ানদের জন্য৷

এক সময় মাদরাসায় বাংলা ভাষাকে অচ্ছূত মনে করা হতো৷ বাংলা ভাষায় নূর (!) নেই বলে দূরে ঠেলে দেয়ার প্রবণতা ছিলো বেশ৷ কোনো কোনো অঞ্চলে এখনও সে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি বললেই চলে৷ তবে আশার কথা হলো সার্বিকভাবেই বর্তমান কওমিয়ানদের মাঝে মাতৃভাষার চর্চাটা বৃদ্ধি পেয়েছে৷ একজন বাঙালি হয়েও বাংলা ভাষা থেকে দূরে থাকা কতোটুকুই বা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে!?

মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বর্তমানে যারা বাংলা ভাষা-সাহিত্যে যথেষ্ট দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে চলছেন, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে তরুণ কবি-লেখকদের তত্ত্বাবধান করে যাচ্ছেন তাদের প্রায় সবাই ভাষা চর্চার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক আনুকুল্য পাননি৷ তারা নিজেদের চেষ্টা-সাধনায়ই এতো দূর এগিয়েছেন৷ আবু তাহের মেসবাহ, উবাইদুর রহমান খান নদবী, ইয়াহইয়া ইউসুফ নদবী, আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া, শরীফ মুহাম্মদ, মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন, কবি মুহিব খান, কবি মুসা আল হাফিজ, শাকের হুসাইন শিবলিসহ আরো অনেকেই৷ এঁদের সবাই মাতৃভাষা চর্চার জন্য বর্তমান সময়ের মতো উন্মুক্ত (কিছুটা হলেও) পরিবেশ পান নি৷ তবুও তারা এগিয়েছেন, এবং যথেষ্ট এগিয়েছেন৷ বাংলা ভাষার 'ঠিকাদার' দাবীদার অনেককেই তারা পেছনে ফেলেছেন৷ মাতৃভাষার সাহিত্য ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করণে জাতির এই সূর্যসন্তানেরা স্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন৷

মাদরাসায় ভাষা চর্চার বিষয়টি আরো ব্যাপক হওয়া সময়ের দাবি৷ মাতৃভাষার মসনদে বসে কথিত প্রগতিশীলতার দাবিদার কতিপয় বাঙালি, যুগের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মাথার ওপর ছড়ি ঘুরাবে তা তো হতে পারে না! আমরা কি ভুলে গেছি রাসুলে আরাবি সা. এর ঐতিহাসিক বাণী! তিনি মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, 'আনা আফছাহুল আরব'-আমিই আরবের মধ্যে সবচে' শুদ্ধভাষী ব্যক্তি৷' সে মহামানবের অনুসারী হিসেবে আমরা কি আজ ঘোষণা দিতে পারবো 'বাংলেদেশের মধ্যে আমরাই সবচে' শুদ্ধভাষী!? এমনটি ভাবতেও হয়তো আমাদের কষ্ট হবে৷ সার্বিকভাবে আমরা তো সে অবস্থানে নেই!

ইসলামে যে মাতৃভাষা চর্চার যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা নতুন করে বলবার কিছু নেই৷ দিবস হিসেবে নয় বরং ভাষার প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মাঝে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে৷ যেমন,

১৷ মাতৃভাষা চর্চা উপলক্ষে যে কোনো দিন শিক্ষামূলক একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা৷
২৷ বাংলা ভাষার চর্চা, গুরুত্ব-প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে ব্যাপক আকারে বক্তৃতা অনুষ্ঠান হতে পারে৷
৩৷ প্রবন্ধ-রচনা প্রতিযোগিতা করা যায়৷
৪৷ কয়েক মাদরাসা মিলে বাইরে(হল রুম ভাড়া নিয়ে) বড় ধরণের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা৷
৫৷ প্রতিযোগিতায় মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অংশ গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করলে ব্যাপক সাড়া পড়তে পারে৷
৬৷ বেফাক বা অন্যান্য বোর্ডগুলো নিজস্ব উদ্যোগে শিক্ষক-ছাত্রদের জন্য পৃথক পৃথক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারে৷
৭৷ প্রতিটি অনুষ্ঠানে সরকারি-বেসরকারি ভাষাবিদ, শিক্ষাবিদদের আমান্ত্রণ করে কওমিয়ানদের ভাষা চর্চার বিষয়টি আরো ব্যাপক ও উৎসাহব্যাঞ্জক করা যেতে পারে৷
৮৷ মাদরাসার শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে এককভাবে ক্যালিগ্রাফী/চিত্রকলা প্রদর্শনের আয়োজন হতে পারে৷
৯৷ যারা আগ থেকেই মাতৃভাষা চর্চায় অবদান রাখছেন তাদের জন্য সংবর্ধনা অনুষ্ঠান করা যেতে পারে৷ এতে নবীন প্রবীণ সবাই ব্যাপক উৎসাহ পাবে৷

এমন শত শত আয়োজন হতে পারে ভাষার মাসে, ২১শে ফেব্রুয়ারিতে৷ মনে রাখা প্রয়োজন ভাষা চর্চা থেকে দূরে থেকে প্রকৃত পক্ষে জাতির প্রতিনিধিত্ব করা যায় না৷

ইসলামের সব নবী-রসুল আ.-ই নিজ নিজ যুগের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক, ভাষাবিদ ছিলেন৷ তাঁদের থেকে স্পষ্টভাষী ওই যুগে আর কেউ ছিলো না৷

আজ বাম-রামরা মাতৃভাষার শাহি মসনদে বসে ইচ্ছেমতো আবোল তাবোল বই লিখে যাচ্ছে৷ ইসলাম, মুসলমানদের নামে নানা কুৎসা রটনা করে চলছে৷ আমাদেরকে এর প্রতিবাদ শুধু রাজপথে করলেই দায়িত্ব শেষ হবে না৷ এর সবচে' ভালো প্রতিবাদ তো শক্তিশালী লেখার মাধ্যমেই করা হতে পারে৷ আমাদের আকাবির আসলাফগণ তো তাই করেছিলেন৷ বাতিল যে রূপে আসবে সে রূপেই প্রতিবাদ-প্রতিকার হওয়া প্রয়োজন৷ অন্যথায় হিতে বিপরীত হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে৷

শেষ কথা হলো, বাংলা ভাষা আমাদের মায়ের ভাষা৷ আর মায়ের সম্মানের মতো মায়ের ভাষারও সম্মান করা আমাদের দায়িত্ব৷ বিড়ালের সাথে রাগ করে 'লোভনীয় ভাজা ইলিশ'টা ছেড়ে দেয়া তো বুদ্ধিমানের পরিচায়ক হতে পারে না৷ মাদরাসায় বিশেষত নবীনদের মাঝে মাতৃভাষা চর্চা জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এখন সময়ের দাবী৷ 'একুশ' শুধু 'ওদের' নয় সমভাবে আমাদেরও৷ আমরা যেনো প্রকৃত পক্ষেই একদিন বলতে পারে 'আজ একুশে ফেব্রুয়ারি৷' …

সেই দিনের অপেক্ষায়...৷

লেখক: শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত৷

rokon_book2


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ