মাওলানা মাহমুদুল হক। সমাজের জন্য দরদি এক আলেমে দীন। গ্রামে থাকেন। সেখান থেকেই আলো ছড়াচ্ছেন নানা প্রান্তে। জন্মগ্রহণ করেছেন চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার অজপাড়া গ্রাম নিচিন্তাপুরে। হাটহাজারী মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস শেষ করেন। ১৯৬৫ সালে এলাকায় বিপুল ভোটে মেম্বার নির্বাচিত হন। বর্তমানে বয়স আশি ছুঁই ছুঁই করলেও বার্ধক্য এখনো তার কর্মোদ্যোমে প্রভাব ফেলতে পারেনি। কাজী নজরুল ইসলাম ঠিক যেমন বলেছেন, তারুণ্যকে বয়সের ফ্রেমে বেঁধে রাখা যায় না।
মাওলানা মাহমুদুল হক তাদের একজন। মাদরাসায় পড়া অবস্থা থেকে সমাজ সেবা ও সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রেখেছেন অসমান্য অবদান। গঠন করেছেন আল মাহমুদ ফাউন্ডেশন। গরিব দু:খিদের অর্থায়নসহ কুরবানির ঈদে গোস্ত বিতরণ, শীতে কম্বল বিতরণসহ নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন হয়ে আসছে। ফাউন্ডেশনের অধীনেই একটি বালক বালিকা মাদরাসাও পরিচালিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন ও মুক্তি বাহিনীর সেবা করে দেশের জন্যও রেছেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর। তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে পাঠকের সামনে তুলে ধরার জন্য একান্ত সাক্ষাৎকারের মুখোমুখি হয়েছিল আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধি এম ওমর ফারুক আজাদ ও ফটিকছড়ি প্রতিনিধি কে এম নুরুদ্দীন।
আওয়ার ইসলাম: আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, কেমন আছেন?
মাওলানা মাহমুদুল হক: ওয়ালাইকুম সালাম ওয়ারাহ মাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ, আলহামদুলিল্লাহ। বয়সতো অনেক হয়েছে। শরীরের অবস্থা তেমন ভালো না। সম বয়সীদের মধ্যে অনেকে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। আল্লাহ এই বয়সে যতটুকুন সুস্থ রেখেছেন অনেক অনেক শুকরিয়া।
আওয়ার ইসলাম: আপনার এলাকা ও জনগণের অবস্থা কেমন?
মাওলানা মাহমুদুল হক: আলহামদুলিল্লাহ অন্য এলাকার তুলনায় আমাদের এলাকার অবস্থা অনেক ভালো, দ্বীনি পরিবেশ এখানে বর্তমান। যুব সমাজের মধ্যেও দ্বীনি প্রেরণা আছে এখনো।
আওয়ার ইসলাম: সমাজ সেবায় আপনি অসমান্য অবদান রেখেছেন। এর সূচনা কিভাবে ও প্রেরণা কোত্থেকে পেলেন?
মাওলানা মাহমুদুল হক: আসলে প্রেরণা কারো থেকে পাইনি। যা কিছু করেছি নিজের আত্মোপলব্ধি থেকে করেছি। আমাদের নিচিন্তাপুর একালাটি ছিলো সুবিধা বঞ্চিত, এখানের মানুষ ছিলো অসচ্ছল ও নিরক্ষর। সেই অনুভুতি থকে কৈশর থকে বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠায় আত্মপ্রয়াসী হই। ১৯৭৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মুরুব্বিদের পরামর্শে সদস্য প্রার্থী হলে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে এলাকার উন্নয়নে কাজ করেছি।
আওয়ার ইসলাম: আল মাহমুদ ফাউন্ডেশন গঠনের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাই।
মাওলানা মাহমুদুল হক: আল মাহমুদ ফাউন্ডেশন আগে এই নামে ছিলো না । ১৯৫৫ সালে এলাকার মুরুব্বীদের পরামর্শে পল্লী উন্নয়ন সমিতি নামে একটি সমিতি গঠন করা হয়। কিন্তু দুই বছর পর এই সমিতি স্থিমিত হয়ে পড়লে ১৯৬০ সালে যুবকদের উদ্যোগে আরেকটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। যার নাম ‘উত্তর নিচিন্তাপুর যুব কল্যাণ সমিতি’। সমিতির উদ্যোগে এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড যেমন অসচ্ছল পরিবারের মেয়েদের বিবাহে সাহায্য প্রদান, কালভার্ট নির্মাণ,স্কুল প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালানো হয়। ১৯৯১ সালে ভয়াল ঘুর্ণিঝড়ে গ্রামের অনেক বাড়িঘর লণ্ডভণ্ড হলে এলাকার ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে কাতার থেকে অনুদান এনে ১,০০,০০০ টাকার সাহায্য প্রদান করা হয়। এছাড়াও এলাকার মানুষের মধ্যে বিভেদ দূর করে ঐক্য প্রয়াসী বিভিন্ন ক্লাজ করে যায় ওই সমিতি। ১৯৯১ সালে কাতার থেকে দেশে আসলে মাওলানা আবু তাহের নদভীর নেতৃত্বে এলাকার ছাত্র ও আলেমদের নিয়ে ‘ওলামায়ে ইসলাম পরিষদ’ গঠন হয়। পরিষদের উদ্যোগে ছাত্রদের বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ সহায়তাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। কিন্তু দ্বীনী সংগঠনগুলোর উপর সরকারের চাপ সৃষ্টি হলে পরিষদের নাম বদলে আল মাহমুদ ফাউন্ডেশন করা হয়।
[caption id="" align="alignnone" width="819"] আয়েশা সিদ্দীকা রাঃ বালক-বালিকা মাদরাসা [/caption]
আওয়ার ইসলাম: আল মাহমুদ ফাউন্ডেশন এই পর্যন্ত কি কি কাজ করেছে?
মাওলানা মাহমুদুল হক: আল মাহমুদ ফাউন্ডেশন সমাজের উন্নয়নে অনেক কাজ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৯৬ সালে হজরত আয়েশা ছিদ্দীকা রা. বালক-বালিকা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ১৯৯৪ সালে থেকে প্রতি বছর দুস্থদের মাঝে ইফতার সামগ্রী বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ, ১৯৯৭ সাল হতে ঈদুল আজহার সময় গরীবদের মাঝে কুরবানীর গোস্ত বিতরণ, পানীয় জলের সু-ব্যবস্থা, মসজিদ নির্মাণ, এই পর্যন্ত ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ১৯টি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া সুদবিহীন কর্জে হাসানার পাশাপাশি নারীদের স্বাবলম্বী করতে সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণসহ সমাজ সেবায় আরো অনেক অবদান রেখে যাচ্ছে।
আওয়ার ইসলাম: আপনার সন্তান সন্তাদি সম্পর্কে জানতে চাই
মাওলানা মাহমুদুল হক: বৈবাহিক জীবনে আমি ৫ কন্যা সন্তান ও দুই ছেলের পিতা। ১৯৬৬ সালে আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধর্মপুর এমদাদুল উলুম মাদরাসার পার্শবর্তী গ্রাম থেকে বিয়ে করি। তৎকালীন মহিলা মাদরাসার ব্যবস্থা না থাকাতে প্রথম তিন জনকে বেশি লেখাপড়া করাতে পারিনি তবে ছোট দুই মেয়েকে আলিয়া মাদরাসায় পড়িয়েছি। তারা একজন আলিম ও অন্যজন ফাজিল পাশ। বড় ছেলে হাফেজ-আলেম আবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ। ছোট ছেলে শুধু হাফেজ হয়েছে। বড় ছেড়ে স্বপরিবারের কাতার সরকারি মসজিদে ইমামতি করে আর ছোট ছেলে কাতারে একটি কোম্পানিতে চাকরি করছে।
আওয়ার ইসলাম: আপনি তো সমাজ নিয়ে ভাবেন, আপনার দৃষ্টিতে সমাজ ব্যবস্থা এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে?
মাওলানা মাহমুদুল হক: সমাজের অবস্থা এখন খুব ভয়াবহ। চারিদিকে বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার ছড়াছড়ি। তার পরেও সমাজে যতটুকু দ্বীন আছে তা আলেম ওলামা ও ওয়াজ মাহফিলের বরকত। চারিদিকে এখন নাস্তিক্যবাদ মাথাছড়া দিয়ে উঠছে। এই অবস্থায় দ্বীন অনুযায়ী চলতে হলে আলেম-ওলামাদের সানিধ্য খুব প্রয়োজন।
আওয়ার ইসলাম: সমাজে কোন জিনিসটার অভাব বেশি দেখছেন?
মাওলানা মাহমুদুল হ: সমাজে যে জিনিসটার বেশি অভাব তা হচ্ছে নারীদের মধ্যে দ্বীনি বুঝ ও শিক্ষা। নারীদের শিক্ষিত করে তুলতে ও দ্বীনি বুঝ জাগ্রত করতে বেশি বেশি বালিকা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। নারী যদি ঠিক হয়ে যায় প্রতিটি পরিবার, এভাবে দেশ ঠিক হয়ে যাবে।
আওয়ার ইসলাম: জীবনে সুযোগ পেলে আর কী কী করার ইচ্ছা আছে?
মাওলানা মাহমুদুল হক: বাকি হায়াত যা আছে তারতো আর কোন বিশ্বাস নাই। কোন পরিকল্পনাও নাই। তবে মাদরাসা নিয়ে আছি ও মৃত্যু পর্যন্ত মাদরাসাটিকে আরো এগিয়ে নিতে কাজ করে যাবো ইনশাআল্লাহ।
আওয়ার ইসলাম: যুবকদের নিয়ে আপনার ফাউন্ডেশনের কোন পরিকিল্পনা আছে কি?
মাওলানা মাহমুদুল হক: জি আছে। ফাউন্ডেশনে যুবকদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ এলাকার যুব সমাজের মধ্যে দ্বীনি চেতনা যা আছে তা এই ফাউন্ডেশনের অবদান।
আওয়ার ইসলাম: মুক্তিযুদ্ধে আপনার ভুমিকা কী ছিলো?
মাওলানা মাহমুদুল হক: মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি তৎকালীন নেজামে ইসলাম পার্টির সদস্য ছিলাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন তখন স্থির করেছি ঘোষণা যখন এসেছে যে কোন পর্যায়ে আমাদের স্বাধীন হতে হবেই। না হয় পাকিস্তানি হানাদারেরা তাদের অত্যাচার আরো বেশিগুণ বাড়িয়ে দেবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা নিয়ে আমি যোদ্ধাদের সেবায় ব্রত ছিলাম। আমাদের এলাকার কমান্ডার ছিলেন মরহুম বদিউল আলম। তার নেতৃত্বে ৮১ জন মুক্তিযোদ্ধা আমাদের এলাকায় এলে আমি তাদের থাকার জন্য আমার কাচারিটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। তাছাড়া অস্ত্রের জোরে ভ্রান্ত কিছু মুক্তি বাহিনীর সদস্যদের থেকে এলাকার নারীরা যেন নিরাপদ থাকে সে উদ্যোগও গ্রহণ করি। নানুপুরের পাশে শান্তিরহাটে ছিলো মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্প। আমি বদিউল আলম কমান্ডারের অনুরোধে ক্যাম্পে প্রতিদিন শুকনো খাবার যেমন, চিড়া, চিনি, লবণ নিজ অর্থায়নে পাঠাতাম। আমাদের এলাকার অনেক ভ্রান্ত যুবক আল বদর ও মুজাহিদ বাহিনীতে যোগ দেয় । আমি তাদের স্বাধীনতার গুরুত্ব বুঝিয়ে মুক্তিবাহীনিতে যুক্ত করার কাজ করেও স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করার প্রতিদান আল্লাহ আমাকে দেখাচ্ছেন। ফটিকছড়ির মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে যথেষ্ট সমীহ করেন।
[caption id="" align="alignnone" width="960"] আল মাহমুদ ফাউন্ডেশনের ২৫ বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে হাফেজ আলেম ও গুণীজনদের সম্মাননা প্রদান করা হয়।[/caption]
আওয়ার ইসলাম: সমাজ সেবায় আলেম সমাজ পিছিয়ে আছে বলে মনে করা হয়, কারণ কী বলে মনে করেন?
মাওয়ালানা মাহমুদুল্লাহ: সমাজ সেবায় আলেম সমাজের পিছিয়ে থাকার একটা কারণ হলো পরমুখাপেক্ষিতা। আলেমরা যেদিন মানুষের মুখাপেক্ষি না হয়ে আল্লাহপর মুখাপেক্ষি হবে সেদিন সমাজে সত্য বলতে কাউকে ভয় করবে না। তাছাড়া আলেমরা হচ্ছে সমাজের নেতা কিন্তু সমাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আলেমরা গিয়ে পেছনের সারিতে বসে। এটা আলেম সমাজের হীনমন্নতার কারণে। হীনমন্নতা আমাদের দূর করতে হবে। নিজেকে আল্লাহর প্রতিনিধি ও জনগণের সেবক ভাবতে হবে।
আওয়ার ইসলাম: আপনার এই সাক্ষাৎকারটি আমাদের প্রায় ১ লাখ পাঠক পড়বেন যাদের মধ্যে অধিকাংশই আপনার অনুজ। তাদের উদ্দেশে কিছু বলুন?
মাওলানা মাহমুদুল হক: আমি মনে করি যারা এটি পড়বেন তারা অনেকে আমার চেয়ে বেশি বুঝেন। তবুও একটি কথা বলবো তা হলো আমরা যে যেই এলাকায় আছি যদি নিজ অবস্থান থেকে এলাকা ও দ্বীনের কিছু কাজ করতে পারি তাহলে পুরো দেশ পরিবর্তন হয়ে যাবে।
আওয়ার ইসলাম: আমাদের সময় দেয়ার জন্য অনেক অনেক শুকরিয়া, জাজাকুমুল্লাহু খাইরান।
মাওলানা মাহমুদুল হক: আপনাদেরও জাজাকুমুল্লাহ। আওয়ার ইসলাম তার লক্ষ্যপাণে এগিয়ে যাক এই শুভ কামনা থাকবে।
আরআর