মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে
সালাতুজ্জোহর শেষ, অমনিই আমাদের হুড়োহুড়ি দৌড়োদৌড়ি৷ খাবারদাবার ফেলে একবুক আবেগভরা আশায় কামরা ত্যাগ৷ মসজিদে রশিদের নিচতলায় দরসগাহে উপস্থিতি৷ হজরতের অপেক্ষা৷ এই আসছেন, এইতো এলেন; অধীর আগ্রহে বসে থাকা৷
হজরতের ঘর মসজিদে ছাত্তার ওপরে৷ জোহরের আগ থেকেই তৈরি থাকতেন দর্সের জন্য৷ তর্জুমান-নির্ধারিত শিক্ষার্থীবন্ধু যেতেন বাসায়৷ হজরতকে সব কাজ থেকে অবসর করে ধীরে ধীরে ওপরতলা থেকে নিচে নামাতেন৷
বহুদিন পিছু হেঁটেছি হজরতের হুইল চেয়ারের৷ জিকির করতেন৷ পথ এগোতেন৷ সঙ্গীবন্ধুরা নিজেকে ধন্য মনে করতেন৷ অধমেরও নেয়ামত মনে করা হতো৷ কেননা হজরত তো ছিলেন ‘মুস্তাজাবুদ্দাওয়াহ' তথা প্রার্থনা কবুল করা হয় যার৷
সুযোগে, সময়ে-অসময়ে মোলাকাতে দোয়া চাইতাম৷ ভাবতাম, একটিবার যদি তার পরশে ধন্য হয়ে যায় জীবনটা! আমার মতোন এমন আশায় বুক বাঁধতেন কতো লাখো তলাবা, আসাতিযায়ে কেরাম; হিসেব নেই তার৷
একসময় তাশরিফ নিতেন হজরত৷ মাউথ মাইক দেয়া হতো সামনে৷ আরম্ভ করতেন দরস। সামনে বসে থাকা কানগুলি ভরে যেতো দরসুল হাদিসে৷ হাদিসগুলি তাও আবার বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ বুখারি শরিফের৷ হজরত পড়াতেন ‘কিতাবুল মাগাজি' তথা ইসলামের জিহাদ অধ্যায়৷
পড়াতে পড়াতে কখনও কাঁশতেন, কখনও বলতেন বেশ দরকারি কথা৷ কখনো বা সবার অনুরোধে করতেন মকবুল মোনাজাত৷ দেওবন্দ কেবল নয়, সারা দুনিয়ার সবার ধারণা, দারুল উলুম দেওবন্দে আজ অবধি হজরতের কারণেই আকাবিরের রুহানিয়্যাত বহাল ছিলো৷ অথচ তিনি আজ চলে গেলেন৷
দীর্ঘদিন ধরে ছিলেন অসুস্থ৷ এই ভালো, এই খারাপ কাটছিলো তার শেষ অধ্যায়গুলি৷ শেষ ক'দিন এলেন না দরসে। আমরা হয়রান, না জানি কী হতে কী হয়ে বসে! আজ ঠিক তাই-ই হয়ে বসলো!?
তিনদিন হলো ষাণ্মাসিক পরীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে৷ আগামীকালই দরস আরম্ভ হবার কথা ছিলো৷ হয়তো বা আরম্ভও হবে দরসগুলি৷ কিন্তু জোহর বাদ তো আর হজরতের আলোচনা শুনতে পাবে না আমাদের কান৷
মাগরিব বাদ সংবাদটি এলো দেওবন্দের ডিকে জৈন হাসপাতাল থেকে৷ সঙ্গে সঙ্গে বেদনায় লাল হয়ে গেলো চোখদুটো৷ চেহারায় অস্থিরতার ছাপ৷ কী করবো, কাকে কী বলবো, ভেবে পাচ্ছি না৷
এলাম নবীজি সা.-এর নির্মাণরেখার ঐতিহাসিক নওদারায়৷ বন্ধুদের প্রচণ্ড ভিড় নজরে পড়লো৷ দপ্তরের এক হজরত জানতে চাইলেন, ‘জানাজার সময় নির্ধারিত হয়েছে কী?' পাথরমানব বনে দাঁড়িয়ে রইলাম মুলসুরি বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে৷
লাশ আসবে, অপেক্ষায় সবাই৷ পায়ে হেঁটে এগোলাম সদরগেট বাবে কাসিমে৷ দেখলাম উপচেপড়া ভিড় সবার৷ হজরত মুহতামিম সাহেব মুফতি আবুল কাসেম নোমানি বানারসি দামাত বারাকাতুহুমকে দেখলাম মেহমানখানার সামনে দাঁড়িয়ে৷ তার চেহারায় বেশ পেরেশানির ছাপ৷ তাকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ ভিড় পেরিয়ে হজরত এগোলেন নওদারার দিকে৷ পিছু নিলো ছাত্রবন্ধুরা৷
আমরা ক'জন এগোলাম মসজিদে ছাত্তায় হজরতের বাসার দিকে৷ শুনলাম, লাশ এসে পৌঁছোয়নি এখন অবধি৷ ততোক্ষণে বিশাল এক জমায়েত আমাদের নজর কাড়লো৷ যার মধ্যমনি আমাদের উস্তাযে মুহতারাম বাহরুল উলুম আল্লামা নেয়ামতুল্লাহ আজমি দামাত বারাকাতুহুম৷ হজরত এগিয়ে আসছেন দারুল উলুমের সদরগেটের দিকে৷ ধীরে ধীরে পৌঁছুলেন নওদারায়৷ হজরত মুহতামিম সাহেব হুজুরের পাশে বসলেন৷ কিছু একটা পরামর্শ করছিলেন তারা৷ শোনা গেলো না তেমন একটা৷
আমরা হজরতদের ঘিরে দাঁড়িয়ে৷ এহাতায়ে মুলসুরি ততোক্ষণে ভরে গেছে একেবারেই৷ বন্ধুদের অনেকেই দেশবিদেশে ফোন করে খবর দিচ্ছে৷ ফেসবুক, টুইটর, ইমো, ওয়াটসঅ্যাপে ইন্তিকালের সংবাদ লিখে পোস্ট করছে৷
আমি আবার বাইরে যেতে লাগলাম৷ ঠিক মেহমানখানার পেছনে লাশ গোসলের জায়গাটিতে হাজির হলাম৷ দু-চার মিনিট দেওবন্দ নগরীর ক'জন লোকের সঙ্গে দুঃখগুলি ভাগাভাগি করলাম৷ ততোক্ষণে একটি লাশের শূন্য খাট এগিয়ে এলো এদিকটায়৷ চোখ থেকে অশ্রু আমার ঝরতে লাগলো৷ এইতো হজরতের শেষ খাট৷ আর কোনোদিন ঘুমোতে পারবেন না তিনি এই পার্থিব বিছানায়৷ ভাবতেই গা শিউরে ওঠছে আমার৷ হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে এখনই৷
দেওবন্দে আসার আগে বুঝিনি, হজরত কিয়া চিজ হ্যায়? এখন টের পাচ্ছি প্রতিটা পদে পদে৷ যখন আল মারকাজুল ইসলামিতে পড়তাম, আমাদের একজন উস্তাদ খুব বলতেন হজরতের কথা৷ দেওবন্দ এলে তার সান্নিধ্যে থাকবার নির্দেশ দিতেন৷ এখন খুব মনে পড়ছে সেই কথাগুলি৷ আফসোস হচ্ছে, আহ যদি আর ক'টা দিন থাকতেন হজরত!
বড্ডো রসিক ছিলেন তিনি। ছাত্রদের সঙ্গে তার আচরণ ছিলো দাদুভাইয়ের মতোন৷ ব্যবহার ছিলো একেবারেই অকৃত্রিম৷ কথা বলতেন মৃদুস্বরে৷ আমাদের অন্যতম একজন মুরব্বি ছিলেন৷ শায়খুল আরব ওয়াল আজম আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানি রহ.-এর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি ছিলেন৷ ছিলেন তার অন্যতম শাগরিদও৷ খলিফা ছিলেন হজরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক হারদুঈ রহ.-এর৷
১৯৩৬ ইংরেজিতে ভারতের উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি৷ পড়াশোনা শেষ করেন ১৩৭৪ হিজরিতে৷ ১৪০৩ হিজরিতে হজরত দারুল উলুম দেওবন্দের খেদমতে নিয়োজিত হন৷ দীর্ঘ ৩৫ বছরে গড়েছেন বহু ছাত্র৷ যারা আজ পৃথিবীর আনাচে কানাচে স্বাক্ষর রাখছেন নিজ প্রতিভার৷
হজরতের লাশ এসেছে কেবল৷ তাকে রাখা হলো লাশের খাটে৷ লাইন ধরে এগিয়ে আসছে আলেম-তলাবা৷ শেষবারের মতো এক পলক দেখবার জন্য ঠেলাঠেলি করছে সবাই৷ একে একে বিদেয় দিচ্ছে আমাদের প্রিয় শাইখকে৷
চোখের জল গড়াতে গড়াতে চড়ছি নওদারার ওপরে৷ দেখছি হজরতের লাশটি৷ কী নীরবভাবে শুয়ে রয়েছেন তিনি! যেনো কোনো চিন্তাই নেই চোখেমুখে৷ একদম নিষ্পাপ৷ যেনো শান্তির ঘুম ঘুমোচ্ছেন মহামহিমের আদুরে কোলে৷
হজরতের ইন্তিকালে শোকের ছায়া নেমেছে সারা পৃথিবীর ধর্মীয় অঙ্গনে৷ দেশবিদেশ থেকে অগণিত আলেম-উলামা আসতে শুরু করেছেন দারুল উলুম দেওবন্দে৷
বয়সটা আর কতো বা-ই হলো তার! বাহরুল উলুম সাহেব তো বয়সে হজরতের এক বছরেরও বড়৷ অথচ বাহরুল উলুম সাহেব এখনও দিব্যি পায়ে হেঁটে চলেন দেওবন্দের বরকতময় পথপ্রান্তরে৷ কিন্তু হজরতের এই অসুস্থতায়ই হজরত সময় পেলেন না আর৷
আমাদের এ যুগের ‘ইবনে হাজার' হজরত মাওলানা হাবিবুর রহমান আজমি দামাত বারাকাতুহুম বললেন, ‘উন কে হার্ট কে আন্দার বহুত বড়ি দিক্কত থি৷' তাই বলে এভাবেই আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন তিনি?
হজরতের বিশেষ খাদেম আমাদের দরসবন্ধু চিল্লাতে আরম্ভ করেছে৷ কেঁদে কেঁদে বলছে, ‘কেনো হজরতকে দিল্লি কিংবা সাহারানপুরে নিয়ে গেলাম না৷ দোষ আমারই৷ আমিই হজরতের খেয়ালই রাখতে পারিনি৷'
আমাদেরও নিজেদের খুব দোষী মনে হচ্ছে৷ সত্যিই তো আমরাও তেমন খোঁজ রাখতে পারিনি হজরতের৷ তাই বলে এভাবেই তার চলে যাওয়া হবে আমাদের এতিম করে!
মাত্র এলান হলো হজরতের জানাজার৷ আগামীকাল বাদ জোহর অনুষ্ঠিত হবে এহাতায়ে মুলসুরিতে৷ ভারতীয় সময় দুপুর দেড়টা নাগাদ৷ সমাহিত করা হবে কাসেমি কবরস্তানে৷
কানে বাজছে সেই প্রিয় কণ্ঠটি এখনও৷ সেই পথচলা চোখের তারায় হাজির হচ্ছে সহসাই৷ হজরতের ছায়া এতো জলদিই উঠে যাবে? ভাবিনি৷ নির্বিকার দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা এহাতায়ে মুলসুরিতে৷ পাহাড়সম আফসোসে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমাদের ভেতরটা৷ আহ, যদি আরেকটু মন দিতাম হজরতের বয়ান, দর্সে!
লেখক: শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত
আরো পড়ুন : দেওবন্দের আল্লামা আজমী’র ইন্তেকাল
আল্লামা আজমি রহ. এর জানাযা শনিবার বাদ জোহর