শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


থার্টিফাস্ট নাইট উদ্যাপন দেশীয় সংস্কৃতি দেউলিয়া ঘোষণার নামান্তর

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি মুহাম্মাদ রাশিদুল হক
শিক্ষক ও কলামিস্ট

rashidul_haque‘সারা দেশে থার্টি ফার্স্ট নাইটে সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে নাচ-গান, জমায়েত, আতশবাজি বা উৎসব করা যাবে না। গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ওই রাতে আনন্দ বা উৎসব না করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’ দৈনিক প্রথম আলো ডিসেম্বর ২৯, ২০১৫

‘আগামী ৩১ ডিসেম্বর থার্টি ফার্স্ট নাইটে দেশের সব মদের বার বন্ধ থাকবে- বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। এছাড়া ‘থার্টি ফাস্টের দিন সন্ধ্যা ৬টার পর কোনও উন্মুক্ত স্থানে অনুষ্ঠান করা যাবে না। যদি কেউ ইনডোরে কোনও অনুষ্ঠান করতে চান, তাহলে আগে থেকেই পুলিশকে জানাতে হবে। কোনও আতশবাজিও ছোড়া যাবে না।’ থার্টি ফার্স্ট নাইটে কোনো ধরনের নাশকতার আশঙ্কা থেকে সরকার এসব ব্যবস্থা নিচ্ছে কি না- জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের এ ধরনের কোনো তথ্য নেই, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আমরা এই পদক্ষেপগুলো নিয়েছি।’ দৈনিক ইত্তিফাক ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়কে অভিনন্দন। সময়ের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণে জনগণ তাদের প্রতি সত্যিই কৃতজ্ঞ। তাদের বক্তব্যে জনগণের জন্য সতর্কবার্তা রয়েছে। থার্টিফাস্ট নাইট উদ্যাপন দেশ, জনগণ বিশেষ করে যুবসমাজের জন্য এতটাই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে যে, নাশকতার অগ্রিম কোনো তথ্য না থাকা স্বত্তেও ওই রাতের জন্য সঙ্কিত থাকতে হয় দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের। তটস্থ থাকতে হয় আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের। উদ্বিগ্ন থাকতে হয় আপামর জনসাধরণের এবং বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের অভিভাবকবৃন্দকে।

থার্টিফাস্ট নাইট উদ্যাপনকে কেন্দ্র করে দেশের যুবসামাজ নৈতিক অবক্ষয় তলানিতে গিয়ে ঠেকে। ওই রাতটিকে কেন্দ্র করে দেশের কর্তামহলের সতর্কতা ও তৎপরতা আমাদের এই ম্যাসেজই দিয়ে যায়। দিন দিন এই রোগ মহামারির আকার ধারণ করতে চলেছে। নিকটবর্তী অতীতে এই অপসংস্কৃতিটি ঢাকা নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় সীমাব্ধ থাকলেও বর্তমানে তা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের স্বকীয় সংস্কৃতি বিলুপ্তির পথে পা বাড়াবে। আমরা সংস্কৃতিক দেউলিয়াত্বে শিকার হব। তাই প্রয়োজন গণ সচেতনার। দেশীয় ও ধর্মীয় সাংস্কৃতির ভালোবাসা নিজেদের মধ্যে জাগরুক করে তোলা।

সচেতন মানুষ অতীতের নির্যাস থেকে উপাদান গ্রহণ করে সুন্দর ভবিষ্যত গড়ার প্রয়াস পায়। দিনের শেষে একজন আদর্শ ব্যবসায়ী সারা দিনের হিসেব নিকেষ মিলিয়ে নেয়ার কাজে ব্যস্ত থাকে। হিসেব মেলার আগে তার অন্য কাজের ফুরসত কোথায়, এমন কি এর আগে খাবারও সুযোগটুকুও হয় না তার। ঠিক তেমনি বছর শেষে গেল বছরের ডেবিট-ক্রেডিট মেলাতে ব্যস্ত হয় একজন সফল বণিক। লাভ হলে সামনে এগোনোর স্বপ্ন দেখে আর লোকসান হলে পুষিয়ে নেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টায় ব্রত হয়। ঠিক তেমনিভাবে একজন মুমিনও প্রতিদিন ঘুমানোর আগে তার সারা দিনের আমালের হিসেব করবে এটাই স্বাভাবিক। আর বছর শেষে গোটা বছরের দ্বীনী উন্নতির অগ্রগতির হিসেব কষবে। বিজতীয় অপসংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে দেয়ার ফুরসত তার কোথায়।

আমি প্রথমে মুসলমান তারপর বাঙলি বা বাংলাদেশি। আমাদের নিজেস্ব সংস্কৃতি আছে। আছে ধর্মীয় অনুশাসন। আমার যাবতীয় কর্মকাণ্ডে হতে হবে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে। তাই শুধু ধর্মীয় নয়, দেশীয় সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও একজন বাংলাদেশি থার্টি ফাষ্ট নাইট উদযাপন করতে পারে না। এটি যেমন মুসলমানদের কোনো উৎসব নয়, ঠিক তেমনি তা কোনো বাঙালি সংস্কৃতির আওতায়ও পড়ে না। আমরা পরগাছা বা কোনো শেকড়হীন জাতি নই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটাই বাস্তব সত্য যে, স্বকিয়তা ও স্বাতন্ত্রবোধ দিনে দিনে আমাদের থেকে বিদায় নিতে বসেছে। মানুষ অনুকরণপ্রিয়। তবে আমাদের দেশের মানুষ মনে হয় এ বিষয়ে একটু বেশিই অগ্রসর। ইতিহাসের দিকে চোখ বুলালেই এই নব্য সভ্যতা (!) স্বরুপ আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হবে।

মুমিনকে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতের কল্যাণ কামনা করতে হেদায়েত প্রদান করা হয়েছে। তাই শুধু আখেরাত নয়, দুনিয়াতের এর চলমান ও সম্ভাব্য ক্ষতির দিকগুলো আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। তৈরি করতে গণসচেতনতা।

ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালে জুলিয়াস সিজার সর্বপ্রথম ইংরেজি নববর্ষ উৎসবের প্রচলন করে। প্রাচীন পারস্যের পরাক্রমশালী সম্রাট জমশিদ খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ সালে নওরোজের প্রবর্তন করেছিল। এ ধারাবাহিকতায় পারস্যে তথা ইরানে ঐতিহ্যগতভাবে নববর্ষের জাতীয় উৎসব পালিত হয়। ইরান থেকেই এটি সাধারণ সাংস্কৃতির সূত্র ধরে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশ ও ভারত উপমহাদেশে প্রবেশ করে।

মেসোপটেমিয়ায় এই নববর্ষ শুরু হতো নতুন চাঁদের সঙ্গে মিল রেখে। ব্যাবিলনিয়ায় নববর্ষ শুরু হতো ২০ মার্চ। অ্যাসিরিয়ায় শুরু হতো ২১ সেপ্টেম্বর। মিসর, ফিনিসিয়া ও পারসিকদের নতুন বছরও শুরু হতো ২১ সেপ্টেম্বর। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত গ্রীকদের নববর্ষ শুরু হতো ২১ ডিসেম্বর। রোমান প্রজাতন্ত্রের পঞ্জিকা অনুযয়ী নববর্ষ শুরু হতো ১ মার্চ। মধ্য ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে নববর্ষ শুরু হত ২৫ মার্চ। তারা ধারনা করতো, এদিন দেবদূত গ্যারিয়েল যিশুমাতা মেরির কাছে যিশু খ্রিস্টের জন্মবার্তা জ্ঞাপন করে। অ্যাংলো-স্যাকসনে ইংল্যাণ্ডে নববর্ষের দিন ছিল ২৫ ডিসেম্বর। পহেলা জানুয়ারি পাকাপোক্তভাবে নববর্ষ উদযাপনের দিন হিসাবে নির্ধারিত হয় ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের পর। ধীরে ধীরে ইউরোপসহ সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রেগিরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ পালন করা শুরু হয়েছে।

আকাশ সংস্কৃতির কল্যাণে (!) ভেসে আসা থার্টি ফাস্ট নাইট মুসলমানদের পালন করার মতো কোনো উৎসব নয়। এই উৎসব পালনের সাথে মুসলমানদের কোনো ঐতিহাসিক সূত্র নেই। এটি আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির সাথেও যায় না। দূরতম সম্পর্কও নেই এর সাথে আমাদের দেশীয় কৃষ্টির। এটি একটি বিজাতীয়-বিধর্মী উৎসব এটি। প্রতি নিয়ত যে জাতি আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত করেছে রাজপথ তাদের অনুস্মরণ করতে আমরা মাড়িয়ে চলেছি আপন ভাইয়ের রক্তের দাগ। উপহাস করছি আপন ভাইয়ের পবিত্র খুনে রাঙা জমিন নিয়ে।

সভ্যতা-সংস্কৃতি ও উৎসবের নামে চলা এই অপসংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের সমাজকে অক্টোপাসের মত গ্রাস করেছে প্রায়। এটিকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশের যুবসমাজের উচ্ছন্নে যাওয়া অংশকে নিয়ে শুধু তাদের পরিবার পরিজন ও এলাকাবাসীও উদ্বিগ্ন নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও রীতিমত হয়রান।

ইসলাম আল্লাহ তাআলার কাছে একমাত্র মনোনিত ধর্ম। তাঁর অশেষ মেহেরবনীতে জন্মগতভাবে আমরা মুসলমান। আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত। অতীতের সকল আসমানী ধর্মীয় গ্রন্থাবলীর সারনির্যাস পবিত্র কুরআন আমাদের ধর্মগ্রন্থ। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হদীসের বিশাল ভান্ডার আমাদের হাতের নাগালে। পৃথিবীর বুকে একমাত্র পরিপূর্ণ দ্বীনের অনুসারী আমরা। আমাদের রয়েছে বিজয়গাথা সোনালী অতীত। রয়েছে সতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং পূঙ্গার্ণ একটি জীবন ব্যবস্থা। আমাদের অনেক কিছু দেবার মত রয়েছে। সভ্যতার নামে পূঁতিগন্ধময় অসভ্য সব আচার অনুষ্ঠান নিজের করে নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই আমাদের।

ভুলে গেলে চলবে না দুনিয়াই শেষ নয়, মৃত্যুর পরে রয়েছে অনন্তকালের এক জীবন। এখানে যেমন আমি ভালো থাকতে চাই ওখানেও ভালো থাকার ব্যবস্থা আমাকে এখান থেকেই নিতে হবে। সঙ্গ নিতে হবে তাদের যারা দুনিয়া ওপর আখেরাতকে প্রাধান্য দেন। তাহলে আমি অন্তত তাদের সাথে হাশরের ময়দানে উঠতে পারবো। কারণ প্রিয় ব্যক্তির সাথেই মানুষের হাশর হবে। যে যার অনুকরণ করে সে তারই অন্তরভূক্ত বলে গণ্য হয়। তাই একটু চিন্তাশক্তি প্রয়োগ করে নিজেকে ভালোভাবে চেনা এবং করণীয় ও বর্জনীয় নির্ণয় করা এখন সময়ের দাবি। তাহলেই হয়তো বিবেকের দংশনে আমাদের বোধোয় ঘটবে। নিজেদের তাহজীব-তামদ্দুন, কৃষ্টি-কালচার ও সুস্থ সংস্কৃতি নিয়ে আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো। ওপার জগতে পাব অপার শান্তি এক অভাবনীয় জীবন।

শুধু নিজে নয়, এ ভয়াল অপসংস্কৃতির সমূহ ক্ষতি সম্পর্কে জানাতে হবে। এর দ্বারা সামাজিক অবক্ষয়ের দিকগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে। মুমিনকে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতের কল্যাণ কামনা করতে হেদায়েত প্রদান করা হয়েছে। তাই শুধু আখেরাত নয়, দুনিয়াতের এর চলমান ও সম্ভাব্য ক্ষতির দিকগুলো আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। তৈরি করতে গণসচেতনতা। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকবৃন্দ এ বিষয়ে স্বতন্ত্র আলোচনা রাখতে পারেন।

খতীবসাহেবগণ সমসাময়ীক বিষয় হিসেবে এ বিষয়টি নিয়ে জুমার খুতবায় বায়ান করার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও সমাজ উপকৃত হবে। এ ছাড়া সামাজিকভাবে যারা যে পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করছেন তারা নিজেদের অধিনস্তদেরকে সচেতন করতে পারেন। সামাজিক সংগঘঠনগুলো সেমিনার ও আলোচনা সভার আয়োজনের মাধ্যমে এর লাভ-ক্ষতি সমাজের সামনে তুলে ধরতে পারে। প্রিন্ট ও ইলেট্রনিক্স মিডিয়াসহ সকলপ্রকার প্রচারমাধ্যমগুলো গণসচেতনতা তৈরীর কাজে আসতে পারে। সর্বপরি দুআ ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা যাবতীয় অপসংস্কৃতি রোধে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সকল প্রকার ফেতনা ফসাদ থেকে মুক্ত রাখুন।

লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস, নরাইবাগ ইসলামিয়া মাদরাসা, ডেমরা, ঢাকা
পেশ ইমাম, ডেমরা জামে মসজিদ, ঢাকা।
m.rhaque@yahoo.com


সম্পর্কিত খবর