শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


কয়েকটি দ্বিধা এবং একটি সুরাহা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ

munshi_ubaidullah‘সংসারের হাল ধরো৷ পড়াশোনার আর দরকার নেই৷' বাড়ি থেকে জোর তাগিদ আসে৷ তরুণের মনটা ভেঙে যায়৷ পড়াশোনায় আর তার মন বসে না৷ মাথায় ঢোকে না কিতাবের হাশিয়া, বাইনাসসতর৷ সংসার পরিচালনার চিন্তায় বিভোর হয় সারাক্ষণ৷ পথপন্থা খুঁজে বের করবার প্রয়সী হয় বহু৷ কিন্তু কোন পথে যাবে! পায় না কোনো দিশা৷

মাদরাসায় পড়ালে বেতন কম৷ সংসার চালানো মুশকিল৷ বিয়ে করা হবে না৷ ঋণ করে বিয়ে করলেও বউ নারাজ থাকবে৷ আলতা, স্নো-লিপস্টিক কেনার পয়সা হবে না৷ বাসায় গেলে মুখ ভার করে বসে থাকবে নববধূ৷ পেটে দানাপানি পড়বে না৷ নানান টেনশন৷ নাহ, মাদরাসায় পড়ানো বাদ৷

মাথা চুলকোয় তরুণ৷ বালিশের উল্টো পিঠে মাথা রাখে৷ ভাবে কী করা যায়! মাথায় কিচ্ছুটি খেলে না কোনোমতেই তার৷ ভাবতে ভাবতে ভাবনার রাজ্য, অতঃপর ঘুমের দেশে বেড়াতে যায় সে৷ স্বপ্নভঙ্গের একটি রাত পেরোয়৷ আরম্ভ হয় আরেকটি দিন স্বপ্নদেখার৷

চায়ের কাপে চুমুক মারে তরুণ৷ হঠাৎ মাথায় খেলে একটা বুদ্ধি৷ হু, ব্যবসা করা যেতে পারে৷ ওপরে ওঠতে ব্যবসাই আমার জন্য পারফেক্ট সিঁড়ি৷ কাড়ি কাড়ি টাকা কামানো যাবে৷ মাথা উঁচু করে সমাজে বাঁচা যাবে৷ গাড়ি-বাড়ি হবে৷ মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিখেরির মতো হাত পাততে হবে না৷ ‘মুষ্টি চাল দিন, কোরবানির চামড়া দিন৷' বলতে হবে না৷ জাকাত-ফিতরার আশায় আশায় থেকে দিনরাত এক করতে হবে না৷ সমাজের অর্থশালীদের কটু কথা শুনতে হবে না৷ আরও কতো কি!

ব্যবসার জন্য চাই পুঁজি৷ কিন্তু তরুণের তো কোনো সম্বলই নেই৷ কোত্থেকে মিলবে এতো টাকা? সবেই তো সে এতিমখানা থেকে ‘মৌলবি' হয়ে বেরিয়েছে৷ মামু-খালুর হাতেপায়ে পড়ে৷ দাওয়াত করে৷ বিশাল ভোজের আয়োজন করে তাদের তুষ্টি হাসিলের জন্য৷ পেটপুরে খাওয়ায়৷ কিন্তু যখন সত্যটা উপলব্ধি করেন তারা, অমনিই চুপ্টি মেরে বসে থাকেন৷

টাকার কথা বললে অন্য প্রসঙ্গ তোলেন৷ ‘টাকা ছাড়া পৃথিবীর সব বিষয়ে কথা বলো৷ শুনতে তৈরি৷' ভাবখানা এমন দেখান৷ চারটে পেটে পড়েছে যে, কিছু একটা তো শুনতে হয়৷ তাই শুনবেন বলে যতোটুকুন শোনার ভান করেন৷

বেচারা তরুণ চোখে ঝাপসা দেখে৷ তার বড় হবার স্বপ্নপ্রদীপ ধীরে ধীরে নিভে যেতে চায়৷ এতো পয়সা খরচ করলো, লাভটা কি হলো? হীতে বিপরীত যেনো৷ স্বপ্নভঙ্গের দ্বিতীয় রাত পেরোয় নির্ঘুম কিংবা দ্বিধাসংশয়ে আগামীর চিন্তা-ভাবনায়৷

ফজরের আজান হয়৷ আলসেমি ভেঙে জাগে তরুণ৷ মুখ ভার কাজকম্মে আজকাল তার৷ বাড়িতে এলেই বিনা বেতনে ইমামতি করে গাঁয়ের মসজিদে৷ কিন্তু কণ্ঠস্বর বদলে যায় আজ৷ সালাম ফেরাবার পর ভার ভার বোধহয় খানিকটা৷ ভারী মিষ্টি কণ্ঠ ছেলেটির৷ তাই ফজরে ইমামতি করতে বলা হয়৷ অথচ কণ্ঠের সেই পুরোনো তেজ নেই আজ, মনে হয় মুসল্লিদের৷ সবসময় সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলে, কিন্তু কারোর প্রতি মুখ তুলেও তাকাচ্ছে না এখন৷ মাথা নিচু করে কী যেনো ভাবছে৷ সংক্ষিপ্ত মোনাজাত শেষ করে বাইরে বেরোবার প্রস্তুতি নেয়৷ অমনিই কে যেনো হাত রাখে তার কাঁধে৷ ঘাড় বাঁকিয়ে দেখে তরুণ৷ গাঁয়ের মোড়লের মুচকি হাসি নজরে পড়ে তার৷

‘কী? কিছু বলবেন, চাচা?'
‘হ, সেইরহমই তো ইচ্ছা৷'

দুজনেই ভেতরে গিয়ে বসে মসজিদের৷ ‘তোমার ব্যাপারে সব শুনলাম৷ টাকার জন্য এদিক-ওদিক হাত পাততেছো৷ পাইতেছো না৷ তবে আমি কই কি, তুমি গেরামের জমি জমার ব্যবসা করতে পারো৷ জমি জমার ব্যবসা যারা করে, তাগোরে সবাই অবিশ্বাস করে৷ দালাল কয়৷ কারণ ওরা তো ভালো মানুষ না, ছলচাতুরি করে৷ কিন্তু তুমি তো হুজুর মানুষ৷ তোমারে সবাই বিশ্বাস করবো৷ দালাল কইবো না৷ যহন খরিদ্দার জানতে পারবো, অমুক মওলানা সাব এই জমির ক্রয়বিক্রয়ে জড়িত, তহন তারা আগ্রহ কইরা আসবো৷ আস্থা রাখবো তোমার প্রতি৷ দুই তরফ থেইকাই লাভ পাইবা…৷'

টানা ঘণ্টা দুয়েক অর্থ কামাইয়ের সস্তা বয়ান ঝাড়ে মোড়ল৷ তরুণ তার আলোচনায় সায় দেয়৷ মোড়ল হজ, ওমরা, ট্রাভেল্সের বিষয়েও জানায়৷ বেচারা তরুণের ভালোলাগে তার সব কথা৷ চাঙা দিয়ে ওঠে সে৷ এইতো জীবনের ঘুরে দাঁড়াবার সময় এলো বুঝি, মনে মনে ভাবে৷ সিদ্ধান্ত নেয় হজ, ভুমিব্যবসা করে স্বাবলম্বী হবার৷ কিন্তু শেষাবধি কি সে খুঁজে পায় কোনো পথ সাফল্যের? জানা নেই৷ কারোর হয়তো বা জানা থাকতে পারে৷

এমনকরে কতো তরুণ স্বপ্ন দেখে রোজ৷ স্বপ্নভাঙার ব্যথায় কতোজন বা হারিয়ে যায় কালের অতলে৷ হারাম কিংবা অন্য পন্থা খোঁজে কেউ বা আবার৷ সফলতার মুখ ক'জনই বা দেখে?

কেবল তরুণই নয়, এমন স্বপ্ন দেখে সমাজের কতো কতো শ্রেণির মানুষ! কতোজনের কতো কর্ম ভাগ্যে জোটে৷ দ্বিধাসংশয়ের হাজারো দরোজা খোলে৷ কোনটা করবে কোনটা ছাড়বে, সিদ্ধান্তহীনতার দোলাচলে ভোগে৷

দুই.
গেলো বারের কথা৷ ইফতায় দর্স হচ্ছে আমাদের৷ টেবিলে ‘আল আশবাহ ওয়ান নাজায়ের' কিতাব৷ প্রথমখণ্ডের ১৪১ নম্বর পৃষ্ঠায় চলছে সবক৷ যেটি কিতাবের দ্বিতীয়নম্বর শিরোনাম ‘আল উমুরু বিমাকাসিদিহা'র অধীনে৷ ‘শরহু মুনিয়াতিল মুসল্লি'র সূত্রে তারাতিবের আলোচনা এটি৷ সালাতুল ইস্তিখারার ওপর হচ্ছে কথা৷

পড়াচ্ছেন আমাদের শ্রদ্ধেয় শায়খ হজরত মুফতি আদিল সাহেব৷ ইস্তিখারার নিয়ম বললেন তিনি৷ ইস্তিখারার দোয়া কারোর মনে আছে কিনা, পরীক্ষা করে নিলেন৷ তিনটে ছেলে গড়গড় করে বমি করলো একশ্বাসেই৷ হজরতের মালুমাতে আরও একটি পদ্ধতি রয়েছে ইস্তিখারার, জানালেন৷ যেটি হজরত তাঁর মুর্শিদ হজরত মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহি রহ. থেকে শিখেছেন৷ হজরত বললেন, ‘আমলকে লিয়ে ও তরিকা বহুত আসান হে৷' আমরা জানতে আগ্রহী হলাম৷ নড়েচড়ে বসলাম সবাই৷

হজরত ইস্তিখারার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বললেন আরও দরকারি কয়েকটি৷ মুখে মুচকি হাসির রেখা ছড়িয়ে বললেন, ‘গৌরসে সুনিয়ে৷' গৌরসে শোনার অপেক্ষায় আমরা৷

‘দুটো কাগজ নাও৷ একটির এক পিঠের শুরুতে লেখো—
يعتذرون إليكم إذا رجعتم إليهم، قل لا تعتذروا لن نؤمن لكم، قد نبأنا الله من أخباركم، وسيرى الله عملكم و رسوله ثم تردون إلى عٰلم الغيب و الشهادة فينبئكم بما كنتم تعملون
বাকি অংশ খালি রাখো৷ অপর পিঠের শেষাংশের কোণায় লেখো إفعل ৷ দ্বিতীয় কাগজটির এক পিঠের শুরুতে লেখো—
و قل اعملوا فسيرى الله عملكم و رسوله و المؤمنون ؛ و ستردون إلى عٰلم الغيب و الشهادة فينبئكم بما كنتم تعملون
অপর পিঠের শেষাংশে লেখো لا تفعل ৷ এরপর কাগজদুটো মুড়িয়ে গোল করে জলে ছেড়ে দাও৷ আর পড়তে থাকো—
و إذ قتلتم نفسا فادارأتم فيها، و الله مخرج ما كنتم تكتمون

যতোক্ষণ না দুটোর একটি কাগজ খুলে যায়, ততোক্ষণই পড়তে থাকো আয়াতটি৷ দু'তিন মিনিটের ভেতর যেকোনো একটি খুলে যাবে, ইনশাআল্লাহ৷

যেটি খুলে যাবে, সেটি তোলো৷ দেখো তার অপর পিঠে কী লেখা রয়েছে—إفعل না لا تفعل؟ ৷ ব্যস, সে অনুযায়ী আমল করো৷ বরকত হবে, ইনশাআল্লাহ৷ আমিও এসবের ওপর আমল করে উপকৃত হয়েছি৷' বিস্তারিত জানালেন হজরত৷ দ্বিধায় ভুগতে হবে না বললেন৷ ইস্তিখারার গুরুত্ব বোঝালেন খুব করে৷

দর্স শেষ হবার পথে ততোক্ষণে আমাদের৷ হজরত আরও দু'একটি কথা বলতে চেয়েছিলেন হয়তো বা৷ কিন্তু ঘণ্টা বেজে ওঠলো এরই মধ্যে৷ দর্স শেষ হলো কি হলো না, এই দ্বিধাসংশয়ের ঘোর থেকে বেরোলাম আমরাও৷ কারণ আজ যে শিখলাম আকাবিরের অভিজ্ঞতালব্ধ অভিনব এক কারিশমা৷

লেখক: শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ