বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


নবী চরিত নিয়ে তৈরি সিনেমা সম্পর্কে কী বলছেন খ্যাতিমান মুফতিগণ?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

এ এস এম মাহমুদ হাসান
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

sultan_suleman_usufদ্যা মেসেঞ্জার, সুলতান সুলেমান, ইউসুফ জুলেখা। এগুলো ইসলামি ইতিহাস ভিত্তিক রচিত বিনোদনমূলক সিনেমা। মূলত এগুলো ইসলামি ভাবধারায় তুর্কি ও ইরানিদের তৈরি। তবে এ সিনেমাগুলো বাংলায় ডাবিং করে বাংলাদেশে প্রদর্শন করা শুরু হয় চলতি বছর থেকে।

সম্প্রচারের শুরুতেই বিতর্কে পড়ে সিনেমাগুলো। নবী বা সাহাবীদের জীবন চরিত চিত্রনাট্যের মধ্যমে মঞ্চায়ন করা হচ্ছে। দেখানো হচ্ছে নবী, রাসুল ও তার সাথীবর্গের রচিত কাল্পনিক রুপ। আবার নবী ও সাহাবী জীবনে ঘটে যাওয়া সঠিক ইতিহাস বিকৃতি করে দেখানো হচ্ছে এসব বিতর্কিত সিনোমাগুলোয়। মূলত এ সিনেমাগুলো শিয়া সম্প্রদায়ের ইসলামি আকিদা বা বিশ্বাস মতে বৈধ ও বিশুদ্ধ।

তবে প্রশ্ন উঠেছে, শিয়া সম্প্রদায়ের চরম বিতর্কিত আকিদা মাপে তৈরি সিনেমাগুলো কি বাংলাদেশের সুন্নি আকিদা অধ্যুষ্যিত দেশে সম্প্রচার করা ঠিক হচ্ছে? বিশেষ করে ইউসুফ আ. ও মিশরের তৎকালীন সম্রাটকন্যা হযরত জুলাইখার মাঝে ঘটে যাওয়া একটি স্পর্শকাতর ঘটনা নিয়ে রচিত ডাবিংকৃত ইরানি সিনেমা নিয়ে চলছে চরম বিতর্ক। রাসুলদের জীবনে প্রেম কাহিনীর সত্যায়ন করা হচ্ছে এসব সিনেমায়। এতে ইসলাম ও নবীদের সম্পর্কে ভুল তথ্য যাচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছে। বিতর্কিত করা হচ্ছে নবীদের নিষ্পাপ চরিত্রকে।

নবী জীবনে আল্লাহ প্রদত্ব আকস্মাৎ বিভিন্ন ঘটনার স্বাক্ষী মুসলিম জাহান। তবে নবী রাসুলদের সেই ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক ঘটনা নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করা ইসলামি আকিদা মতে বৈধ কী? এমনই প্রশ্ন এখন ইসলামি আকিদা ও রীতি পরিপালনে সজাগ সর্বস্তরের জনসাধারণের মনে। আওয়ার ইসলাম এর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ইসলামি ফিকাহর সঠিক সিদ্ধান্ত জানতে ৬টি প্রশ্ন করা হয়েছিল বাংলাদেশের খ্যাতিমান গ্রহনযোগ্য দুজন মুফতির কাছে। একজন শাইখ জাকারিয়া রহ. রিসার্চ সেন্টারের প্রধান মুফতি মিজানুর রহমান সাইদ। অপরজন মারকাযুদ্দাওয়াহ আল ইসলামিয়ার পরিচালক মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

প্রশ্ন ১। ইসলামের দৃষ্টিতে টেলিভিশন দেখার অবকাশ আছে কিনা?

১ম প্রশ্ন সম্পর্ক শাইখ জাকারিয়া রহ. রিসার্চ সেন্টারের প্রধান মুফতি মিজানুর রহমান সাইদ বলেন, টিভিতে সম্প্রচার দুই প্রকার- (ক) লাইভ সম্প্রচারের ভিডিও যদি ইসলাম বিরোধী না হয় এবং ভিডিওতে বেপর্দা নারীর উপস্থিতি না থাকে তাহলে সেই লাইভ প্রচারিত ভিডিও দেখা যাবে। তবে কোনোভাবে বেপর্দা নারীর উপস্থিথি থাকলে বা উপস্থিতির সম্ভাবনা থাকলে তা দেখা ইসলামের দৃষ্টিতে অবৈধ।

(খ) বর্তমানে বৈজ্ঞানিক যুগের সিডি, পেনড্রাইভ ইত্যাদিতে ধারণ করা ভিডিও রেকর্ড করে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান আমার মতে বৈধ। তবে শর্ত হলো বেপর্দা নারীর উপস্থিতি ও ইসলাম বিরোধী অনুষ্ঠান না হতে হবে। তিনি বলেন, রেকর্ডকৃত ভিডিও সম্প্রচার করা বা দেখা অনেক ওলামায়ে কেরামের মতে অবৈধ।

[caption id="attachment_13056" align="alignnone" width="828"]mizanur-rahman মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ[/caption]

মারকাযুদ্দাওয়াহ আল ইসলামিয়ার পরিচালক মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ বলেন, এ প্রশ্নটির উত্তর মূলত ব্যাখ্যামূলক। তবে সংক্ষেপে বলতে গেলে টিভিতে অশ্লীল বা ইসলাম বিরোধী অনুষ্ঠান না হলে পুরুষরা পুরুষদের ও নারীরা নারীদের অনুষ্ঠান দেখতে পারবে।

প্রশ্ন ২। কুরআন ও হাদিস অনুযায়ী নবীদের জীবন চরিত চিত্রনাট্যে কল্পিত ভাবনায় উপস্থাপন করা সঠিক কি না ? রচিত সিনেমায় নবী, রাসুল ও তার সাহাবীদের অবয়ব প্রদর্শন করা বা দেখা ইসলাম সম্মত কি না?

২য় প্রশ্ন সম্পর্কে মুফতি মিজানুর রহমান সাইদ বলেন, কুরআন ও হাদিস অনুযায়ী নবীদের জীবন চরিত চিত্রনাট্যে কল্পিত ভাবনায় উপস্থাপন করা বা দেখা বৈধ নয়। এটা সম্পূর্ণ শরিয়ত পরিপন্থি। এটার প্রদর্শক ও দর্শক উভয়েই বড় ধরনের গুনাহের সম্মুখিন হবে। সুতরাং এ সিনেমা বানানো, সিনেমা প্রদর্শন বা দেখা পরিহার করা জরুরি।

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ বলেন, নবীদের জীবন চরিত চিত্রনাট্যে কল্পিত ভাবনায় উপস্থাপন করা বা দেখা হারাম। নিশ্চয় একটা কাহিনীকে যখন নাট্যমঞ্চে উপস্থাপন করা হয় তখন মূল কাহিনীকে বিভিন্ন কল্পিত রঙ দিয়ে বাড়িয়ে কমিয়ে দৃষ্টিনন্দন করে উস্থাপন করা হয়। যা মূল চরিত্রের সঙ্গে কোনো মিল থাকে না। সে ক্ষেত্রে নবীদের জীবনী মন মাতানো ডিজাইনে বাড়িয়ে কমিয়ে উপস্থাপন করা মানে হচ্ছে, নবীদের উপর অপবাদ দেওয়া। ইসলামের অবমাননা করা। আর এটা সম্পূর্ণ অনধিকার চর্চা ও হারাম।

প্রশ্ন ৩। নবী জীবনে ঘটে যাওয়া বিবাহ বন্ধনের স্পর্শকাতর দুর্লভ ঘটনাকে প্রেম কাহিনীতে রূপায়ন করে নায়ক নায়িকা চরিত্রে প্রদর্শন করা সঠিক কিনা?

৩য় প্রশ্ন সম্পর্কে মুফতি মিজানুর রহমান সাইদ বলেন, নবী জীবনে ঘটে যাওয়া বিবাহ বন্ধনের স্পর্শকাতর দুর্লভ ঘটনাকে প্রেম কাহিনীতে রূপায়ন করা এটা জঘন্য কাজ। এগুলো শিয়াদের তৈরি। আর শিয়া সম্প্রদায় ইসলামের সূচনাকাল থেকে আজ অবধি ইসলামের ক্ষতি করে যাচ্ছে। সুতরাং এগুলো মুসলমানদের জন্য অবশ্য পরিহার্য্য। তাছাড়া নবী রাসুলদের জীবনী ও রূপ হুবহু কাল্পনিকভাবে উপস্থাপন করাও সম্ভব না। বরং এতে ইসলাম ও নবী জীবনের ভয়াবহ অবমাননা হচ্ছে। যা অত্যন্ত গর্হিত কাজ।

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ বলেন, নবীদের চরিত্র বা তাদের সন্মানিতা স্ত্রীদের চরিত্র বিকৃতি করা, চেহারা প্রদর্শন করা হারাম। এটা ইসলামি বিশ্বের অভিভাবক সমতুল্য ওআইসির ফিকহি বোর্ডেও হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশে সম্প্রচারিত কথিত ইসলামি ইতিহাস নির্ভর সিনেমাগুলো দেখা ও দেখানো সম্পূর্ণ হারাম।

প্রশ্ন ৪। সাধারণ জনগণের টেলিভিশন দেখার অভ্যাস দূর করা বা সিরিয়াল দেখার নেশা দূর করা সম্ভব কি? অনেকের অভিমত ইসলামি মুভির কারণে ভারতীয় অশ্লীল সিরিয়াল দেখার হার কমছে। মানুষ ভালো কিছু জানছে? এটি যুক্তিসঙ্গত উত্তর নয় কি?

৪র্থ প্রশ্ন সম্পর্কে মুফতি মিজানুর রহমান সাইদ বলেন, সাধারণ জনগনের টেলিভিশন দেখার অভ্যাস দূর করা বা সিরিয়াল দেখার নেশা দূর করার জন্য আমাদের বেশি বেশি দ্বীনি আলোচনা জনসাধারণকে শোনাতে হবে। তাদেরকে ইসলামের সঠিক দীক্ষা দিতে হবে। তবে ভারতীয় অশ্লীল সিরিয়াল দেখার পরিবর্তে ইসলামি ইতিহাস নিয়ে রচিত এসব ইরানি বা তুর্কি সিনেমা দেখা যাবে এমনটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই। ভারতীয় সিরিয়াল দেখা যেভাবে না জায়েজ ঠিক তেমনি ইসলামি ইতিহাস নির্ভর এসব সিনেমা দেখাও জায়েজ নেই। খারাপ জিনিসকে খারাপ জিনিস দ্বারা প্রতিহত বৈধ নয়। তাই ভারতীয় সিরিয়াল বন্ধে ইসলামি সিরিয়াল প্রচার বা দেখা সম্পূর্ণ অযুক্তিক।

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা আমাদের পরিবারগুলোকে কেন সিরিয়াল দেখাবো? কেন হিন্দি সিরিয়াল দেখার সুযোগ করে দিব? আর হিন্দি সিরিয়াল ছাড়ার জন্য শিয়া সিরিয়াল দেখানোর খোড়া যুক্তি সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য। আমরা আমাদের পরিবারের কোনো সদস্যকে সিরিয়াল দেখাবো না। চাই সেটা হিন্দি হোক কিংবা শিয়া মতাদর্শের ইরানি সিনেমা। সবই পরত্যিাগ করতে হবে।

প্রশ্ন৫। সাধারণ দর্শকদের কেউ কেউ ভাবছে, পাঠ্যবই থেকে পৃথকভাবে ইসলামের ইতিহাস জানা তাদের জন্য সম্ভব না হলেও এসব ইসলামি ইতিহাস ভিত্তিক সিনেমাগুলোর মাধ্যমে তারা ইসলামি ইতিহাস সম্পর্কে সহজে জানতে পারছেন। এটাতো একটা ভালো উদ্যোগ।

৫ম প্রশ্ন সম্পর্কে মুফতি মিজানুর রহমান সাইদ বলেন, সাধারণ দর্শকদের বুঝাতে হবে পাঠ্যবই থেকেই ইসলামের ইতিহাস জানতে হবে। সিনেমার মাধ্যমে ইতিহাস জানার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। যেহেতু সিনেমা ছাড়াই পাঠ্যবই থেকে ইসলামি ইতিহাস জানার বিকল্প ও সঠিক পদ্ধতি আছে, সেহেতু সিনেমার মাধ্যমে ইতিহাস চর্চা করার দোহাই দেওয়া হাস্যকর।

যে সিনেমা সংসার ভাঙ্গে আর যে সিনেমা ঈমান নষ্ট করে, তা একই। সুতরাং অবশ্যই এ জাতীয় সিরিয়াল পরিহার করতে হবে।

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ এ ব্যপারে একই মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ইসলামি ইতিহাস জানার জন্য কেন সিনেমা দেখতে হবে? এটি একটি শয়তানি ধোকা। ইতিহাস জানার প্রয়োজন হলে হাদিস কুরআন তাফসির থেকে ইতিহাস জানতে হবে।

প্রশ্ন ৬। সর্বশেষ প্রশ্ন করা হয়েছিল, বর্তমানে ভারতীয় অশ্লীল সিনেমা ও সিরিয়ালের প্রভাবে বাংলাদেশের সুস্থ্য সংস্কৃতি ও পারিবারিক বন্ধনের দৃঢ়তা হুমকির মুখে। কিন্তু ইসলামি ইতিহাস নিয়ে রচিত এ বিদেশি ডাবিংকৃত সিনেমাগুলো ভারতীয় সিরিয়ালগুলোর স্থান দখল করছে। ফলে বাংলাদেশে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত ভারতীয় বিতর্কিত সিরিয়ালগুলোর দর্শক কমতে শুরু করেছে এবং বাংলাদেশী দর্শকগণ ইসলামি ভাবধারায় রচিত এসব সিনেমার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। ফলে ভারতীয় পূজা পার্বন ও সাংসারিক জীবনের অশালীন কূটচালের উপর নির্মিত সিরিয়াল দেখা বন্ধ হচ্ছে । এ ক্ষেত্রে ইসলামি ফিকহের মতামত কি?

৬ষ্ঠ প্রশ্ন সম্পর্কে মুফতি মিজানুর রহমান সাইদ বলেন, আমাদের পরিবারের সদস্যদের সঠিক দ্বীনের উপর চালাতে হবে। দ্বীনি তালিমের মধ্যে রাখতে হবে। এ জঘন্য পাপাচারের পরিণতি সম্পর্কে বোঝাতে হবে। এসব সিরিয়াল ও সিনেমা বন্ধে প্রতিবাদ জানাতে হবে।

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ বলেন, উভয় ধাচের সিনেমা আমাদের পরিত্যাগ করতে হবে। যে সিনেমা সংসার ভাঙ্গে আর যে সিনেমা ঈমান নষ্ট করে, তা একই। সুতরাং অবশ্যই এ জাতীয় সিরিয়াল পরিহার করতে হবে। এ সকল সিনেমা তৈরিতে যারা যেভাবেই জড়িত, আর যারা দেখার সাথে জড়িত, সবাই সমানভাবেই হারাম কাজ করছে। যা ইসলাম সমর্থন করে না।

আরআর

এ বিষয়ে আপনার মতামত বা অভিজ্ঞতার কথা লিখুন নিচের মতামত ঘরে বা ফেসবুক পেইজে 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ