বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


মুসা আল হাফিজ ও বাংলা কবিতার 'পরম সাঁতার'

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আলী হাফিজ

musa_al_hafiz_param_satarমুসা আল হাফিজ মানে মুসা আল হাফিজ। কবি হিসেবে, গবেষক হিসেবে, সাহিত্য সমালোচক হিসেবে, দার্শনিক হিসেবে, ছড়াকার হিসেবে, অনুবাদক হিসেবে...

কীভাবে তার পরিচয় স্পষ্ট করি? অপরদিকে একজন শায়খ, একজন মুহাদ্দিস, একজন বাগ্মী কিংবা একজন ঐতিহাসিক... এক পরিচয়ের তলে আরেক পরিচয় চাপা পড়ে যায়। ফলে মুসা আল হাফিজ মানেই একটি ট্রেন্ড, একটি প্রজন্মের গতি, একটি প্রতিষ্ঠান। তার বহুমাত্রিকতার বিজ্ঞাপন তার সৃষ্টকর্ম। কোনো দল বা গোষ্ঠী নয়। কোনো চটকদার মিডিয়া নয়। ফলে তাঁর সকল অর্জনই মৌলিকতার ফসল। মননশীলতার ফসল।

এক্ষেত্রে আমার চোখে তার প্রধান শক্তি নিহিত কবিতায়। অন্যান্য ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে তার উচ্চ স্বীকৃতি থাকলেও কবিতায় তার দান যুগান্তকারী। যার বাস্তব প্রমাণ ঈভের হ্রদের মাছ। সম্প্রতি এ ধারায় যুক্ত হয়েছে নতুন এক গ্রন্থ- পরম সাঁতার।

এ গ্রন্থে মুসা আল হাফিজ নিজেকে অতিক্রম করেছেন।আগের তুলনায় রহস্যময়তা বেড়েছে অনেক। একেকটি লাইনে বহু রকম অর্থসম্ভাবনা বিদ্যমান। একেকটি কবিতা তাৎপর্যের একেক জগত। উদাহরণ হিসেবে দু'টি কবিতাংশ তুলে ধরছি-

আমি উঠছি, কবরের মাটি ঝেড়ে লাফিয়ে
লাফিয়ে জাগছে জীবন্ত প্রোথিত সবশিশু
আমি ছুটছি, ইতিহাসের লোনা জলে ডুবে
যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ আর কবিতার বারোটি পংক্তির উপর দিয়ে বাধার সমুদ্র
পার হচ্ছে মানুষের মহাস্বাধীনতা
আমি ফুটছি, সূর্যের আয়াতগুলো
আযানের ঝংকারে হাসির দানার মতো ছড়িয়ে পড়ছে প্রকৃতির প্রাণে।
তারপর পৃথিবীটা প্রেমের সংসার
আমার নি:শ্বাস থেকে কালের প্রান্তরে
জ্বলে উঠলো সুগভীর বিজয়ের শিখা
আমার বিশ্বাস থেকে সমস্ত আত্মার পাখি
মহাকালের জিকির করছে স্বর্গীয় মৌতাতে
(জয়যাত্রার গান)

আমরা কোথায় আছি?
আছি,যেখানে থাকা নেই!
এখানে বৃষ্টি সিক্ত করে এবং শুকিয়ে দেয়
এখানে সূর্য এবং চাঁদ হাজির হয় না লজ্জায়
কেননা এখানে প্রতিটি চেহারাই চাঁদ,
প্রতিটি কপোলে সূর্য এখানে কথা বলছে
পাহাড় আর গাছে গাছে দাউ দাউ সবুজ আগুন
মদের মৌতাতে দ্যাখো বেহুঁশ মেঘমালা!
আমরা মৃত্যুবরণ করে করে এখানে এসেছি
আমরা বার বার জীবিত হয়ে এখানে এসেছি!
এখানে হৃদয় থেকে বইছে নদীনালা
ওরা আকাশে উড়ে যায় জমিনের মাধুরি নিয়ে
ওরা জমিনে নেমে আসে আকাশের শুভেচ্ছা নিয়ে!
এখানে সাত আকাশের সমান আকাশ বুকে নিয়ে
আমরা বসে যাই ধ্যানের নিকেতনে!
(আরেক পৃথিবী)

দুধের গামলায় ক্লেদাক্ত পা ডুবিয়ে
ঘেউ ঘেউ করছে নেড়ে কুকুর
রক্তাক্ত সবুজ পড়ে আছে মৃত গোলাপদের
মাঝখানে
জখমী সূর্য থেকে চুইয়ে পড়ছে লাল পুঁজ
আর
সন্ধ্যার লাল প্রস্রাব
প্রতিধ্বনি আর ছায়ামূর্তিরা ইতিহাস থেকে নেমে আসছে
তারা কাউকে উন্মাদ বানাচ্ছে মেরে ফেলবে বলে!
আটলান্টিক পেরুতে কাদছে সভ্যতার যাযাবর
(সাম্প্রতিক পৃথিবী)

যারা কবিতার সমজদার, তারা বুঝে গেছেন সমকালীনতা ও চিরকালীনতা কীভাবে তার কবিতায় প্রতীকের আশ্রয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে।অতি সহজ, কিন্তু দার্শনিকতা ও অলঙ্কারে পূর্ণ ভাষার সাহায্যে পরম সাঁতারের কবিতাগুলো বাংলা কবিতায় নতুন স্বাদ ও সৌরভ নিয়ে হাজির হয়েছে। এখানে ইউরোপকেন্দ্রিকতার বদলে নতুন এক হৃদয় ও জীবনবাদী দৃষ্টিকোণ উপস্থাপিত। আধ্যাত্মিক আনন্দ ও ঐশ্বর্য যেভাবে ঢেউ তুলেছে, তার নজির এদেশের কবিতায় একান্তই বিরল। জীবনের বহু রহস্য বইটির পাতায় পাতায় আলোড়ন তুলেছে।

সাম্প্রতিক কবিতার রুগ্নতা ও জীর্ণতার ভিড়ে গ্রন্থটি কালজয়ী শিল্পসম্ভার নিয়ে সুস্থতার সুবাতাস বইয়ে দেবে, সে আশা করাই যায়। কারণ বাংলা সাহিত্যে এমন মৌলিক ও মনস্বী কাব্যগ্রন্থ গণ্ডায় গণ্ডায় রচিত হয়নি।

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ