বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৫ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ৯ শাওয়াল ১৪৪৫


মুক্তিযুদ্ধে চরমোনাই পীর ও মাদরাসা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

শাহনূর ইসলাম শাহীন
আওয়ার ইসলাম

তখন আমি খুব ছোট। রাজনৈতিক প্যাঁচ গোজ অতশত বুঝতাম না। মাদরাসায় পড়তাম। সেই সুবাদে ছোট থেকেই টুপি পাঞ্জাবি পড়ার অভ্যাস ছিল নিয়মিত। গল্পে ইতিহাসে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা পড়েছি। মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার সম্বন্ধে জেনেছি। জেনেছি এটা, একাত্তরে পশ্চিম পাকিস্তানি জালিম শাসকদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে বাংলার অপমার জনসাধারণ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। অপরদিকে কিছু বিশ্বাসঘাতক পাকিস্তানিদের সহযোগী হয়ে দেশ বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল। পাকিস্তানিদের নানা অপকর্মের সহযোগী হয়ে ইতিহাসে তারা রাজাকার-আলবদর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

যখন একটু বড় হতে লাগলাম মানুষের সাথে মিশতে থাকলাম তখন লক্ষ্য করলাম গল্প আড্ডায় কিংবা রাজনৈতিক আলাপকালে বন্ধু-বাবান্ধব ও পরিচিতজনর পোষাকের কারণে আমাকে রাজাকার বলে টিপ্পনি কাটতো। তারা বুঝাতে চাইত হুজুর বা দাড়ি টুপি-পাঞ্জাবিওয়ালা মানেই রাজাকার। প্রতিবাদ করার মত কোনো তথ্য জানা না থাকায় কোনো প্রতিবাদ করতে পারতাম না। উস্তাদদের কাছ থেকে এ বিষয়ে কিছু শুনতে পেতাম না। বিভিন্ন সভা সেমিনার বিশেষ করে স্থানীয় ওয়াজ মাহফিল গুলোতেও অতিথি আলেমদের মুখেও কোনো প্রতিবাদী তথ্য পেতাম না।

স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা ফেরি করা কিছু স্বার্থান্বেষী নষ্ট মানুষের বিরুদ্ধে যখন আলেমরা কথা বলত তখন ভাবতাম দেশভাগ হওয়াটা মনে হয় প্রতিবেশী দেশের ষড়যন্ত্র ছিল। কেননা কিছু কিছু কথা পরোক্ষভাবে দেশের অখণ্ডতার প্রতি সমর্থন করত। তখন এটা বুঝতাম না যে, বক্তা আসলে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অশ্রদ্ধা করে কথা বলেননি বরং মুক্তিযুদ্ধের নাম ভাঙ্গিয়ে কিছু ধর্ম বিদ্ধেষী লোকের অপকর্মের কথা বলেছেন। ফলশ্রুতিতে এক সময় ধারণা করতাম হয়তো তৎকালীন সময়ে মুসলিম দেশ হিসেবে আলেম সমাজ অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষেই ছিলেন।

তবে এটা মনে করতাম ইতিহাস বদলেছে, সময়ের প্রয়োজনে দেশ স্বাধীন হয়েছে সুতরাং স্বাধীনতাকে মেনে নিতে মহান মুক্তিযুদ্ধকে মেনে নিতে হবে। মনকে এই বলে প্রবদ দিতাম অন্তত আমি আমার স্বদেশের পক্ষে আমার স্বাধীনতার পক্ষেই থাকব। কিন্ত তাতে তৃপ্তি পেতাম না। যখনই বায়োজোষ্ঠদের নিকট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার কথা শুনতাম, ইতিহাসে তাদের নির্মমতার কথা পড়তাম তখন মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগত। মুসলিম হোক আর অমুসলিম হোক ইসলাম কারো উপর জুলুম সহ্য করে না।

যুদ্ধের ময়দানে নারী ও শিশুর উপর আক্রমণ সমর্থন করে না। অথচ বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধ কোনো ধর্ম যুদ্ধও ছিল না। বরং মুক্তিযুদ্ধ ছিল স্বজাতীর হাতে নির্যাতিত মানুষের মুক্তির লড়াই। যেখানে শাসক গোষ্ঠীর দমন পীড়নের প্রতিবাদে মানুষ হাতে অস্র তুলে নিয়েছে। যেখানে সাধারণ মানুষের উপর নির্বিচারে গণহত্যা চালানো হয়েছে। মা বোনদের ইজ্জত লুন্ঠন করা হয়েছে। সেখানে পাকিস্তানের প্রতি ওলামায়ে কেরামের সমর্থন কীভাবে থাকতে পারে। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে কোনো উত্তর না পেয়ে ইতিহাস খুঁজতে থাকলাম। পত্র পত্রিকা ও ইন্টারনেট ঘেটে বিক্ষিপ্ত কিছু তথ্য পেয়ে এতোটুকু নিশ্চিত হয়েছি যে, মুক্তিযুদ্ধে ওলামায়ে কেরামের অবদানকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

বিরুদ্ধবাদীদের অপবাদের ধারাবহিকতায় প্রশ্ন জাগল মুক্তিযুদ্ধে পীর সাহেব চরমোনাই এর ভুমিকা কেমন ছিল। এ বিষয়ে সর্ব প্রথম পূর্ণ ধারণা পেলাম তরুণ আলেম লেখক ও গবেষক শাকের হোসাইন শিবলী রচিত ‘আলেম মুক্তিযুদ্ধার খোঁজে’ গন্থে।  একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরমোনাই এর মরহুম পীর মাওলানা সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. এবং তার পিতা সৈয়দ এছহাক করীম রহ. এর অবস্থান ছিল সুস্পষ্টভাবে স্বাধীনতার পক্ষে। এমনকি এটাও বলা যায় মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ সাহায্যকারী হিসেবে পরোক্ষভাবে উভয়ই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ন'মাসই চরমোনাই মাদরাসা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ক্যাম্প। ৯ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিল ও ক্যাপ্টেন আবদুল লতিফ এর রীতিমত যাতায়াত ছিল পীর সাহেব মাওলানা এছহাক রহ. এর কাছে। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের ১১ টি সেক্টরের পূর্ণ একটি সেক্টরই পরিচালিত হয়েছে চরমোনাই মাদরাসা থেকে।

বরিশাল থানা এবং বরিশালের সরকারি বিভিন্ন দফতরের অনেক কর্মকর্তা সে সময় সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছিল চরমোনাই জামেয়া রাশিদীয়া আহসানাবাদ কামিল মাদরাসায়। মাদরাসার তৎকালীন প্রিন্সিপাল এছহাক রহ. এর জামাতা মাওলানা ইউসুফ আলী খান ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বসম্মতিক্রমে নিয়োজিত তাদের বিচারক।

একদিন চরমোনাই মাদরাসার কিছুটা দূরে বুখাইনগর এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় শীর্ষ নেতাদের বৈঠক হয়। ঐ বৈঠকে ডাক পড়ে মাওলানা ইউসুফ আলী খানের। মাওলানাকে বৈঠকে উপস্থিত হতে দেখে একজন চিৎকার করে বলে উঠে এ এবার কে? ঘাপটি মারা কোনো দালাল নয়তো? তখন সঙ্গে সঙ্গে কমান্ডার আব্দুল হামিদ দাড়িয়ে যান এবং মাওলানা ইউসুফ আলী খানের পরিচয় দিয়ে বলেন ইনি আমাদের একান্ত নিজস্ব লোক। ঐ বৈঠকেই সর্বসম্মতিক্রমে মাওলানা ইউসুফ আলী খানকে মুক্তিযোদ্ধের বিচারক মনোনীত করা হয়। যুদ্ধ শেষ হলে মুক্তিযোদ্ধারা মাওলানা খানের যিম্মায় অনেক অস্রসস্র রেখে যায়। পরে স্থানীয় দারোগা আব্দুল মান্নানের হাতে অস্রগুলো তুলে দিয়ে মাওলানা খান বিশ্বস্ত আমানতদার ও খাঁটি দেশপ্রেমিকের পরিচয় প্রদর্শন করেন। সৈয়দ এছহাক রহ. এর অনুমতি এবং সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. সহ এছহাক রহ. এর অন্যান্য সন্তানদের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়েই মাওলানা খান এসব করেছেন।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে শর্ষীনা ও ফায়রার পীর এবং বরিশাল জামে মসজিদের তৎকালীন খতিব মাওঃ বশীরুল্লাহ কে সরকার গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠালেও চরমোনাই পীর বা মাওঃ ইউসুফ আলী খানের দিকে উঠেনি কোনো অভিযোগের আঙুল।

স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু থেকেই চরমোনাই পীর সাহেব ছিলেন স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি। অথচ সারাদেশের ওলামাদের এমন বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস আজকে অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছে। স্বার্থান্বেসী মহল উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে ঢালাওভাবে সকল আলেমকে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার হিসেবে চিত্রায়িত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। স্বার্থান্বেষী মহলের অপচেষ্টা রুখতে হলে আমাদেরকে ইতিহাস চর্চা করতে হবে। নিজেদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। বিজয়ের এই দিনে কামনা করি অন্ধকার গলিতে চাপা পড়ে থাকা ইতিহাস মুক্তি পাক। মুক্তি পাক ওলামা ইতিহাসের সোনালী অধ্যায়।

লেখক : সভাপতি ইশা ছাত্র আন্দোলন সরকারি মাদ্রাসা-ই আলিয়া, ঢাকা।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ