মুফতি মুহাম্মদ আরাফাত
সবুজ-শ্যামলে ঘেরা, সুজলা সুফলা ফসলে মাঠভরা, কোথাও কোথাও সুউচ্চ পাহাড়-পর্বতমালা। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রিয় দেশ। ত্রিকূল ভারত ঘেরা একপাশে বঙ্গপসাগরের ফোয়ারা, মাতৃভূমি মায়ের দেশ সোনালি বাংলাদেশ। হিজল তমাল, তরুলতা আর সবুজ শ্যামলতায় ঘেরা রূপসী বাংলাদেশ।
১৬ ডিসেম্বর, আমাদের বিজয় দিবস। আমাদের জাতীয় দিবস। এ বিজয় কারো দয়া অনুগ্রহের ফসল নয়। শিশুর লাশের মিছিলে লাখো শহীদের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে যুবতি বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যদিয়ে উনিশ' শ একাত্তরের ষোল ডিসেম্বর মাতৃভূমি বাংলাদেশ মুক্ত হয় পাকহানাদার বাহিনীর দাসত্বের শিকল থেকে।
বাংলার পুবাকাশে উদ্ভাসিত হয় স্বাধীনতার রক্তলাল সূর্য। অর্জন করি লাল -সবুজের পতাকা। বাঙ্গালি জাতি পরে বিজয়ের মালা। একটি বিজয়ী জাতি ও দেশ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে পৃথিবীর মানচিত্রে। বিশ্বের দরবারে আত্ম পরিচয় ঘটেছে একটি স্বাধীন ও বীরের জাতি হিসেবে। রচিত হয়েছে একটি গৌরবময় বিজয়ের ইতিহাস।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল 'জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের'। পাকিস্তানিরা ছিল জালিম এদেশের নিরীহ মানুষ ছিল মজলুম। মজলুমকে সাহায্য করা, তাদের পক্ষে অস্ত্র ধরা, তাদের প্রতি সহনুভূতির হাত বাড়ানো, তাদের পাশে দাঁড়ানো শুধু মনুষত্বের পরিচয়ই ছিল না, ছিল ঈমানি দায়িত্ব। এই ঈমানি দায়িত্ব পালনে আলেম সমাজের ছিল অগ্রণী ভূমিকা।
দেশের অতন্দ্র প্রহরী ওলামায়ে কেরাম মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। জান-মাল সর্বশক্তি বিলিয়ে দিয়ে পাকিস্তানি জালিম শাসকের কবল থেকে মুক্ত করেছে দেশের মানুষকে, মুক্ত করেছে দেশকে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন হাজারো দেশপ্রেমিক ওলামায়ে কেরাম। একাত্তরে ওলামায়ে কেরাম ছিলেন মুক্তিকামী বাঙ্গালির সিপাহসালার। মুক্তির সংগ্রামে উলামায়ে কেরামের অবদান অনস্বীকার্য।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে জাতির আধ্যাত্মিক নেতা মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ. বাঙ্গালি জাতির মুক্তির স্বপক্ষে ঘোষণা করে বলেছিলেন ‘এ যুদ্ধ ইসলাম আর কুফরের যুদ্ধ নয়, এই যুদ্ধ জালেম আর মজলুমের যুদ্ধ’। পাকিস্তানিরা জালেম, এদেশের মানুষ মজলুম। তাই মজলুমকে মুক্তি করতে জালেমের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়া সময়ের বড় কর্তব্য।
হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখায় বিগত ১০-৪-২০১৪ ইং বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়েরর পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মাননীয় মন্ত্রী মহদোয় ক আ ম মোজ্জাম্মেল হকের হাত থেকে মরণোত্তর মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা প্রদান করা হয়।
হযরত মাদানি রহ.এর খলিফা, আধ্যাত্মিক রাহবার আল্লামা লুৎফর রহমান বর্ণভী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের দূরদর্শী সিপাহসালার।
তিনি বিজয়ের পূর্বাভাষ দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি সূর্যের মতো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, কয়েক দিনের ভেতরেই এদেশ স্বাধীন হয়ে যাবে এবং পাকিস্তানি হানাদারের জুলুমের কবল থেকে এ দেশের জনগণ মুক্তি লাভ করবে’।
আল্লামা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী রহ. ও ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সরব অংশগ্রহণ করেছিলেন পাকহানাদার বাহিনী হটানোর আন্দোলনে। তিনি ১৯৭১ সালে লালবাগ মাদরাসার ছাত্র। যুদ্ধ শুরু হলে মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়। তখন তিনি হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দ্বীপ্ত ঘোষণা শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন।
চট্টগ্রামের পটিয়া মাদরাসা ও বরিশালের চরমোনাই মাদরাসা ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প।
এছাড়াও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মালা গাঁথুনীতে লাল-সবুজের পতাকা উড়াতে ময়দানে সক্রিয় ভুমিকা পালন করেছেন মাওলানা ফজলুল করীম রহ. পীর সাহেব চরমোনাই, আল্লামা কাজী মু'তাসিম বিল্লাহ রহ. আল্লামা মুফতি নুরুল্ল্যাহ রহ. আল্লামা শামসুদ্দিন কাসেমী রহ., উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, আবদুল্লাহ বিন আবু সাঈদ জালালাবাদী, মাওলানা আতাউর রহমান খান, মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, মাওলানা মোস্তফা আজাদ, কারী ইউসুফসহ বহু সংখ্যক ওলামায়ে কেরাম।
এছাড়াও স্বাধীনতা যুদ্ধে আলেমদের অংশগ্রহণের এক দলীল হয়ে আছে ‘আলেম মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে’ বইটি। যাতে শতাধিক আলেম মুক্তিযোদ্ধাকে দলীলসহ নিবন্ধিত করা হয়েছে।
পাকিস্তান করাচির ইউসুফ বিননূরীর মুফতি মাহমুদ রহ. ও ছিলেন বাংলাদেশের বিজয়ের সূর্যদোয়ের অপেক্ষায়।
মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী ৭১ সালে করাচি ইউসুফ বিননূরীর ছাত্র। তিনি বলেন, একদিন মুফতি মাহমুদ রহ. মাদরাসায়, এক নেতা শেখ মুজিব সম্পর্কে মন্তব্য করে বলল, শেখ মুজিব গাদ্দারকে গ্রেফতার করে আনা হয়েছে, মুফতি সাহেব হুজুর রাগান্বিত হয়ে উত্তর করলেন, শেখ মুজিব গাদ্দার নয়, তিনি একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিকামী মুসলমান।
স্বাধীনতা সংগ্রামে অবিসংবাদিত মুসলিম নেতা আওলাদে রাসুল সাইয়্যেদ আস'য়াদ মাদানি রহ.এর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। তিনি পাকহানাদার বাহিনীর বর্বোরোচিত হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
সুতরাং স্বাধীনতার ইতিহাসে আলেমদের অবদানকে অস্বীকার করা অনুচিত। সবার জানা উচিত মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস এবং আলেমদের অবদান সম্পর্কে।
লেখক: শিক্ষাসচিব জামিয়াতুস সালাম ঢাকা মদিনাবাগ মাদরাসা
আরআর