শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


দিনে যিনি ছিলেন বজ্রকণ্ঠী রাতের আঁধারে কান্নায় বেহুশ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতী মোহাম্মদ এনামূল হাসান

মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ. শুধু বাংলাদেশের নয় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যতম সফল একজন রাজনীতিবীদ ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক দক্ষতা, বিচক্ষণতা দেশব্যাপী ছিল সমাদৃত। এর অণ্যতম প্রধান কারণ ছিল অন্যান্য রাজনীতিবীদদের মত গতানুগতিক নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য তিনি রাজনীতি করেননি বরং তাঁর রাজনীতি ছিল ইসলামি তাহজিব তামাদ্দুন ও দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ত রক্ষার পাশাপাশি দেশের জনগণকে ইসলামি চেতনায় উদ্ধুদ্ধ করে আদর্শ রাষ্ট্র বিনির্মাণে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা।

তিনি একজন রাজনীতিবীদ হওয়ার পাশাপাশি ছিলেন শীর্ষ একজন শায়খুল হাদিস, শীর্ষ মুফতী, কুরআনে হাফেজ, লেখক, গবেষক ও খাঁটি আল্লাহওয়ালা বুজুর্গ। তার গোটা জীবনই ছিল অন্যান্য যে কোন গুণীজনদের থেকেও উত্তম। তিনি যখন হাদিস শরিফ পড়াতেন তখন হাদিসের মূল ব্যাখ্যা ও মর্মার্থ এমনভাবে প্রকাশ করতেন যা বাংলাদেশে অদ্বিতীয় একজন হাদিস ভাষ্যকার হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। যারা তার হাদিস এর দরসে বসার সুযোগ হয়েছে তারা হাদিস আহরণের ক্ষেত্রে ধন্য হয়েছে।

মুফতী আমিনী রহ. ছিলেন একজন শীর্ষ মুফতী। দেশের জনগণকে ইসলামি বিধি বিধান পালনে অভ্যস্ত করে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় ফতোয়া তিনি অবলিলায় বলে দিতেন। ফলে দেশের জনগণ প্রকৃত ইসলামি বিধান মোতাবেক জীবন পরিচালনা করে দুনিয়া ও আখেরাতের মুক্তির পথে হয়েছে উপকৃত। দেশ ও জাতীয় প্রয়োজনে তিনি যগোপযোগী ফতোয়া প্রদানের মাধ্যমে দেশের জনগণের কাছে একজন শীর্ষ মুফতী হিসেবে সু-প্রসিদ্ধ হয়ে সকলের হৃদয়ে আজও বেঁচে আছেন।

মুফতী আমিনী রহ. ছিলেন আলকুরআনের একজন হাফেজ। তার কণ্ঠে সুমধুর তেলাওয়াতে দেশের জনগণের হৃদয়কে করেছে আলোকিত। তাঁর কুরআন তেলাওয়াত শুনে মানুষ কুরআন তেলাওয়াতে আকৃষ্ট হয়ে যেতো। তাঁর মেধা ও প্রখরতা এতবেশি ছিল যে, কর্ম জীবনেই তিনি মাত্র নয় মাসে পবিত্র কুরআনের হাফেজ হয়ে যান যা এক অবিস্মরণীয়।

মুফতী আমিনী রহ. ছিলেন একজন খাটি আল্লাহওয়ালা বুজুর্গ। দিনের বেলা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সমাপ্ত করে রাতের আঁধারে যখন গোটা জাতি ঘুমে বিভোর তখন মুফতী আমিনী রহ. আপন প্রভুর দরবারে ইসলাম, দেশ ও জাতির জন্য শুধু কান্নাকাটিই করতেন না বরং কাঁদতে কাঁদতে অবচেতন হয়ে যেতেন। বিশ্বাসই করা যায় না দিনের বেলা যিনি ইসলাম ও দেশের দুশমনদের বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠে গর্জে উঠতেন সে তিনিই রাতের আঁধারে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো কান্নাকাটিতে বেহুশ হয়ে যেতেন।

মুফতী আমিনী রহ. বলতেন কেউ যদি কিছু হাসিল করতে চায় সে যেন রাতের আঁধারে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে মঞ্জুর করে নেয়। তিনি আরো বলতেন আল্লাহর দরবারে এমনভাবে কান্নাকাটি করবে যেমনভাবে একজন বাচ্চা তার মা-বাবার কাছে কিছু চেয়ে কান্নাকাটি করে।

মা-বাবা যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে সে প্রত্যাশিত জিনিস না দেয় ততক্ষণ পর্যন্ত বাচ্চা যেমন কাঁদতে থাকে তেমনই আল্লাহর দরবারেও সেই ভাবে কাঁদতে হবে। তাঁর এ কথার বাস্তবতা তিনি নিজেই দেখিয়ে গেছেন কিভাবে আল্লাহর দরবারে চাইতে হয় কান্নাকাটি করতে হয়। তাঁর কান্নাকাটি দেখে দেশের আলেম ওলামাগণ, মাদ্রাসার ছাত্র ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণের অন্তরে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করার স্পৃহা জাগ্রত হতো।

মুফতী আমিনী রহ. ছিলেন একজন প্রজ্ঞাবান ও সফল রাজনীতিবীদ। অতি অল্প সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ময়দানে নিজেকে একজন সফল ও গ্রহণযোগ্য রাজনীতিবীদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশে যখনই কোন ইসলাম বিদ্বেষী অপশক্তি দেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তখনই মুফতী আমিনী রহ. জাতির সামনে সেই অপশক্তির মুখোশ উন্মোচন করতে এগিয়ে আসতেন।

ইসলামের বিরুদ্ধে যখনই কোন ষড়যন্ত্র হতো সে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সিংহের মতো গর্জে উঠে ইসলামবিদ্বেষী কর্মকাণ্ড নিশ্চিহ্ন করে দিতেন। যার কারণে দেশের জনগণের কাছে মুফতি আমিনী রহ. একজন আপোষহীন নেতা হয়ে সকলের অন্তরে স্থান করে নিয়েছেন।

বিতর্কিত তাসলিমা নাসরিনকে বাংলাদেশ থেকে বিতারণ, ২০০১ সালে হাইকোর্ট থেকে যখন সর্ব প্রকার ফতোয়া নিষিদ্ধ করা হয় তখন অতুলনীয় সাহসী ভূমিকা, নারী উন্নয়ন নীতিমালার নামে কুরআন বিরোধী আইন বাতিলের আন্দোলনসহ সকল ইসলামি আন্দোলনই তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার গোটা জীবন ছিল আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস। সে সুবাদে বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় ভোগ করতে হয়েছে কারাগারের অন্তরালে সিমাহীন নির্যাতন।

সর্ব শেষ গৃহবন্দি অবস্থায় থাকতে হয়েছে দীর্ঘ ২১মাস। গুম করা হয়েছিল তার ছেলে হাফেজ মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনীকে। কিন্তু তারপরও আন্দোলন সংগ্রামের পথ থেকে তাকে পিছু হঠাতে পারেনি, দুর্বল করতে পারেনি তার সাহসকে।

মূল কথা তিনি ছিলেন রাজনীতিবীদদের জন্য আদর্শ। ২০০১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ নির্বাচনী এলাকা থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে হয়েছিলেন জাতীয় সংসদ সদস্য। বর্তমান রাজনীতিবীদরা যদি এম.পি হতে পারে তা-হলে সর্ব প্রথমই দূর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পরে। জনগণের অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে গড়ে তুলে অর্থের পাহাড়।

বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশের দুই শীর্ষ নেত্রীসহ উল্লেখযোগ্য রাজনীতিবীদ কোন না কোন দুর্নীতির অভিযোগে কারারুদ্ধ হতে হয়েছে। কিন্তু একমাত্র মুফতী আমিনী রহ. কে দুর্নীতির সাথে জড়ানোর সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সা. যখন ইসলামের দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ মক্কা নগরীতে চালিয়ে যেতে লাগলেন তখন ইসলামের কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করতে শিয়াবে আবিতালিবে প্রায় ৩ বছর যাবৎ মুহাম্মদ সা. কে গৃহ বন্দি করে রাখা হয়েছিল। বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল আত্মীয় স্বজন থেকে।

ঠিক তেমনি যার ব্যাপারে মিথ্যা দুর্নীতি, সন্ত্রাস, আত্মসাৎসহ কোন প্রকার অনৈতিকতা মূলক একটি মামলাও হয়নি সেই মুফতী আমিনী রহ. এর বিরুদ্ধে এক স্ব-ঘোষিত নাস্তিকের দায়ের করা মিথ্যা মামলায় ২১ মাস গৃহবন্দি থেকে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। কিন্তু দেশের মানুষ বিশ্বাস করে, মুফতী আমিনী রহ. কে তিলে তিলে মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে।

মুফতী আমিনী রহ. এর গোটা জীবনই ছিল পূর্বসূরীদের প্রতিচ্ছবি। সে আলোকে তাসাউফের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন তাঁর ইসলামি বয়ান ছিল হাজি এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী, হযরত কাশেম নানুতবী, রশিদ আহমদ গাংগুহী, হোসাইন আহমদ মাদানী, আশরাফ আলী থানভী রহ.সহ আকাবের আসলাফদের বয়ানেরই নির্যাস।

তার তেজদীপ্ত বক্তৃতায় দেশের মুসলমানদের হৃদয়ে জাগ্রত হত অনন্য প্রেরণা। এমন হুংকার দিয়ে বেরিয়ে আসবে কিনা, কুরআনের জন্য প্রয়োজনে ফাসির মঞ্চে যেতে প্রস্তুত তবুও ইসলাম বিদ্বেষী খোদাদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আমরণ সংগ্রাম চালিয়েই যাব। সকল আলেম উলামা ও সর্বস্থরের তৌহিদী জনতা প্রতিক্ষায় রয়েছে আরেকজন মুফতী ফজলুল হক আমিনীর।

লেখক: সিনিয়র শিক্ষক জামিয়া কোরআনিয়া সৈয়দা সৈয়দুন্নেছা ও কারিগরি শিক্ষালয়, কাজীপাড়া, ব্রাক্ষণবাড়ীয়া

আরআর

 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ