শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


যে পাখির আকাশ নেই

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

۞  হিমেল হক

himel_haqueপ্রথব পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

একি চেহারা হয়েছে ওর। চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। বাল্বের টিমটিমে লালচে আলোয় ভালভাবে দেখা না গেলেও বেশ বোঝা যাচ্ছে যে, আগের চেয়ে অনেক শুকিয়ে গেছে। আনিসকে দেখে রফিক তেমন একটা অবাক হলো না। মনে হচ্ছে তার এখানে আসার ঘটনা প্রায় প্রতিদিনি ঘটে। মানুষ অবাক হতে হতে একসময় অবাক হতে ভুলে যায়। রফিক হয়তো সেই অবস্থাটা পার করছে। আনিসকে নিয়ে রফিক বাইওে খেতে যায়। কাছে পিঠে নাকি ওর চেনা হোটেল আছে।

গলিটা এখন বেশ অনেকটা অন্ধকার। রফিককে অনুসরন করে হাঁটতে থাকে আনিস। কথা বলে রফিক। গ্রামের সবার কথা জিজ্ঞেস করে। ওর মা-বাবা, বোনের কথা জিজ্ঞেস করে। রফিক মুখ হাসি হাসি করে কথা বললেও তার কন্ঠে যে আফসোস ঝরে পড়ে তা বোঝা যায়। হোটেল থেকে খেয়ে ফেরার সময় রফিক বলল, এসেছিস ভালই করেছিস। তোর কোন চিন্তা নেই। আরামে খাবি আর ঘুমাবি। কলেজে ভর্তি হবার ইচ্ছা থাকলেও বল, ব্যবস্থা করে দিব। নাহ, লেখাপড়া আর আমাকে দিয়ে হবে না। তুই বরং আমাকে চাকরি-বাকরি কিছু যোগাড় করে দে! ঠিক আছে থাক কয়েকদিন,ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে। আচ্ছা,তুই করিস কি? আমার কি আর কাজের ঠিক আছে। যখন যেটা পাই,ওটাই চালিয়ে দেই। শহর খুব বিচিত্র জায়গারে! এখানে তরল হয়ে থাকতে হয়, যেন যখন যে পাত্রে যাওয়া যায় সে পাত্রটারি আকার নেওয়া যায়। কথা বলতে বলতে ওরা গলির ভেতর ঢুকে পড়ে। অন্ধকার হলেও রফিক বেশ তাড়াতাড়িই হাঁটছে,বোঝা গেল এ জায়গায় অন্ধকারে চলাফেরায় ও বেশ অভ্যস্থ।

পরদিন খুব সকালে আনিসের ঘুম ভাঙ্গে। নতুন জায়গায় ওর ঘুম খুব সমস্যা করে। ঠিকঠাক ঘুম আসতে চায় না। বিচিত্র অনুভৃতি। রফিক তখনও মরার মতো ঘুমচ্ছে। আনিস ভাঙ্গা জানালাটার কাছে এসে দাঁড়ায়। চটটা সরিয়ে বাইরে মাথা গলিয়ে দেয়। এখনও তেমন আলো ফোটেনি,চারদিকে ঝাপসা অন্ধকারে ঢেকে আছে। চশমার কাঁচ কংক্রিটে ঘষে চোখে দিলে চারপাশ যেমন দেখায়, তেমন দেখাচ্ছে। আনিস কাছে পিঠে কোন বাড়ি-ঘর দেখে না। সামনে একটা পুকুর। ওপাশে কয়েকটা ছোট ছোট বিল্ডিং,মিল-কারখানা হবে মনে হয়। পিছনে বর্জ্য পড়ে আছে। গোটা দশেক কাক ওখানে ওড়াওড়ি করছে। রফিকের ডাক শুনে পিছনে তাকায় আনিস। এর মধ্যেই উঠে বাইরে যাবার জন্য জামাকাপড় পড়েছে আনিস লক্ষ্যই করেনি।

ছোটবেলা থেকেই ওর বেশ নিঃশব্দে চলাফেরার অভ্যাস আছে। গ্রামে থাকতে হঠাৎ হঠাৎ মাঝরাতে বাড়িতে এসে জানালায় টোকা দিত। এত নিঃশব্দে যে ভালো করে কান না পাতলে বোঝাই যেত না। প্রথম প্রথম ভয় লাগতো খুব পড়ে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। সকালে আর দুপুরে মজনুর সাথে গিয়ে খেয়ে আসিস। ওকে বলে গেলাম। তুই কাজে যাচ্ছিস নাকি? হুম! থাক তাহলে। কিছু লাগলে,মজনুকে বলিস। ঠিক আছে যা। আমার কাজের ব্যাপারে একটু খোঁজটোজ নিস। আচ্ছা। ছোট করে উত্তর দেয় ও।

টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি খেয়ে আনিস খাটের উপর বসল। পানিটা গত রাতের, বাসি হয়েছে। আনিসের বমি আসতে লাগল। অনেক সময় খুব বেশি ক্ষিধে পেলে ওর এমন হয়।

রফিকের যাবার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে আনিস। নিজের ভিতরে একধরনের তাড়া অনুভব করে। চাকরি-টাকরির ব্যবস্থা কিছু একটা তাকে তাড়াতাড়িই করতে হবে। গ্রামে মা হয়তো টেনেটুনে সংসার চালাচ্ছে কিন্তু বোনটারতো পড়ার বেতন অনÍত তাকে দিতে হবে। নাহ্, খুব তাড়াতড়িই কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। আর বাবাটাও যে কি না,হুট করে চলে গেল।

আনিসের এখনো মনে পড়ে,ছোটবেলায় বাবা কাঁধে চড়িয়ে তাকে মেলায় নিয়ে যেত। মেলায় গিয়ে আরেক কান্ড, আনিসের হাত শক্ত করে ধরে থাকত। এক মৃর্হুতের জন্যও ছাড়ত না। ফেরার সময় হাতভর্তি নানান খাবার-দাবার নিয়ে ফিরত। সেই মানুষটা এখন কেবলই স্মৃতি ভাবতেই কেমন জানি অবাক লাগে। এসব আর আজকাল ভাবে না আনিস। ভেবে কিছু হয় না শুধু শুধু দুঃখ বাড়ে।

আনিসের কাছে ঘড়ি নেই। সময়টা জানা দরকার। ক্ষিধেয় তার চোখে ঘুম চলে আসছে কিন্তু এখনো মজনুর খবর নেই। হোটেলটা আনিসের চেনাই আছে। দেখেশুনে সে নিজেই চলে যেতে পারবে কিন্তু সমস্যা হল তার কাছে হোটেলে খাওয়ার মতো কোন টাকা নেই। টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি খেয়ে আনিস খাটের উপর বসল। পানিটা গত রাতের, বাসি হয়েছে। আনিসের বমি আসতে লাগল। অনেক সময় খুব বেশি ক্ষিধে পেলে ওর এমন হয়। এমন সময় দরজা দিয়ে মজনু ঢুকল। হাতে ঢাকনা দিয়ে ঢাকা একটা প্লেট।

আনিসের চোখ চকচক করে উঠল, তবে সাবধানে সেটা মজনুর থেকে আড়াল করলো। মজনু হাতের প্লেটটা খাটের উপর রাখে। তারপর টেবিলে রাখা জগটা নিয়ে পানি আনতে দ্রুত বের হয়ে যায়। বাইরে থেকে টিউবয়েল চাপার শব্দ আসছে। খাবার প্লেটটা সামনে নিয়ে মজনু অসহায়ের মতো বসে থাকে! কি করবে বুঝতে পারছে না!

পানি নিয়ে এসে মজনু গ্লাসে ঢেলে আনিসের দিকে এগিয়ে দেয়,নেন ভাইজান! হাত ধুইয়্যা নেন। আনিস যন্ত্রের মতো গ্লাসটা হাতে নিয়ে জানালাটার দিকে যায়। তারপর হাত ধুয়ে এসে ভাতে হাত দেয়।

সকালে এট্টু বাজারে গেছিলাম, তাই ভাত আনতে দেরি অয়া গেল!

না, না সমস্যা নাই। আমি একটু বেলা করেই খাই।

অ অ। আমিতো মনে করছি, দেরি কইরা ফালাইলাম কিনা! আমি অহন যাইগ্যা, বাড়িতে এট্টু কাজ আছে। আপনে খাইয়্যা থালি-বাটি রাইহ্যা দিয়েন। দুফুরের টাইমে আসমুনে।

আচ্ছা।

আনিসের প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। হাতি-ঘোড়া টাইপের ক্ষুধা। কিন্তু এতোক্ষন সামনে মজনু থাকার কারণে ভালভাবে খেতে পারেনি। মজনু চলে যাবার পর আনিস এখন রাক্ষসের মতো খাচ্ছে। মাছের তরকারিটা মারাত্মক ঝাল হয়েছে। লালা এসে আনিসের জিভ ভারী হয়ে যাচ্ছে। পানি খেয়েও কাজ হচ্ছে না। খাবারটা তাড়াতাড়ি শেষ করে আনিস জিভটা বাইরে বের করে বসে রইল। এ অবস্থায় তাকে কেউ দেখলে বিচ্ছিরি কান্ড হয়ে যাবে।

একটু ঝিরিয়ে নিয়ে আনিস বাইরে বের হয়। বিল্ডিংটায় মনে হয় তেমন লোক নেই,থাকলে সে দেখত। আজকেও সেই লোকটা চেয়ার পেতে বসে আছে। খালি গা। লোকটাকে দেখে আনিস কোন কারন ছাড়াই অস্বস্তি বোধ করে। হয়তো চোহারার মধ্যেই কোন বিচিত্র কিছু আছে, ও ধরতে পারছে না। আনিস লোকটার পাশ দিয়েই হেটে গেল। লোকটা কিছু বলল না। মাথা উঁচু করে একবার দেখে আবার যে দিকে তাকিয়ে ছিল ওভাবেই রইল। গলিটা বরাবর ফাঁকা। কোন লোক নেই। গলি থেকে বের আনিস মেইন রোডের ফুটপাতে এসে দাঁড়ায়। রাস্তায় দু’একটা রিক্সা ছাড়া তেমন গাড়ি নেই। মানুষ-জনের যাতায়াতও তেমন নেই।

এলাকাটা মনে হয় শহরের বাইরে হবে। মফস্বলের গন্ধ আছে। আনিস ফুটপাত ধরে সামনে হাঁটে। রাস্তার পাশে স্তুপ করে ময়লা রাখা । কটু গন্ধ আসছে ওখান থেকে । কয়েকটা কুকুর সেখানে খুঁজছে। রোদটা হঠাৎ করে নেমে গিয়ে গুমোট গরম চলে এসেছে। গরম ধুলো উড়ে এসে আনিসের চোখে-মুখে লাগছে। হেঁটে অনেকখানি চলে এসেছে ও। ফেরা দরকার, তাছাড়া মনে হয় বৃষ্টি হবে। বাতাসটাও থেমে গেছে। পরিবেশটা একটা গুমোট ভাব ধরে আছে,আর্শ্চয রকম শান্ত হয়ে। গলির মুখে পৌঁছানোর আকাশ কালো হয়ে গেল। কাকের ডানার মতো কুঁচকুঁচে কালো। ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। আনিসের গা জুড়িয়ে আসছে।

বিল্ডিংটার সামনে ফাঁকা, তখনকার লোকটা আর নেই। বিল্ডিংয়ের ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।

ইলেকট্রিসিটি নেই মনে হচ্ছে। আনিস আন্দাজে দেয়াল হাতরে হাতরে এগোতে থাকে। সামনে কোন একটা ঘর থেকে ক্ষীণ আলো আসছে। আনিস সেদিকে এগিয়ে যায়। ঘরের ভিতরে মোম জ্বালিয়ে মজনু বসে আছে। বাতাসে মোমের আলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। আনিসকে দেখে মজনু উঠে দাঁড়ায়। জোর বৃষ্টি অইব মনে অয়?

হুম। ঘুরতে গেছিলেন নাকি ভাইসাব?

না, মানে একটু বাইরে দেখে আসলাম।

আলাপচারিতায় সুবিধা করেতে না পেরে মজনু উঠে পড়ে। মোমটা টেবিলের উপর রাখে। তারপর যতগুলো সম্ভব দাঁত বের করে একটা বিস্তৃত হাসি দিয়ে চলে যায়। আনিসের বিরক্ত লাগে। শুয়ে-বসে থাকতে আর কতক্ষন ভাল লাগে। বাইরে প্রচন্ড শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টিও শুরু হয়েছে সমান তালে। বৃষ্টি আর বাতাসের মাতামাতিতে সাঁ-সাঁ করে অদ্ভুদ ধরনের শব্দ হচ্ছে। আনিস জানালাটার কাছে এসে দাঁড়ায়। জানালায় ঝুলানো চটটা ভিজে জবজব করছে। টান দিয়ে চটটা সরিয়ে দেয় আনিস।

বৃষ্টির ঠান্ডা পানি এসে আনিসের চোখে-মুখে লাগছে। বিদুৎের আলোয় মাঝে মাঝে সবকিছু আলোকিত হয়ে উঠছে। তখন নীলচে দেখাচ্ছে সবকিছু। জানালাটা ধরে আনিস সেটা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছে । রফিক ফিরল অনেক রাতে। একেবারে কাক ভেজা হয়ে। তখনও বৃষ্টি পড়ছে কিন্তু সকালের মতো অতোটা জোরেসোরে না। ওর হাতে কিসের যেন একটা প্যাকেট, মনে হয় খাবারের। সুন্দর ঘ্রান আসছে। হাতের প্যাকেটটা বিছনার উপর রেখে রাফিক ভেজা জামা ছাড়তে লাগল। খাবারের গন্ধ এসে আনিসের নাকে ধাক্কা দিচ্ছে। ক্ষুধায় পেটের মধ্যে নাড়িভুড়ি পাক দিয়ে উঠছে। কিন্তু আনিস চুপচাপ বসে আছে। রফিক কিছু না বলাতে সেও খেতে পারছে না। দোটানায় পড়ে আনিস উসখুস করছে।

হয়তো আনিস কে উসখুস করতে দেখেই রফিক বলল, কিরে বসে আছিস কেন? খা!

তুই খাবি না।

না, আমি খেয়ে এসেছি।

অ ও ও।

আনিস প্যাকেটটা কাছে টেনে নিয়ে খুলে ফেলে। ভিতরে একটা মোটা কাগজের বাক্স। বাক্সের ঢাকনাটা তুলতেই মাংসের সুন্দর একটা গন্ধ ভেসে আসল। ভিতরে মাংস বিরিয়ানী। একটা সিদ্ধ ডিমও আছে। উপরে গাজর-শসার সালাদ সুন্দর করে সাজানো। আনিস প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে বাক্সের উপর।

অনেকদিন পর ও খুব তুপ্তি করে খেল। খাওয়ার পর এমনিতেই আনিসের মন অসম্ভব রকম ভাল হয়ে গেল। মানুষ হয়ে জন্মানোর এই এক সুবিধা এরা অল্পতেই অভিভূত হয়ে যায়। রাতে রফিকের জ্বর আসল।

এলেবেলে ধরনের জ্বর না। গা প্রচন্ড গরম হয়ে গেল সেই সাথে শুরু হল বমি। অল্প সময়ের মধ্যেই একেবারে বিছানায় শুইয়ে দিল। আনিস পড়ে গেল বিপাকে। ডাক্তার ডাকবে সে উপায়ও নেই। এখানে কাউকে সে চেনেও না তার উপর কাছে নেই টাকা। কি এক বিচ্ছিরি অবস্থা! অনেকক্ষন জলপট্টি দেয়ার পর জ্বর একটু কমল কিন্তু বমি আগের মতোই। কারোরই তেমন ঘুম হলো না, সারারাত রফিক শুধু বিছানায় এপাশ ওপাশ করল।

সকালে মজনুর ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গল। রফিকেরও ঘুম ভেঙ্গেছে। চোখ পাকা মরিচের মতো টকটকে লাল। এক রাতেই মুখ আরও অনেকখানি শুকিয়ে গেছে। আনিসেরও মাথাটা ভারী হয়ে আছে। রাতে তেমন ঘুম হয়নি। গোসল করলে মনে হয় ভাল লাগবে। ও গামছাটা নিয়ে গোসলখানার দিকে যায়। গোসল সেরে এসে দেখে রফিকও জামাকাপড় পড়ছে।

কিরে, আজ কাজে না গেলে হয় না?

নাহ! অনেক কাজ পড়ে আছে। তাছাড়া এখন অনেকটা ভাল বোধ করছি।

ও ও তোকে তো বলাই হয়নি, আমার সাথে তোকে আজ যেতে হবে?

এখনি!

হ্যাঁ। রাতে বলবো কিন্তু মনেই ছিল না। একটা কাজের ব্যাপারে কথা বলে এসেছি।

ও আচ্ছা।

খেয়েদেয় রফিক আর আনিস দু’জনে বেরিয়ে পড়ে। আজকের আবহাওয়াটা সুন্দর। একদম ঝকঝকে পরিস্কার। গত রাতে বৃষ্টি হয়েছে, রাস্তায় জায়গায় জায়গায় পানি জমে আছে। রফিক একটা রিকশা নিল। আনিসের অস্বস্তি লাগছে, সেই সাথে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। হাজার হোক নতুন কাজে যাচ্ছে! কি কাজ? জেনেছিস কিছু? হুম! হোটেলে।! দেখাশুনা করাব, হিসাব-টিসাব রাখবি,পারবি না। সকাল আর দুপুরের খাওয়া ওরাই দেবে। জানিসই তো, এই হিসাব-কিতাব আমার কাছে প্যাঁচের লাগে! আরে গাধা কয়েকদিন গেলে অভ্যাস হয়ে যাবে, তাছাড়া তুইতো আর ওখানে একা না। আরও লোক থাকবে। রিকশাটা একটা মোড়ে থামাল। রফিক ভাড়া মিটিয়ে আনিসকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। রাস্তার পাশে সারি সারি দোকান। ওরা দোকানগুলোর সামনে দিয়ে যাচ্ছে।

রফিক রাস্তার পাশেই একটা দোকানে ঢুকল। আনিসও ওর পিছনে ঢুকল। এটাই হবে মনে হয়। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই,এটা হোটেল। দোকানের সামনে আড়াআড়ি কাপড় টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। রোদ আর ধুলো আটকানোর জন্য। হোটেলটা তেমন বড় না। সরু লম্বা লম্বি একটা ঘর। সামনে একটা ছোট এলপ্যার্টানের টেবিল নিয়ে মালিক বসে। ভিতরে কযেকটা সস্তা টেবিল চেয়ার বসানো। পিছনের জায়গাটুকু হোটেলের রান্নাবান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়। আনিস ছাড়াও আরও দুজন কর্মচারী আছে। আনিসকে রেখে রফিক চলে গেল। অবশ্য যাবার আগে মালিকের সাথে কথা বলে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে গেছে।

রফিককে যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। রফিকের মধ্যে একটা অভিবাবক টাইপ ভাব চলে এসেছে। বয়সের কারণে কিনা কে জানে? ছোটবেলাতো একদম ভ্যাবদা মার্কা ছিল। আগে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে মুখ খুলতো না। লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকতো। সেই মানুষটার আজ কতোটা পরিবর্তন। সময় মানুষকে কোথায় না নিয়ে যায়!

আনিস শার্টের কলারে মুছে ফেলল চোখ দুটো। চোখের অশ্রুর মূল্য পৃথিবীতে নেই। বেঁচে থাকতে হলে এখানে অভিনয় করে যেতে হয়, ভালো থাকার অভিনয়। কষ্টগুলো চেপে রেখে হাসিমুখের অভিনয়।

রাতে রফিক মনে হয় একটু তাড়াতাড়িই ফিরল। আনিস ভাত আনার জন্য রান্নাঘরে গিয়েছিল, এসে দেখে মালিকের সাথে ফিসফাস করে কথা বলছে। ওকে দেখে থেমে গেল। কখন আসলি? এইতো মাত্রই, হাতের কাজ শেষ কর। প্রথমদিনতো চল আজ একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়ি। ঠিক মতোতো সন্ধ্যাই হলো না। হোটেলের মালিক বলল,যাও না। ঢাকায় নতুন এসেছে, একটু ঘুরেটুরে দেখো। কাজতো করতেই হবে।

আনিস মালিকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। তারপর সামনের টেবিলের উপর ভাতের গামলাটা রেখে বাইরে বের হল। রফিকও আসল পিছনে । আকাশ বেশ পরিস্কার। তাকিয়ে থাকলে মনে হয়,আকাশের তারগুলো বিস্ময় নিয়ে পৃথিবীর দিকে চেয়ে আছে।

চল আজ কোথাও থেকে বেরিয়ে আসি। মাথা খারাপ, এই রাতের বেলা কই যাবি। দূরে না, এই কাছে পিঠে কোথাও। তাছাড়া আসার পর তো কোথাও যাসনি। তাই বলে এখন। আনিস মৃদু আপত্তি জানালেও রফিকের জোরাজুরির কাছে সেটা টিকল না। রফিক ওকে নিয়ে হাঁটতে লাগল। সকালে যে পথে এসেছিল ঠিক তার উল্টো পথে। এ রাস্তায় দোকান-পাট নেই। আবাসিক এরিয়া। রাস্তায় দু’পাশে বাড়িগুলো অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ওরা হাঁটছে। সোজা। কোন সাড়াশব্দ নেই। রাস্তাজুড়ে শুধু ওদের পায়ের শব্দ।

প্রায় মিনিট দশেক হাঁটার ওরা পর একটা ফাঁকা জাযগায় আসল। সামনে নদী। মাথার উপর থালার মতো বিশাল একটা চাঁদ। চাঁদের আলো পড়ে ঝিকমিক করছে নদীর পানি। অন্ধকারে কালো ছায়ার মতো যাতায়াত করছে নৌকাগুলো। নৌকাগুলোকে স্পষ্ট দেখা না গেলেও ছইয়ে ঝুলানো হ্যারিকেন গুলোকে বেশ বোঝা যাচ্ছে। ঢেউয়ের তালে তালে হ্যারিকেনের আলো দোল খাচ্ছে। একটা দুটা না, অসংখ্য নৌকা যাচ্ছে আলো নিয়ে। অদ্ভুদ সুন্দর দৃশ্য। পুরো নদী চলছে দোল খাওয়া হ্যারিকেনের আলোর খেলা।সুন্দর দৃশ্যগুলো বেশিক্ষন দেখা যায় না, অসস্থি লাগে । চোখ ফিরিয়ে নিল আনিস।

পাশেই ফেলে রাখা একটা ব্লকে বসে পড়েছে রফিক। জায়গাটা সুন্দর।

শুধু সুন্দর না, মারাত্মক সুন্দর। প্রায়ই আসিস নাকি?

না, প্রথম দিকে খুব আসতাম। এখন আর তেমন আসা হয় না।

আনিস বেশ কয়েকদিন তো হল এসেছিস, বাড়িতে কোন খোঁজ খবর নিয়েছিস।

কেন? কি হয়েছে বাড়িতে। উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ে আনিসের কন্ঠে।

আরে ভয় পাচ্ছিস কেন! তোর মা খবর দিয়েছিল তার শরীরটা নাকি হঠাৎ খারাপ করেছে। যা না, ঘুরে আয় একবার। চাকরিতো এখন ঠিক হয়ে গেছে। কার কাছে শুনলি? চিঠি পাঠিয়েছিল। সকালে বাসায় দিয়ে গেছ, তুই ছিলি না। আমি হোটেলে বলে এসেছি, ওদিকে সমস্যা নেই। সব ব্যবস্থা করে দিব,কাল সকালে রওনা হয়ে যা। উঠে দাড়াঁয় রফিক,চল যাওয়া যাক। অনেকক্ষণ হল এসেছি। আনিসও রফিককে যন্ত্রের মতো অনুসরন করে। পরিবেশটা এখন আর আগের মতো ভাল লাগছে না। কোথায় যেন সুরটা কেটে গেছে। বিচিত্র দুঃচিন্তাগুলো বারবার ভিড় করছে। সারারাত আনিসের ঘুম হলো ছাড়াছাড়া ভাবে। খুব সকালে বিছানা ছাড়ল, একেবারে অন্ধকার থাকতে থাকতে। গোসল সেরে কাপড়-চোপড় গুছিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে রইল। রফিকও আজ সকাল সকাল উঠে পড়েছে। সকালে আর ওদের মধ্যে তেমন কথা হলো না।

বাসস্ট্যান্ডে আসল বেলা থাকতেই। দোকান-পাঠ কিছু খুলেছে আর কিছু খুলি খুলি করছে। লোকজন কম। বাসেও তেমন ভিড় হলো না। বাসের জানালায় হাত বাড়িয়ে রফিক হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিল। রাখ, খরচ করিস। আর কাজ সেরে তাড়াতাড়িই ফিরিস।

রফিকের হাত শক্ত করে ধরে বলে আনিস, বাড়িতে কি হয়েছে বলতো?

কি হবে পাগল?

রফিকের গলাটা ভারী শোনালো।

বাস ছেড়ে দিচ্ছে। নেমে যাচ্ছে রফিক। দ্রুত চোখ ঘসছে। চোখের জলটা হয়তো সাবধানে আড়াল করে ফেলল ও। বাসের গতি বাড়ছে। একটু একটু করে আড়াল হয়ে যাচ্ছে রফিক। স্থির হয়ে বসে আছে আনিস।

বাসের জানালা দিয়ে দুরন্ত বাতাসগুলো ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এলোমেলো করে দিচ্ছে ভেতরের মানুষগুলোকে। কষ্টের অনুভূতিগুলো জমে কেমনজানি ভারী হয়ে যাচ্ছে বুক। ভিজে যাচ্ছে চোখদুটো। আনিস শার্টের কলারে মুছে ফেলল চোখ দুটো। চোখের অশ্রুর মূল্য পৃথিবীতে নেই। বেঁচে থাকতে হলে এখানে অভিনয় করে যেতে হয়, ভালো থাকার অভিনয়। কষ্টগুলো চেপে রেখে হাসিমুখের অভিনয়।

জেএম

 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ