হিমেল হক
বাস থামতেই গরমের একটা হলকা এসে ধাক্কা দিল আনিসকে। এতক্ষণ গায়ে বাতাস লাগার কারনে গরমটা তেমন বোঝা যায়নি কিন্তু এখন উত্তাপটা বেশ ভালোই টের পাওয়া যাচ্ছে। সামনের দিক থেকে লোকজন নেমে যাচ্ছে, আনিসও তার ব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় নামার জন্য। বাসের সিট ধরে ধরে গেটের দিকে এগিয়ে যায়।
আনিস এই প্রথম কোন বড় শহরে এলো। বছরখানেক আগে ইন্টার পাশ করে বসে আছে। গ্রামে থাকতে অবশ্য সবাই পড়ার জন্য বেশ চাপ দিচ্ছিল কিন্তু আনিস আর ও ঝামেলায় জড়ায়নি। আনিসের ছোটবেলার বন্ধু রফিক অনেকদিন ধরেই শহরে থাকে। সেই মেট্রিকের টেস্টে ফেল করে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল, সেই আসাতেই আসা। তার প্রায় বছরখানেক পর অবশ্য বাড়ি ফিরেছিল কিন্তু আর হয়তো মন টেকাতে পারে নি। রফিক এখন ঢাকাতেই থাকে, বছরে দুএকবার বাড়িতে যায়। আনিস ঢাকা এসেছে রফিকের কাছে। বেড়ানোর জন্য না,একেবারে পাকাপাকিভাবে থাকার জন্য। আসার আগে অবশ্য সে রফিকের ঠিকানা যোগাড় করেছে । কিন্তু তার আসার খবর রফিকে না জানানোটা বোকামি হয়ে গেছে। এখন এই ঠিকানা খুঁজে বের করাই মুশকিল হয়ে যাবে। বাস থেকে নেমে রাস্তার পাশে অনেকক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রোদের ঝাঁঝে চুলের মধ্যে থেকে কিছু ঘামের চিকন ধারা নিচে নেমে গেছে। একটু ঠাণ্ডা বাতাসের জন্য শার্টের বোতাম ঝাকাচ্ছে ও। কোথাও বাতাস নেই, কংক্রিটের জঞ্জালগুলো আটকে দিচ্ছে সব যেমন করে আটকে দিয়েছে আকাশটা।
আনিস এখন মোটামুটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে আছে।রিক্সাওয়ালারা বেশ খানিকক্ষণ তাকে নিয়ে টানাটনানি করার পর ফাঁকা মাল বুঝতে পেরে চলে গেছে। ঠিকানা লেখা কাগজটা হাতে নিয়ে সে একটা রিক্সার কাছে এগিয়ে যায়। আনিস কাগজটা রিক্সাওয়ালার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এই ঠিকানায় যেতে পারবেন?
পারমু।
কত টাকা ভাড়া?
দিয়েন ৩০ টাকা।
কথা না বাড়িয়ে আনিস রিক্সায় ওঠে। রিকশায় ওঠার সময় সে পকেটে হাত দিয়ে টাকার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নেয়। বাড়ি থেকে তার জমানো ৪০০ টাকা নিয়ে বেরিয়েছিল। তার মা অবশ্য তাকে আরও কিছু টাকা দিতে চেয়েছিল কিন্তু ও নেয় নি। কিভাবে নেবে, তার এখন আয়-রোজগার করে বাড়িতে টাকা দেবার কথা উল্টো তাকে মায়ের কাছ থেকে নিতে হচ্ছে! লজ্জার ব্যাপার না?
রিকশাটা তাকে একটা ঘুপচি গলির সামনে নামিয়ে দিয়ে যায়। রিকশা থেকে নেমে ও গলির মধ্যে এগিয়ে যায়। গলিটা চাপা। দুজন মানুষ একসাথে যাওয়া মুশকিল। গলির সাথে লাগোয়া বাড়িগুলোর দেওয়ালের রং শ্যওলা পড়ে কালচে সবুজ বর্ণ ধারন করেছে। মাথার উপর দিয়ে ইলেকট্রিক লাইন আর ডিশের তারগুলো এলোভাবে টানানো। গলির শেষ মাথায় একতলা একটা বাড়ি। বাড়ি বলতে অতি কষ্টে দাঁড়িয়ে থাকা ইট-সুরকির কংকাল। সামনে কাঠের কয়েকটা চেয়ারে কিছু লোক বসে আছে। আনিস সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। সামনের চেয়োরে বসা লোকটা ওর দিকে তাকায়, চোখের দৃষ্টিটা কটু। বিরক্তিতে ভরতি।
আনিস দ্রুত কাগজটা এগিয়ে দিয়ে রফিকের কথা জিজ্ঞেস করে। লোকটা হাত বাড়িয়ে কাগজটা নেয়। আনিসের প্রশ্ন শুনে লোকগুলো এমনভাবে তাকায় যেন কথাটা জিজ্ঞেস করা ওর চরম অপরাধ হয়ে গেছে। কাগজটা ফিরিয়ে দিতে দিতে লোকটা আনিসকে উপর-নিচ কয়েকবার দেখে । তারপর গলায় ঝোলানো খিলানটা দিয়ে বিশ্রীভাবে দাঁত খিলান করতে করতে জিজ্ঞেস করে, রফিক কী লাগে? তারপর জিহ্বা নাড়িয়ে কয়েকদলা থুথু ফেলে মাটিতে। আনিসের পায়ের কাছে এসে পড়ে খানিকটা। আনিস কাঁধের ব্যাগটা ঝাঁকি দিয়ে ভালভাবে ঝুলিয়ে নিয়ে বলে, বন্ধু। এক গ্রামে বাড়ি। লোকাটা আনিসের পায়ের সামনে আবার মাটিতে কয়েক দলা থুথু ফেলে বলে, অঅওও। আনিস সাবধানে একবার নিচ দিক তাকিয়ে পা’টা সরিয়ে নেয়। খিলানিটা বুকের কাছটায় ফেলে দিয়ে পিছনে ঘুরে ডাক দেয় লোকটা, মইজন্য! বাইরে আয়।
সাথে সাথে ভিতর থেকে বেটে কালো একটা লোক বেরিয়ে আসে। অতিদ্রুত, যেন দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিল ডাকের অপেক্ষায়। লোকটা আনিসের দিকে তাকিয়ে বলে, হ্যারে রফিকের ঘরে নিয়া যা। বেটে লোকটা আনিসকে সামনের দিকে ইশারা করে বলে, আসেন। বিল্ডিংটার ভেতরে নিয়ে যায়। বিল্ডিংয়ের ভেতরে আলো কম। ঘরের কোনায় কোনায় অন্ধকার জমে আছে। আনিসের চোখ সয়ে আসতে সময় লাগে। একটু এগিয়ে একটা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় লোকটা তারপর লুঙ্গির কোঁচড়ে গোঁজা চাবি বের করে দরজাটা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। আনিসও ওর পিছনে ঘরে ঢোকে।
ঘরের ভেতরটা আরো অন্ধকার। দীর্ঘদিন ঘর বন্ধ থাকলে যেমন ভ্যাপসা গন্ধ বের হয় তেমন গন্ধ আসছে। ঘরের উওর দিকে একটা ভাঙ্গা জানালা। সেটাতে চট ঝোলানো । মজনু গিয়ে চটটা সরিয়ে দেয়,বাইরের কড়া রোদ ঘরের ভিতর প্রবেশ করে। আনিসের শরীর গরমে চিরচির করতে থাকে। মজনু কোথায় যেন হাত দিয়ে সুইচ টিপে দেয়। মাথার উপর ক্যারক্যার শব্দে অলস ভঙ্গিতে একটা ময়লাধরা ফ্যান ঘুরতে থাকে। আনিসের কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়, ঘরটায় হয়তো কোন মন খারাপ করা ব্যপার আছে। দরজার সামনে গিয়ে আনিসের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে মজনু বলে, আপনে আরাম করেন। রফিক ভাই আইসা পড়বো। মজনু চলে যাওয়ার পর আনিস তার ব্যাগটা নীচে রেখে খাটের উপর বসে। খাটটা পুরনো হলেও বিছানার চাঁদরটা সুন্দর করে বিছানো। একদম টানটান,যেটা এ বাড়ির পরিবেশের সাথে একেবারেই যায় না। গরমে গায়ের জামাটা ভিজে যাচ্ছে। মাথার উপওে অতিকষ্টে ঘুরে চলা ফ্যানটা যেটুকু বাতাস দিচ্ছে তার সবটাই আগুনের মতো। অসহ্য লাগছে। চোখে মুখে একটু পানি লাগালে ভাল হতো কিন্তু এখানে সে পানি পাবে কোথায়।
বসে থাকতে থাকতে আনিসের ঝিমুনি এসে যায়। শুয়ে পড়ে। শুয়ে শুয়ে কত কি মনে হয়। গরমের দুপুরে গ্রামের পুকুরে সাতার কাটার কথা মনে হয়। তার বাবর কথাও মনে হয়,আজ বাবা থাকলে তাকে নিশ্চয়ই এখানে আসতে হতো না। গ্রামেই দাপিয়ে বেড়াতে পারত। বুকে একটা চাপা কষ্ট ভর করে, গলার কাছটায় কি যেন এসে দলা পাঁকিয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে আনিস।
সন্ধ্যার দিকে আনিসের ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ভাঙ্গার পর কেন জানি তার নিজের কাছেই লজ্জা লাগে, কারণটা ও বুঝতে পারে না! হয়তো নতুন একটা জায়গায় এসেই ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু ও চেষ্টা করেও ও ধরতে পারে না ওর লজ্জার কারনটা আসলে কি! এখন গরম অনেকখানি কম। সন্ধ্যা নেমেছে হয়তো খানিক আগে। জানালায় ঝোলানো চটের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। কালো মেঘের নীচে ঢাকা পড়া মন খারাপ করা চাঁদ । তার কিছু আলো এসে আনিসের মুখে লাগছে। দরজায় খুটখাট শব্দ হচ্ছে, আনিস ঘুওে তাকায়। রফিক এসেছে। চলবে..
জেএম
সাহিত্য বিভাগে ছড়া, কবিতা বা গল্প পাঠান এই মেইলে newsourislam24@gmail.com