মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ৭ শাওয়াল ১৪৪৫


তোমরা মসজিদ বন্ধ করতে পারবে, প্রার্থনা নয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

পলাশ রহমান

itali3কুরবানির ঈদের একদিন পরে, অর্থাৎ ১৩ সেপ্টেম্বর রোমের পুলিশ হুট করে একটা মসজিদ বন্ধ করে দেয়। এর একদিন পর আরও একটা এভাবে পরপর তিনটি মসজিদ বন্ধ করে দেয় রোমের পৌর পুলিশ। বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ করে রোম পুলিশের এমন আচরণে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন মসজিদ তিনটির পরিচালনা কমিটি এবং মুসল্লিরা।

তারা আইনি সহায়তার জন্য ছুটে যান ধূমকেতু নামের একটা সংগঠনের কাছে। ওই সংগঠনের আইন উপদেষ্টা নূরে আলম সিদ্দিকী বাচ্চু। তিনি এগিয়ে আসেন আইনি সহায়তা দিতে। বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করে জানতে পারেন রোমের মসজিদ বা নামাজের ঘরগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত শুধু প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিক। জনাব বাচ্চু মসজিদ কমিটিগুলোকে পরামর্শ দেন- শুধু আইনগতভাবে মোকাবিলা করলে হবে না, রাজনৈতিকভাবেও মোকাবিলা করতে হবে। তার পরামর্শমতো বন্ধ করে দেয়া মসজিদগুলোর মুসল্লি এবং মুসলিম অভিবাসীদের নিয়ে কমিটিগুলো আন্দোলনে নেমে পড়ে। তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় অভিবাসী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠন। কয়েকটি বিদেশি সংগঠনও সমর্থন দেয়।

প্রথম প্রতিবাদ হিসেবে তারা ১৬ সেপ্টেম্বর একটা সমাবেশ করেন। মসজিদ বন্ধের তীব্র প্রতিবাদ করেন সেখানে। ঘোষণা করেন, বন্ধ মসজিদগুলো খুলে দিতে হবে, নইলে রাজপথে নামাজ আদায় করা হবে। ঘোষণা মতো পরের শুক্রবার থেকে পরপর তিন জুমার নামাজ তারা আদায় করেন রোমের তিনটি পিয়াচ্ছায় (উন্মুক্ত চত্বর) প্রথম তিন জুমার পরও কোনো সমাধান না আসায় তারা ৪র্থ জুমার নামাজ আদায় করার সিদ্ধান্ত নেন পৃথিবীর সাত আশ্চর্যের অন্যতম নিদর্শন বিখ্যাত কলোসিয়ামে।

ইতালির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গত ২১ অক্টোবর (শুক্রবার) ঐতিহাসিক কলোসিয়ামের উন্মুক্ত চত্বরে জুমার নামাজ আদায় করা হয়। সেখানে প্রায় হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। মাইকে আজান দেয়া হয়। আরবি, ইতালীয় এবং বাংলা এই তিন ভাষায় ইমাম সাহেব খুৎবা পাঠ করেন। মুসল্লিরা আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে কলোসিয়াম চত্বর মুখরিত করে তোলেন। সময় মুসল্লিদের হাতে বিভিন্ন স্লোগান লেখা প্লাকার্ড দেখা যায়। স্লোগানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ‘তোমরা মসজিদ বন্ধ করতে পারবে, কিন্তু প্রার্থনা নয়

আন্দোলন প্রসঙ্গে একদিন জানতে চাইলে ধূমকেতু অ্যাসোসিয়েশনের নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী বাচ্চু বলেন, আমরা বিশ্বাস করি পৃথিবীর সব দেশের সরকাররা তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনকে ব্যবহার করে। রোমেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। সরকার প্রশাসনের মাধ্যমে মোট ২৬টি মসজিদ বন্ধ করে দেয়ার জন্য একটি তালিকা তৈরি করে। প্রথমে তারা ইমারত আইনের ৩৮৩ নং ধারা দেখিয়ে ৩টি মসজিদ বন্ধ করে দেয়। আমরা এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এলে তারা আপাতত বাকি মসজিদগুলো বন্ধ করার কর্যক্রম স্থগিত করেছে।

উল্লেখ্য, রোমে প্রায় লাখ ৩৫ হাজার মুসলামন সম্প্রদায় বসবাস করেন এবং ছোট বড় মিলিয়ে মসজিদ বা নামাজের স্থানের সংখ্যা প্রায় ৫০টি। বসবাসকারী মুসলমানদের প্রায় ৯৮ ভাগই অভিবাসী।

জনাব বাচ্চু বলেন, প্রশাসন ইমারত আইন দেখিয়ে বলেছে, বন্ধ করা মসজিদগুলোর ফিটনেস নেই। পাবলিক প্লেস হিসেবে ব্যবহার করার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। আমরা বলেছি, এই মসজিদগুলো আজ নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, মুসল্লিরা নামাজ আদায় করছেন। এখন তোমরা এগুলো হুট করে বন্ধ করে দিতে পার না। আইনের প্রয়োগ শুরু থেকেই করা উচিত ছিল। এখন তোমরা মাঝপথে এগুলোকে থামিয়ে দিতে পার না।

তিনি বলেন, আইনের প্রতি আমরাও শ্রদ্ধাশীল। সুতরাং মসজিদগুলোকে ইমারত আইনের আওতায় আনতে হলে সময় দিতে হবে। প্রশাসনের উচিত ছিল মসজিদগুলো বন্ধ না করে সময় দেয়া। তারা সময় বেঁধে দিয়ে বলতে পারত- এই সময়ের মধ্যে মসজিদগুলো সংস্কার কর, নয়তো স্থানান্তর কর। কিন্তু তারা তা না করে সরাসরি বন্ধ করে দিয়েছে। যা থেকে প্রমাণ হয় এটা শুধু প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নয়, এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আর তাই আমরা সকল মুসল্লিকে সাথে নিয়ে রাজনৈতিক এবং আইনি, উভয় ভাবে মোকাবিলার চেষ্টা করছি।

itali_mosque

জনাব বাচ্চু বলেন, প্রশাসনের দেখানো ইমারত আইনে যদি মসজিদ বন্ধ করতে হয় তবে গোটা ইতালির প্রায় ১২ মসজিদের সবই বন্ধ করতে হবে। কারণ রোমের সেন্ট্রাল মসজিদ ছাড়া ইতালির অন্য কোনো মসজিদেরমসজিদহিসেবে স্বীকৃতি নেই। অভিবাসী মুসলমানরা তাদের নিজ প্রয়োজনে বিভিন্ন জায়গায় দোকানঘর, গ্যারেজ, গোডাউন ভাড়া নিয়ে সেগুলোকে দীর্ঘদিন যাবৎ মসজিদ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। সুতরাং এগুলো হুট করে বন্ধ করে দেয়া যাবে না। সংস্কারের জন্য সময় দিতে হবে। নইলে আমরা কোথায় যাব? কোথায় গিয়ে আমাদের ধর্ম পালন করব?

উল্লেখ্য, বেশ টি মুসলিমপ্রধান দেশের সহায়তায় রোমে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত হয়ে আসছে, যেটা স্থানীয়দের কাছে সেন্ট্রাল মসজিদ হিসেবে পরিচিত।

জনাব বাচ্চু বলেন, সময় না দিয়ে মসজিদগুলো বন্ধ করে দেয়াকে আমরা দেখছি সরাসরি ধর্মের উপর আঘাত হিসেবে। এতে মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। আমাদের সংখ্যালঘু হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। যা কোনো সভ্য দেশে আশা করা যায় না।

দাবি সম্পর্কে বাচ্চু বলেন, আমাদের দাবির এক নম্বরে রয়েছে- বন্ধ মসজিদগুলো খুলে দিতে হবে। হুটহাট করে কোনো মসজিদ বন্ধ করা যাবে না। গোটা ইতালিতে যতগুলো মসজিদ বা নামাজের ঘর আছে সেগুলোর একটা তালিকা করতে হবে এবং প্রত্যেকটি মসজিদকেমসজিদহিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। আইনগত, ফিটনেসগত কোনো সমস্যা থাকলে তা সংস্কারের জন্য সময় দিতে হবে।

তিনি বক্তব্য, ইতালিতে প্রত্যেক পেশার জন্য একটা ওয়ার্ককোড আছে। অর্থাৎ ওয়ার্ককোডের মাধ্যমে প্রত্যেকটি পেশার আলাদা আলাদা স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সাধারণভাবে বিবেচনা করা হয়- যে কাজের ওয়ার্ককোড নেই, সে কাজের আইনি স্বীকৃতিও নেই। আমরা দাবি করেছি- মসজিদের ইমাম এবং মুয়াজ্জিনের কাজকেকাজহিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। এই কাজের জন্যও একটাওয়ার্ককোডঘোষণা করতে হবে। ওয়ার্ককোড না থাকলে ইমাম মুয়াজ্জিনরা তাদের কাজের স্বীকৃতি পান না। পেশাগত কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না। এমনকি তারা ডকুমেন্টও নবায়ন করতে পারেন না। তাদের ডকুমেন্ট নবায়নের জন্য অন্য কোনো কাজের কন্ট্রাক দেখাতে হয়। যা শুধু অসম্মানজনকই না, তাদের অধিকার খর্ব করার শামিল।

জনাব বাচ্চু বলেন, প্রতিটি শহরে মুসলিম কবরস্থান নির্মাণ করতে হবে। সরকারি বেসরকারি সকল হাসপাতাল ক্লিনিকে মুসলিম শিশুদের জন্য খৎনার ব্যবস্থা করতে হবে। মুসলমানদের ধর্মীয় বড় উৎসব- দুই ঈদে ছুটির আইন করতে হবে। মসজিদে ধর্মীয়ভাবে বিয়ে পড়ানো হলে তার আইনগত স্বীকৃতি দিতে হবে।

পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি বলেন, এর পরে আমরা জুমার নামাজ আদায় করব ইতালির জাতীয় সংসদ এবং ভ্যাটিকানের খোলা চত্বরে। এছাড়া শহরের বিভিন্ন পিয়াচ্ছায় (খোলা চত্বর) পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা হবে। একেক দিন একেক চত্বরে ফজর, জোহর, আছর, মাগরিব এবং এশা। এভাবে আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলতে থাকবে।


আমরা জানি ইতালি একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আর ইউরোপীয় আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আদর্শ হলো- রাষ্ট্র কোনো ধর্ম কায়েমের জন্য আইন করে না। কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে না। রাষ্ট্র তার জনগণের উপর কোনো ধর্ম চাপিয়ে দেয় না। রাষ্ট্রে বসবাসকারী কোনো নাগরিকের ধর্মচর্চায় বাধাও দেয় না। ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয়রা রাষ্ট্রকে গির্জার সর্বগ্রাসী কবল থেকে মুক্ত করেছে। এতে মানুষের ধর্মীয় অধিকারে বাগড়া দেয়া হয়নি, বরং ধর্ম এবং রাষ্ট্রকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। যার ফলে ইউরোপের আধুনিক রাষ্ট্রগুলোয়- রাষ্ট্র কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করে না। কারও ধর্মচর্চায় নাক গলায় না। ইতালিও এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। ইতালীয় সংবিধান রাষ্ট্রে বসবাসকারী সকল নাগরিককে স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা এবং প্রচারের অধিকার দিয়েছে। ইতালীয় গির্জাগুলো স্বায়িত্তশাসনের সুবিধা ভোগ করে। গির্জার উপর রাষ্ট্রের কোনো খবরদারি নেই। এমনকি ইতালীয় পুলিশ ইচ্ছা হলেই গির্জায় প্রবেশ করতে (পেশাগত কারণে) পারে না। এর জন্য গির্জা কর্তৃপক্ষ বা কার্ডিনালদের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয়। সুতরাং একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে এবং

সাংবিধানিকভাবে ইতালিতে বসবাসকারী ১৫ লাখ মুসলমানের ধর্মীয় অধিকারও এই নিয়মের বাইরে যাওয়ার কথা নয়। যদি বাইরে বিবেচনা করা হয় বা মুসলামদের ধর্মচর্চা এবং প্রচারে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয় তবে অভিজ্ঞজনরা মনে করেন, ইতালি এখনও সেই অর্থে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি।

ইতালিতে ক্যাথলিকদের জন্য যদি গির্জা থাকে, মুসলমানদের জন্য মসজিদ থাকবে না কেন? গির্জা যদি স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা এবং প্রচারের অধিকার ভোগ করে মুসলমানদের জন্য সে সুযোগ থাকবে না কেন? শুধু ক্যাথলিক নয়, ইতালিতে খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ছোট ছোট সম্প্রদায়ও তাদের ধর্মচর্চা এবং প্রচারের পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে। যেমন- তেসতিমোনি দি জেওভা বা যিহবার স্বাক্ষী নামের সম্প্রদায়, তারা চরমভাবে ক্যাথলিক বিরোধী হয়েও স্বাধীনভাবে তাদরে ধর্মচর্চা এবং প্রচার করতে পারে। যিহবার স্বাক্ষীরা বাইবেল অনুসরণ করে কিন্তু গির্জা বা ভ্যাটিকান মানে না। তারা ক্যাথলিকদের সর্বোচ্চ ধর্ম নেতা পোপকে মান্য করে না, বরং কড়া ভাষায় সমালোচনা করে। তাদের উপাসনালয় ক্যাথলিকদের গির্জা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের গোরস্তানও আলাদা। ক্ষুদ্র এই সম্প্রদায়ের ধর্মচর্চা এবং প্রচারে তো রাষ্ট্র কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না, সংখ্যালঘু মুসলমানদের বেলায় কেন ব্যতিক্রম ঘটবে? মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য কেন আলাদা গোরস্তান থাকবে না? ক্যাথলিকরা তাদের ধর্মীয় উৎসব বড়দিনে ছুটি ভোগ করে, মুসলমানরা কেন ঈদে ছুটি ভোগ করতে পারবে না? গির্জা শব্দ করে ঘণ্টা বাজায়, মসজিদে কেন শব্দযন্ত্রে আজান দেয়া যাবে না? ক্যাথলিক সম্প্রদায় গির্জায় গিয়ে বিয়ে করতে পারে, মুসলমানরা কেন মসজিদে বিয়ে করতে পারবে না? গির্জার পুরোহিত বিয়ে পড়ালে যদি আইনগত বৈধ হয়, ইমাম পড়ালে বৈধ হবে না কেন? রাষ্ট্র কেন স্বীকৃতি দেবে না? হাসপাতাল ক্লিনিকে মুসলিম শিশুদের জন্য খৎনার ব্যবস্থা থাকবে না কেন? ইমাম মুয়াজ্জিনরা পেশার বৈধতা পাবে না কেন? কেন এদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে?

ইতালিতে গির্জার নিয়ন্ত্রণে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে আলাদা কারিকুলামে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয়। মুসলমানদের জন্য কেন ধর্ম শিক্ষা ব্যবস্থা থাকবে না? কেন ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকবে না? ইতালিতে যত মানুষ চাকরি করে তাদের বেতন থেকে প্রতিমাসে একটা নির্দিষ্ট অংশ ধর্মীয় এবং সামাজিক ফান্ডের জন্য কেটে নেয়া হয়। এক্ষেত্রে ক্যাথলিকরা তাদের ওই অর্থ গির্জার ফান্ডে দিতে পারে। যা গির্জার উন্নয়ন এবং ধর্ম প্রচারের কাজে ব্যয় করা হয়। মুসলমানদের জন্য কেন এই ব্যবস্থা থাকবে না? মুসলমান শ্রমিকরা কেন তাদের ওই অর্থ মসজিদ ফান্ডে দিতে পারবে না? তবে কি ইতালি এখনও আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি? আমরা কথা বিশ্বাস করতে চাই না। আমরা বিশ্বাস করতে চাই ইতালি সকল নাগরিকের ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করতে আরও বেশি উদার হবে।

রাষ্ট্র যদি ধর্মীয় পক্ষপাতমূলক আচরণ করে এতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। আর ক্ষোভ থেকেই মানুষ বিপথগামী হয়। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে। ইচ্ছা করলেই ইতালির সমাজ এবং রাজনীতি থেকে ইসলাম বা মুসলিম সম্প্রদায়কে এখন আর আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং বাস্তবতা মেনে নিয়ে এমন পদক্ষেপ নেয়া দরকার যাতে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ক্ষোভের সৃষ্টি না হয়। বরং প্রত্যেক সম্প্রদায় যেন তার পূর্ণ ধর্মীয় অধিকার নিয়ে সহাবস্থান করতে পারে। তাদের মধ্যে হৃদ্যতা এবং শ্রদ্ধার সম্পর্ক থাকে, রাষ্ট্রের উচিত এমনই পদক্ষেপ গ্রহণ করা।


বর্তমান পৃথিবীর প্রায় সব মানুষ ইতালির কলোসিয়াম সম্পর্কে জানে। বিশ্বজুড়ে এটি রোমের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। এর ইতালীয় নাম কোলোসেও। কলোসিয়াম মূলত একটি অ্যাম্ফি থিয়েটার। রোমান সম্রা ভেসপাসিয়ানের রাজত্বকাল ৭০ থেকে ৭২ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময় এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ৮০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট তিতাসের রাজত্বকালে। এর পূর্ব নাম ছিল ফ্লাভিয়ান নাট্যশালা। ৫০ থেকে ৭০ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতার এই অ্যাম্ফি থিয়েটার বা কলোসিয়াম প্রাচীন রোমান স্থাপনার এক বিস্ময়কর নিদর্শন। এটি মূলত বিনোদনের জন্য নির্মাণ করা হলেও এর সাথে মিশে আছে অনেক করুণ ইতিহাস। যা মানুষের হৃদয়কে নাড়া দেয়। ইউনেস্কো ঘোষিত পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম এই বিস্ময়কর নিদর্শন রোমের সবচেয়ে বড় প্রাচীন রোমান স্থাপনা এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অ্যাম্ফি থিয়েটার। প্রতিদিন সারা দুনিয়া থেকে গড়ে দুই লাখ পর্যটক আসেন এটি পরিদর্শন করতে।

এই কলোসিয়ামের খোলা চত্বরে আজান দেয়া, নামাজ পড়া মোটেও সাধারণ কোনো ঘটনা নয়। বলা যায় এটি আরেকটি বিস্ময়কর ঘটনা, যার জন্ম দিয়েছেন রোমের অভিবাসী বাংলাদেশি মুসল্লিরা। তারা সেখানে বড় শব্দযন্ত্রের মাধ্যমে আজান দিয়ে, নামাজ আদায় করে গোটা দুনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। যা অনেকের কাছে অষ্টম আশ্চর্য ঘটনা বলে মনে হয়েছে।
কলোসিয়ামে নামাজ আদায় করার আইডিয়া কীভাবে এলো? সম্পর্কে নূরে আলম সিদ্দিকী বাচ্চু বলেন, কলোসিয়ামে যাওয়ার আগে আমরা শহরের গুরুত্বপূর্ণ ৩টি পিয়াচ্ছায় নামাজ আদায় করে আমাদের দাবির কথা সরকার এবং প্রশাসনকে জানান দেয়ার চেষ্টা করেছি। প্রশাসন একাধিকবার আমাদের সাথে আলোচনাও করেছে, কিন্তু সন্তোষজনক কোনো সমাধান হয়নি। আমরা আন্দোলনের পরিসর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। আমাদের ন্যায্য আন্দোলনের বার্তা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেয়ার কথা চিন্তা করি। পাশাপাশি মানুষকে দেখাতে চাই ইসলামের আদর্শ। যারা জানে না তাদের কাছে ইসলামি আদর্শের বার্তা পৌঁছাতে চাই। আমরা তাদের দেখাতে চাই, ‘আল্লাহু আকবরবলে মানুষ জবাই করা হয় না। আল্লাহু আকবর কোনো ভীতিকর শব্দ নয়। এই শব্দ উচ্চারণ করে মুসলমানরা সৃষ্টিকর্তার বড়ত্ব, মহত্ত্ব প্রকাশ করে।

উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ের কিছু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে ইউরোপেআল্লাহু আকবরশব্দটা এমনভাবে প্রচার হয়েছে যেন এটা একটা খুব সাংঘাতিক ভীতিকর কোনো শব্দ।

কলোসিয়ামে নামাজ আদায় নিয়ে জনাব বাচ্চু বলেন, আমরা যেদিন কলোসিয়ামে নামাজ আদায় করি ওই দিন রোমে সাধারণ যানবহন ধর্মঘট ছিল। তার পরেও মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন। অনেকেই এসেছেন পায়ে হেঁটে। আশপাশের অনেক শহর থেকে মানুষজন বাস ভাড়া করে এসেছেন। সব মিলিয়ে দারুণ এক সাড়া পড়েছিল। একটা উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। ইতালীয় প্রশাসন আমাদের সার্বিক সহযোগিতা এবং নিরাপত্তা দিয়েছে। কমপক্ষে খানেক বিশ্ববিখ্যাত মিডিয়ার সাংবাদিকরা সরাসরি নামাজ আদায়ের দৃশ্য ধারণ করেছে। ইউরোপীয় সব সংবাদ মাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ আইটেম ছিল, কলোসিয়ামে জুমার নামাজ। সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয় হলো আমরা যা চেয়েছি তা খুব সফলভাবে হয়েছে। কলোসিয়ামের খোলা চত্বরে যখন বড় লাউডস্পিকারে আজান দেয়া হয় তখন হাজার হাজার পর্যটক আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে যায়। তারা কলোসিয়াম রেখে আমাদের দেখতে থাকে। তাদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিল, যারা জীবনে প্রথম দেখেছে, মুসলমানরা কিভাবে নামাজ পড়ে। তাৎক্ষণিকভাবে ফেসবুকের লাইভ ভিডিও এ্যাপ ব্যবহার করে হাজার হাজার পর্যটক নামাজের দৃশ্য ছড়িয়ে দেয় গোটা দুনিয়ায়। আমাদের ধারণা কম করে হলেও ৫০টি দেশের মানুষ ওই সময় সরাসরি আমাদের নামাজ আদায়ের দৃশ্য দেখেছে।

পর্যটকদের মধ্যে দারুণ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। তারা জানার চেষ্টা করেছে আমরা ওখানে কেন জড়ো হয়েছি, কী করছি, ইত্যাদি। আমরাও এই সুযোগটা হাতছাড়া করিনি, তাদের কাছে ইসলামের সঠিক দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছি। আমরা তাদের কাছে ইসলামের উদারতা, ভ্রাতৃত্ববোধ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

ইতালীয়, ইংরেজি এবং বাংলা, এই তিন ভাষায় খুৎবা পাঠ করা হয়েছে, যাতে সবাই আমাদের কথা বুঝতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন ভাষায় ফেস্টুন, প্লাকার্ডও ছিল।

প্রশাসনের সাথে আলোচনা সম্পর্কে বাচ্চু বলেন, কলোসিয়ামে নামাজ পড়ার পর রোমের মেয়রের প্রতিনিধি আমাদের সাথে দেখা করে বলেছেন, তারাও একটা সমাধানের রাস্তা খুঁজছেন। তাছাড়া প্রশাসনের পক্ষ থেকে আপাতত নামাজ পড়ার জন্য আমাদের একটা বড় হলরুমের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, যেখানে প্রতি শুক্রবার আমরা জুমার নামাজ আদায় করতে পারব।

প্রবাসের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে নিজেদের মধ্যে দলাদলি, বিরোধিতা, মতানৈক্য যেন প্রথায় পরিণত হয়েছে। যে কোনো ভালো কাজেও কমপক্ষে একটা গ্রুপ বিরোধিতা করবেই করবে। কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই তারা বিরোধিতা করে। দুনিয়াতে এমন একটা ইস্যু পাওয়া যাবে না যে ইস্যুতে তারা সবার সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে পারে বা ঐকমত্য পোষণ করে। রোমের মুসল্লিদের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। সে বিষয়ে বাচ্চু বলেন, রোমের বাংলাদেশি কমিউনিটির ছোট একটা অংশ বাদে বাকি সব সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগঠন আমাদের এই আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। ছোট যে অংশটা বিরোধিতা করেছে, করছে। আমরা মনে করি তাদের পেছনে রোম প্রশাসনের উসকানি রয়েছে। প্রশাসন চায় আমাদের নিজেদের মধ্যে একটা ভাঙন সৃষ্টি করতে।

লেখক: প্রডিউসার, রেডিও বেইস ইতালি

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ