শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


চাই আদর্শিক ঐক্য দালিলিক মতভিন্নতা এবং চারিত্রিক উদারতা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন

jainul_abedinআমরা তেঁতুলের নাম শুনলেই যেমন রসপ্লাবিত হই, ঐক্য ও একতা শব্দটিও তেমনি আমাদের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে দেয় সাহসের বিদ্যুৎ। একতার শক্তি আর ঐক্যের জয় আমাদের কাছে চেনা মানুষের মতো চেনা এবং দেখা শহরের মতো দেখা। কী পরিবার কী সমাজ কী রাষ্ট্র সবখানেই প্রতিনিয়ত আমরা দেখি ঐক্যের জয়। ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা বিজয়ের পথকে কীভাবে সহজ করে এই মাটিতে আমরা দেখেছি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে। আর দানব ইংরেজদের তাড়াবার জন্য আমাদের পূর্বসূরিগণ হিন্দু ভীরুদেরকে পর্যন্ত টেনে এনে এক মঞ্চে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন তো এই ঐক্যের স্বার্থেই।

সেবারও তাদের মন্ত্র বিফলে যায়নি। বর্বর সাদা ভল্লুকের দল এই ভারতবর্ষ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। প্রমাণ হয়েছে সংগ্রামে বিজয়ে এবং অধিকার প্রতিষ্ঠায় এই মন্ত্র অব্যর্থ। শুধু প্রাপ্ত দগ্ধ অভিজ্ঞতাই নয়। এই মন্ত্র আমাদের শিখিয়েছে কুরআন! এই ধন আমাদের গর্বের ধর্ম ইসলামের অনন্য বৈশিষ্ট্য। ইসলামই আমাদেরকে শক্তি সাহস ও বিজয়ের এই পাটাতনের উপর দাঁড় করিয়েছে অসামান্য যত্ন ও সাধনায়। কুরআন কী চমৎকার করে বলেছে হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় কর এবং তোমরা আত্মসমর্পণকারী না হয়ে কোনোভাবেই মরো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো। তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু আর তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করলেন, ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেলে। তোমরা ছিলে অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তে। আল্লাহ তোমাদেরকে সেখান থেকে রক্ষা করেছেন। এইভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তার নিদর্শনাবলী স্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন যাতে তোমরা সুপথ পেতে পার’ [ আল-ইমরান :১০২-১০৩ ]

ঐক্যের বিপরীত বিবাদ। তাই বিবাদকে প্রত্যাখান করেছে এইভাবে ‘তোমরা আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করবে, নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না। করলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে। তোমরা ধৈর্য ধরো। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। [ আনফাল : ৪৬ ] আল্লাহর দ্বীন এবং প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পথ ও আদর্শ প্রতিভাত হওয়ার পরও যদি কেউ ভিন্ন পথের সৃষ্টি করে তাহলে তার পরিণতি কী হবে এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলে দিয়েছেন, ‘যারা তাদের দ্বীনকে নানা ভাগে ও মতে ভাগ করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোনো দায়িত্ব আপনার উপর নেই। তাদের বিষয় আল্লাহর হাতে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করবেন।’ [ আনফাল : ১৫৯ ] অথচ যারা একতার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অবতীর্ণ হয় আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাদের কী আবেগঘন ভাষায় প্রশংসা করেছেন আল্লাহ! বলেছেন যারা আল্লাহর পথে সংগ্রম করে সারিবদ্ধভাবে সুদৃঢ় প্রাচীরের মতো আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন। [সফ : ৩ ]

সুতরাং ঐক্য ও একতা সরাসরি আল্লাহর আদেশ। ঐক্য ও একতার ফল পরস্পর ভ্রাতৃত্ব! ঐক্য ও একতা সাহস ও শক্তির উৎস। ঐক্য ও একতা বয়ে আনে আল্লাহর ভালোবাসা। ফলে পার্থিব জীবনে অর্জিত হয় সম্মান ও মর্যাদা। শুধু ব্যক্তি সম্মানই নয়। মুসলমানদের পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতি পৃথিবীর সামনে তাদের ধর্মবিশ্বাসকেও করে তুলে উজ্জ্বল মর্যাদাশীল এবং প্রার্থনীয়। যুগে যুগে মুসলমানদের ঐক্য পারস্পরিক সংহতি যেমন তাদেরকে দান করেছে সম্মানজনক জীবন, তেমনি মানবতার ধর্ম ইসলামকে করেছে সদা সম্প্রসারমান এক অপ্রতিরোধ্য জীবনবিশ্বাস। হ্যাঁ, যখনই এই ঐক্যে কোথাও ফাটল ধরেছে সেখানেই সে সময়ের মুসলমানগণ যেমন পতন ও পরাজয়ের শিকার হয়েছেন তেমনি বাধাগ্রস্থ হয়েছে ইসলামের কল্যাণযাত্রা। পরিণামে ইসলামের শীতল ছায়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে অনেক আল্লাহর বান্দা।

দুই
ঐক্য ও একতার এই ফল ও ফসলের কথা সচেতনমাত্রই জানেন। তারা মেনে চলতেও চেষ্টা করেন। তাছাড়া এই যে পৃথিবীব্যাপী বিপ্লব আন্দোলন সংগ্রাম সব কিছুর প্রথমও তো ওই ঐক্যবদ্ধ জনতার শপথ। ঐক্যের আগুন শাণিয়েই তো বিপ্লবকে দাঁড়াতে হয় চূড়ান্ত বিজয়ের শপথে। তবে এখানে আমাদের এবং পৃথিবীর অন্য সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে পার্থক্য হলো আমরা এই ঐকের ফল অধিকার আদায় থেকে সম্মানের বিজয় পর্যন্ত যেমন দুনিয়াতে লাভ করি, তেমন লাভ করি আল্লাহর ভালোবাসা যার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার বেহেশত। ইসলামকে বুকে নিয়ে চলবার এই পুরস্কার অনন্য!

কথা হলো, তারপরও কি আমরা অনৈক্যের মুখোমুখি হই না? হই। বরাবরই হই। আমাদের মধ্যে বিবাদ হয়, পরস্পর বিরোধিতা হয়। কখনো বা সেটা লড়াই ও যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়। হজরত রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, তোমরা দলবদ্ধ থেক। বিচ্ছিন্নতা থেকে সাবধান। কারণ শয়তান থাকে সঙ্গীহীনের সঙ্গে, আর দুইজন থেকে সে দূরে থাকে। যে ব্যক্তি বেহেশতের মধ্যভাগে ঠাঁই চায়, সে যেন মুসলমানদের দলের সঙ্গে থাকে। আর যাকে ভালো কাজ আনন্দিত করে, মন্দ কাজ করে দুঃখিত সেই মুমিন। [তিরমিজি, হাদিস : ২১৬৫] এ বিষয়ে হজরত ইরবাজ ইবনে যারিয়া রা. এর হাদিসটি তো খুবই বিখ্যাত। ওই হাদিসে নবীজি সা. বলেছেন, আমার পর তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে তারা অনেক মতপার্থক্য দেখবে। তখন আমার সুন্নাহ ও আমার হেদায়াতের পথের পথিক খলিফাগণের সুন্নাহকে শক্তভাবে ধারণ করবে। নবউদ্ভাবিত বিষয় থেকে দূরে থাকবে। কারণ, সকল নবউদ্ভাবিত বিষয় বেদআত। আর সকল বেদআতই গোমরাহি। [ মুসনাদে আহমদ : হাদিস ১৭১৪৫ ]

এমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই, সুতরাং তোমরা ভাইদের মধ্যে শান্তি ও সন্ধি স্থাপন করো আর আল্লাহকে ভয় করো যাতে তোমরা করুণপ্রাপ্ত হতে পারো। [ হুজরাত : ১০] আর আগের আয়াতে আরো পরিষ্কার করে বলেছেন, মুমিনদের দুই দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করিয়ে দাও, আর তাদের একদল আপর দলের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করলে তারা আল্লাহর নিদের্শের কাছে ফিরে না আসা পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। যদি তারা ফিরে আসে তাহলে তাদের মধ্যে ন্যায়ের সঙ্গে ফয়সালা করবে এবং সুবিচার করবে। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীকে ভালোবাসেন। [ঐ : ৯]

এই সব আয়াত ও হাদিস একথাই বলে ঐক্য চঞ্চল জীবনের চির কাক্সিক্ষত ছন্দ। এই ছন্দ সংগ্রামে বিজয়ে সর্বত্র কাম্য। তবে জীবনে যেমন ছন্দ থাকে। তেমনি থাকে ছন্দ পতনে। বিজয় থাকে, থাকে পরাজয়। একইভাবে পতন ও পরাজয়ই বপণ করে নতুন বিজয়ের বীজ। তাই জীবনে যেমন ছন্দ আসে তেমনি আসে ছন্দপতন। ছন্দময় সময়ে আমরা যেমন পৃথিবীকে ভরিয়ে দিই খোদার দেয়া সমূহ কল্যাণে। পতনের সময়েও আমরা মুষ্টিবদ্ধ হই ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্নে। আমরাই তো পৃথিবীকে শিখিয়েছি মেঘ দেখতে তুই করিসনে ভয়, আড়াতে তার সূর্য হাসে।

তবে এখানে যে বিষয়টি সবিশেষ স্মরণীয় তা হলো শব্দ দুটি। ইখতিলাফ ও মুখালাফাত। মতভিন্নতা ও বিরোধিতা। এখানে এও স্মরণযোগ্য তর্ক ও আলোচনার বিষয় যদি দ্বীন ও ধর্ম বিষয়ক হয়, আর সেটা যদি কুরআন হাদিস কিংবা ইজমার আলোকে মীমাংসিত হয় তাহলে তো সেখানে না মতভিন্নতার অবকাশ আছে, না মতভিন্নতাকে ছাড় দেয়ার অবকাশ আছে। বরং সে তো সরাসরি আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরোধিতা। এই বিরোধিতাকে নীরবে বরদাশত করবার উপমা আমাদের ইতিহাসে নেই।

হ্যাঁ, দ্বীন ও ইসলাম সংক্রান্ত কুরআন সুন্নাহ ও ইজমার বিচারে মীমাংসিত নয় এমন বিষয়ে মতভিন্নতার অবকাশ আছে এবং যুগে যুগে মতভিন্নতা ও ইখতিলাফ হয়েছে। কোনোকালের মানিত আলেমগণ এর বিরোধিতা করেননি। বরং এই ইখতিলাফ ও মতভিন্নতাকে মেনে চলেছেন। বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কার করি। ইসলামের যেসব বিষয় ১. কুরআন ও সুন্নায় স্পষ্ট কোনো বিধান নেই ২. আছে, তবে অস্পষ্ট এবং ব্যাখ্যাসাপেক্ষ আর ৩. একই বিষয় বর্ণিত দুটি আয়াত বা হাদিস কিংবা আয়াত ও হাদিসে দৃশ্যত বিরোধ রয়েছে যেসব ক্ষেত্রে মুজতাহিত ও যোগ্য আলেমগণের মতভিন্নতা থাকতে পারে। এই মতভিন্নতা দালিলিক যৌক্তিক এবং চলার পথ নির্মাণে আবশ্যিক। উম্মতের চলার পথ সন্ধানে যারা এই সাধনায় অবতীর্ণ হোন তারা আল্লাহ তায়ালার দরবারে হোন পুরস্কৃত। [মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী রহ. ইসলাম মে এখতেলাফ কে উসূল আদাব আওর হুদুদ : ৭৩]

যেহেতু মূলে বিষয়টি কুরআন হাদিসে নেই। অথবা বিষয়টি আছে কিন্তু তার বাস্তবায়ন পদ্ধতি বলা নেই। এই না বলা বিষয়টি যখন আমলের ক্ষেত্রে অনুপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায় তখন যোগ্য প্রাজ্ঞ মুজতাহিদ আলেমগণকে তার সমাধান করতে হয়। একইভাবে কুরআন ও হাদিসে যখন একাধিক অর্থবহ শব্দ ব্যবহার হয় তখন তার অর্থ ও ক্ষেত্র নির্ণয়ে মতবিরোধ হয়। মতবিরোধ হয় দৃশ্যত বিপরীতমুখী বাণীর ক্ষেত্রে সমন্বয় কিংবা প্রাধান্য সাধনে। আর এভাবেই যুগে যুগে একই বিষয়ে নানা মত ও চিন্তার প্রকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। শাণিত হয়েছে ওসব মত চিন্তা। ফলে উম্মতের চলার পথ হয়েছে প্রসারিত। দালিলিক ও যৌক্তিক। এই মতভিন্নতা যেমন খালেস দ্বীনি বিষয়ে হয়েছে, তেমনি হয়েছে মুসলমানদের কল্যাণ ও স্বার্থকেন্দ্রিক সমসাময়িক নানা বিষয়েও। আশার কথা হলো, কোনো কালের কোনো সচেতন শ্রেণিই এই দালিলিক ও যৌক্তির মতভিন্নতাকে মন্দ চোখে দেখেননি। এর বিরোধিতা করেননি। মনে করেননি এটাকে পতন ও ধ্বংসের কারণ।

ইমাম মালেক রহ. কে আমরা চিনি। ইমামু দারিল হিজরাহ পবিত্র মদিনার ইমাম তার উপাধি। মুসলিম ইতিহাসের বরিত শাসক, জ্ঞানে গুণে সাহসিকতায় প্রবাদ পুরুষ বাদশাহ হারুনুর রশিদ একবার ইমাম মালিককে বলেছিলেন আবু আবদুল্লাহ আপনার রচনাবলী কপি করে আমরা ইসলামি পৃথিবীর সকল প্রান্তে পৌঁছে দিই। পুরো উম্মত তখন এর উপর আমল করতে পারবে। উত্তরে ইমাম মালিক রহ. বলেছিলেন আমিরুল মুমিনিন আলেমগণ ইখতিলাফ ও মতভিন্নতা আল্লাহর পক্ষ থেকে এই উম্মতের জন্য রহমত। প্রত্যেকেই তার কাছে যেটা শুদ্ধ বলে প্রতিষ্ঠিত সেটা মেনে চলেছেন এবং সকলেই হেদায়াতের উপর আছেন। আর প্রত্যেকেই আল্লাহর সুন্তুষ্টি প্রত্যাশী। [আজলুনি রহ. কাশফুল খাফা ও মুজিলুল ইলজাম : ১৫৩ নং হাদিস দ্র:]

হজরত ওমর ইবনে আব্দুল আযিয রহ. আমাদের ইতিহাসে হীরকখ-। দ্বিতীয় ওমর তার উপাধি। তিনি বলেছেন যদি নবীজি সা. এর সঙ্গীদের মধ্যে ইখতিলাফ ও মতভিন্নতা না হতো তাহলে আমি আনন্দিত হতাম না। কারণ তাদের মধ্যে মতপাথর্ক্য না হলে আমাদের পথ প্রসারিত হতো না। [আল্লামা সাখাবি রহ. আল মাকাসিদুল হাসানাহ পৃ ৮৭, হাদিস ৩৯] ইখতিলাফ ও মতভিন্নতার একটি চমৎকার গল্প আছে। বাদশাহ মামুনুর রশিদের কাল। এক ব্যক্তি ইসলাম ত্যাগ করে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেছেন। মামুন সেই মুরতাদকে বললেন, বল তো আমাদের ধর্মের কোন বিষয়টি তোমাকে ভীতও বিব্রত করেছে? যদি আমাদের কাছে এর ওষুধ পাও তাহলে চিকিৎসা গ্রহণ করলে, নইলে তুমি মাজুর বলে বিবেচিত হবে। তোমার প্রতি তখন আর তোমার আক্ষেপ থাকবে না। আর আমরা তখন তোমাকে যদি হত্যা করি সেটা একান্ত দ্বীনের বিধান বলেই করবো। তুমিও তখন ধৈর্য ও আস্থায় অবিচল থাকতে পারবে। নিজেকে সান্তনা দিতে পারবে চেষ্টায় আমি ত্রুটি করিনি এবং সতর্কতায়ও অবহেলা করিনি। মুরতাদ লোকটি তখন বলল, আপনাদের বিপুল মতভিন্নতা আমাকে অস্থির ও সন্ত্রস্ত করেছে।

উত্তরে বাদশাহ মামুনুর রশিদ বললেন, আমাদের মধ্যে দুই ধরনের মতভিন্নতা আছে। একটি হলো আজান জানাযার তাকবির তাশাহুদ ঈদের নামাজ, তাকবিরে তাশরিক কিরাতের বিভিন্নতা, ফতোয়ার নানা মত। তো এসব তো সত্যিকার অর্থে কোনো বিবাদ ও মতপার্থক্য নয়। এগুলো তো চলার স্বাধীনতা পথের প্রশস্ততা এবং জীবনের সহজতা। কেউ আজান ও একামত দিয়েছেন দুই দুই শব্দে। যারা দুই শব্দে আজান আর এক এক শব্দে একামত দেন তারা এটাকে ভুল বলেন না। এই নিয়ে তারা পরস্পর লড়াই করেন না, পরস্পর নিন্দা ও ভৎসনাও করেন না।

আরেকটি মতভিন্নতা হলো আমরা মূল কুরআন ও হাদিস মানার ক্ষেত্রে একমত সত্ত্বেও কোনো কোনো আয়াত ও হাদিসের ব্যাখ্যায় আমাদের মতভিন্নতা আছে। আর এটা যদি তোমাকে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষী করে থাকে এবং এ কারণে যদি তুমি কোরআনকে অস্বীকার করে থাক তাহলে তো পূর্ণ তাওরাত ও ইঞ্জিল ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে অতর্কিত ও অবিসংবাদিত হতে হবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এ বিষয়ে যেমন সকলে একমত তার প্রতিটি শব্দের ব্যাখ্যায়ও সকলে একমত হতে হবে। সকল ইহুদি খৃষ্টানের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মতভিন্নতা থাকতে পারবে না।

তাছাড়া তোমাকেও এমন কোনো একটা ভাষা গ্রহণ করতে হবে যার শব্দাবলির ব্যাখ্যায় কোনো মতভিন্নতা নেই। আল্লাহ তায়ালা চাইলে তার সকল কিতাব, সকল নবী রাসুল এবং তাদের উত্তরাধিকারীদের জন্য এমন একটা ভাষা নির্বাচন করতে পারতেন যাতে কোনো ধরনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু দ্বীন দুনিয়ার কোনো ক্ষেত্রেই আমরা সেটা দেখি না। যদি এটা হতো তাহলে সব কষ্ট ও সাধনা উড়ে যেত। থাকত না পরস্পর প্রতিযোগিতা ও পরস্পর ছাড়িয়ে যাওয়ার সংগ্রাম। কিন্তু আল্লাহ তো দুনিয়াটা এভাবে বানাননি। একথা শুনার পর মুরতাদ লোকটি বললো আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। ঈসা আল্লাহর বান্দা হজরত মুহাম্মাদ সা. সত্যবাদি আর আপনি সত্যিই আমিরুল মুমিনিন। [ শায়েখ মুহাম্মদ আওয়ামা, আদাবুল ইখতিলাফ : ২৪-২৫ ]

অবশ্য আমাদের চলতি ইতিহাসের স্বর্ণসন্তান মুফতি মাহমুদ হাসান রহ. বলেছেন, কোনো দল বা অঞ্চলে সকল বিষয়ে ঠিক তখনই সকলের ঐকমত্য থাকতে পারেÑ ১. যদি সেখানে বুদ্ধিমান কোনো লোক না থাকে ২. অথবা সেখানকার সকলেই যদি খেয়ানতকারী এবং আদর্শবঞ্চিত হয়। [ইসলাম মে এখতেলাফ কে উসুল : ৭০]

তিন
শক্তি সম্মান ও ফলবান ইতিহাস নির্মাণের জন্য ঐক্য একতা ও সংহতি চাই। তবে দালিলিক যৌক্তিক মতভিন্নতাও স্বভাবজাত। এই মতভিন্নতা চিন্তাকে সমৃদ্ধ করে আর চলার পথকে করে সরল ও প্রসারিত। সুতরাং মতভিন্নতায় ভীত আতঙ্কিত কিংবা ক্ষুব্ধ হওয়ার কিছু নেই। তবে মতভিন্নতাকে পথপ্রসারের ইতিবাচক পথে কাজে লাগাতে হলে আমাদের আত্মায় ও চেতনায় ধারণ করতে হবে ইসলামের চারিত্রিক উদারতা। মনে রাখতে হবে আমাদের প্রিয়তম নবী সা. স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন ‘...তবে আমি প্রেরিত হয়েছি একনিষ্ঠ উদার দ্বীনসহ’ [মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২২৩৪৫] অন্য বর্ণনায় আছে, হজরত রাসুল সা. বলেছেন আল্লাহ তায়ালার কাছে সর্বাধিক প্রিয় দ্বীন হলো উদার ও একনিষ্ঠ দ্বীন। [ সহিহ বুখারি : বাব-২৮]

অন্য একটি হাদিসে নবীজি বলেছেন, তুমি উদার হও, উদারতা পাবে। [ মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২২৩৩] তাছাড়া আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট করে বলেছেন, সৎকর্ম ও তাকওয়া তোমরা একে অপরকে সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালংঘনে কেউ কাউকে সাহায্য করবে না। [ মাইদা : ২ ] আরো বলেছেন, হে মুমিনগণ কোনো পুরুষ যেন অপর কোনো পুরুষকে উপহাস না করে, কারণ যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারীর চাইতে উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারী যেন অপর কোনো নারীকে উপহাস না করে, কারণ যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারীর চাইতে উত্তম হতে পারে, তোমরা একে অপরকে দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না, ঈমানের পর মন্দ নাম অতি মন্দ। যারা তাওবা করে না তারাই জালেম। [হুজুরাত : ১১]

আর হজরত রাসুল সা. বলেছেন, যারা মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ডাকে, যারা সাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে এবং সাম্প্রদায়িকতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয়। [আবু দাউদ. হাদিস : ৫১২৩] সহজ কথায়, ঐক্য ও সংহতি যেমন ইসলামের দাবি, মতভিন্নতাও ইসলামেই অনুমোদিত। একইভাবে চারিত্রিক সৌজন্যতা, আচরণের উদারতাও ইসলামেরই শিক্ষা। আমরা আমাদের অতীতের দিকে যদি তাকাই তাহলে এটাই দেখি। তারা দ্বীন ও আদর্শের ভিত্তিতে এক হতেন। স্বার্থ কিংবা সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে নয়। তাদের মধ্যে মতভিন্নতা হয়েছে কিন্তু চারিত্রিক সৌজন্যতা ও উদারতা আহত হয়নি। সায়্যিদুনা হজরত আলী ও সায়্যিদুনা হজরত মুয়াবিয়া রা. এর মধ্যে যে মতভিন্নতা হয়েছিল সে কথা কে না জানে। অথচ এই কারণে ঈমানের ভ্রাতৃত্ব এবং আখলাকের উদারতা নিহত কিংবা আহত হয়নি। রোমসম্রাট যখন হজরত আলী রহ. এর বিরুদ্ধে হজরত মুয়াবিয়া রা. কে সাহায্যের অনুমতি চায় ঈমানি দীপ্ততে জ্বলে উঠেন হজরত মুয়াবিয়া রা.। এই বলে গর্জে উঠেন হে খৃষ্টান কুকুর, আমার ও আলীর মতভিন্নতাকে কাজে লাগাতে চাচ্ছো, মনে রেখো তুমি যদি হজরত আলীর দিকে যদি বাঁকা চোখেও তাকাও তাহলে হজরত আলীর পক্ষ হয়ে তোমার চোখ উপড়ে ফেলবে যে প্রথম সৈনিক সেই মুয়াবিয়া। [মুফতি মাহমদ হাসান গাঙ্গুহি রহ. ইসলাম মে ইখতেলাফ : ৭৫]

ইসলামের বিধি বিধান বিষয়ে ইমাম আবু হানিফা রহ. এবং ইমাম শাফিই রহ. এর বিপুল মতভিন্নতার কথা ইসলাম সম্পর্কে সামান্য পড়াশোনা আছে এমন মানুষও জানেন। অথচ এই ইমাম শাফিই রহ. ইমাম আবু হানিফা রহ. এর কবর জিয়ারত করতে এসে ফজর নামাজে দোয়ায়ে কুনুত পড়েননি। শব্দ করে বিসমিল্লাহ পড়েননি। অথচ এটা তার মাজহাব। কারণ জানতে চাইলে বলেছেন, এই কবরবাসীর আদব ও সৌজন্যতার খাতিরে করেছি। [ ঐ : ১০০ ] এ সুবাদে হজরত থানবি ও হজরত মাদানির ঘটনা তো সকলেরই জানা।

বিশেষকরে দ্বীনি জাতীয় কোনো বিশাল জনগোষ্ঠী স্বার্থ ও কল্যাণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যখন আলেমগণের মধ্যে মতভিন্নতা দেখা দেয় তখন আদব সৌজন্যতা ও উদারতা খুবই অপরিহার্য হয়ে উঠে। বিশেষ করে যারা ছোট ও পরকাল সচেতন তাদের জন্য তো অবশ্যই। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, যে আমার কোনো ওলির প্রতি শত্রুতা করল আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম। [ সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬১৩৭]

আর হজরত ইমাম শাফিই রহ. বলেছেন কেয়ামতের দিন ফোকাহা আলেমগণ যদি আল্লাহর বন্ধু না হন, তাহলে তো আল্লাহর কোনো ওলিই নেই। [হাফেজ সাখাবি, আল মাকাসিদ, হাদিস : ২৬৪] কুরআনে একথা যেন আমরা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে না যাই। বলুন তোমাদেরকে কি কর্মবিচারে ব্যর্থজনদের সংবাদ দেব? এই দুনিয়াতে যাদের শ্রম পছন্দ হয়েছে, অথচ তারা ভাবছে তারা খুব উত্তম কর্ম সম্পদন করে চলেছে। [ কাহাফ : ১০৩ ]

এটা সময়ের চরিত্র মাঝে মধ্যে জেদি বালকের মতো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। আর চারদিকে আগুন ছড়াতে থাকে। তখনই পরীক্ষার সময় হয় ঈমান ও আখলাকের। হে আল্লাহ! আমরা এই পরীক্ষায় হারতে চাই না! তুমি আমাদরেকে সাহায্য করো!
ঢাকা ২৭.১০.১৬

সৌজন্যে: রহমানী পয়গাম

এফএফ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ