বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১০ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫


ওদের শরিয়তি বিচার চাই

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

পলাশ রহমান

palashগত ১২ অক্টোবর, পত্রিকায় একটা খবর পড়ে হা হয়ে গেলাম। খুলনার একটি নামকরা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজসহ কয়েকটি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ওষুধের দোকানে প্রশাসন অভিযান চালিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে রোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে চালানো ওই অভিযানে প্রশাসনের সদস্যরা ডা. গাজী মিজানের মেডিকেল কলেজ (সার্জিক্যাল ক্লিনিক) থেকে ২৩ ব্যাগ মেয়াদোত্তীর্ণ রক্ত ও রি-এজেন্টসহ (প্যাথলজি পরীক্ষার কেমিক্যাল) বিপুল পরিমাণে ভেজাল ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পেয়েছে। অভিযানে বেরিয়ে এসেছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরিবর্তে টেকনিশিয়ানদের স্বাক্ষর করা প্যাথলজি রিপোর্ট এবং অকারণে আইসিইউতে রোগীদের আটকে রেখে বেশি টাকা আদায়ের সত্যতা।

অভিযানের একদিন পর বেসরকারি ডাক্তার এবং সংশ্লিষ্টদের সমিতি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ), বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল প্রাকটিশনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমপিএ), বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ও নার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিপিসিডিওএ) এবং বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিসিডিএস) খুলনায় দুই দিনের ধর্মঘট ডাক দেয়। তারা বেসরকারি সকল হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডাক্তারখানা, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ওষুধের দোকান বন্ধ রেখে প্রশাসনের অভিযান এবং পচা রক্ত, ভেজাল ওষুধ উদ্ধারের প্রতিবাদ জানায়।

দুই দিনের ধর্মঘট শেষে অ্যাসোসিয়েশনগুলোর নেতারা একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। মজার ব্যাপার হলো ওই সংবাদ সম্মেলনে তারা প্রশাসনের অভিযানের বিরোধিতা করলেও অভিযানে বেরিয়ে আসা বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণে ডাক্তার নেতারা স্বীকার করতে বাধ্য হন, তারা ডা. মিজানের পক্ষে দালালি করতে আসেননি। তারা বলতে এসেছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত হাসপাতালগুলোয় আরও ব্যাপকহারে রোগীদের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়, কিন্তু সেখানে প্রশাসন কোনো অভিযান চালায় না। কোনো প্রতিকার হয় না। প্রশাসনের অভিযান শুধু প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোয়, কেন? তারা অভিযোগ করে বলেন, ভেজালবিরোধী অভিযানের নামে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ওষুধের দোকানে অভিযান চালিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত যে দণ্ড, জরিমানা দিয়েছে তা ভোক্তা আইন মেনে করা হয়নি।

উল্লেখ্য, গাজী মেডিকেল কলেজে অভিযানের পর প্রশাসন ডা. মিজানসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করে। পরে ১০ লাখ টাকা জরিমানায় তাদের ছেড়ে দেয়। এছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও বিভিন্ন অঙ্কের জরিমানা করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে যখন সাংবাদিকরা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকেন তখন বিএমএ খুলনার সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলম বলেন, গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রশাসনের অভিযানের ব্যাপারে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। সেখানের অনিয়ম দুর্নীতি ডা. মিজানের নিজস্ব ব্যাপার। সংবাদ সম্মেলনে ডা. মিজান নিজেও উপস্থিত ছিলেন। প্রশাসনের অভিযানে পচা রক্ত, ভেজাল ওষুধ, মেয়াদোত্তীর্ণ চিকিৎসা সরঞ্জাম, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং আইসিইউতে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের দণ্ড, জরিমানা তিনি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছেন।

এবার বলি খবরটা পড়ে আমি কেন হা হয়ে গেলাম! কেন আমার শরীরের সব রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। অভিযানের দু’দিন আগে, অর্থাৎ ১০ অক্টোবর আমার মা গিয়েছিলেন গাজী মিজানের ওই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! আমার সত্তরোর্ধ্ব মাকে তারা কী চিকিৎসা দিয়েছে? আমার মাকেও কি তারা ভেজাল ওষুধ, পচা রক্ত, মেয়াদোত্তীর্ণ চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে চিকিৎসা দিয়েছে?অনভিজ্ঞ টেকনিশিয়ানরাই কি আমার মার শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট লিখেছে? অসম্ভব কিছুই না। আমার মার মতো হাজারো মা ওই হাসপাতালে যান চিকিৎসা নিতে। তারা সবাই ওদের দ্বারা প্রতারিত হন। তাদের সবার ওপর নির্দয়ভাবে ওরা ভেজাল ওষুধ, পচা রক্ত প্রয়োগ করে। আইসিইউতে আটকে রেখে বেশি টাকা আদায় করে। অনভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান দিয়ে রিপোর্ট লেখায়। সচেতনভাবেই ওরা অপচিকিৎসা দেয়। আমরা কোথায় যাবো? আমাদের বৃদ্ধ বাবা-মার জন্য, আমাদের জন্য কোথায় পাবো সঠিক চিকিৎসা? আমাদের সবার তো এত টাকা নেই, আমরা সবাই বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারি না। তাহলে কী আমরা, আমাদের বাবা-মা’রা ওদের অপচিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরবে?

বিএমএ খুলনার সভাপতি ডা. বাহারুল বলেছেন, গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রশাসনের অভিযানের ব্যাপারে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। সেখানের অনিয়ম দুর্নীতি ডা. মিজানের নিজস্ব ব্যাপার। তারা ডা. মিজানের পক্ষে দালালি করতে আসেননি। কী অদ্ভুত কথা! তারা ডা. মিজানের পক্ষে দালালি করতে আসেননি, অথচ ধর্মঘট দিয়েছেন। প্রশাসনের অভিযানের ব্যাপারে তাদের কোনো বক্তব্য নেই, অথচ কর্ম বিরতি ডেকেছেন। গাজী মেডিকেল কলেজের দুর্নীতি অনিয়ম যদি ডা. মিজানের নিজস্ব ব্যাপারই হবে তবে তারা কেন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন? কেন তারা সব প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ওষুধের দোকান বন্ধ রেখে লাখ লাখ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলেছেন? কেন মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন? তাদের ধর্মঘটের কারণে যদি কোনো রোগীর জীবনহানি ঘটে এর দায় কে নেবে? নেবেন ডা. বাহারুলরা?

প্রশাসনের অভিযানে পচা রক্ত, ভেজাল ওষুধ, মেয়াদোত্তীর্ণ চিকিৎসা সরঞ্জাম, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং আইসিইউতে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের কথা স্বীকার করে ডা. মিজান বলেছেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের দণ্ড, জরিমানা তিনি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছেন। বাহ, কী চমৎকার কথা! কত সুবোধ ডাক্তার তিনি। আইনের প্রতি কত শ্রদ্ধা তার। অভিযানের পর তার হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করা ভেজাল এবং পচা চিকিৎসা সরঞ্জামসহ সাংবাদিকরা যে ছবি তুলেছে তাতে দেখা যাচ্ছে তিনি দাঁত বের করে হাসছেন। এর অর্থ কী দাঁড়ায়? তিনি মূলত এসব অভিযান থোড়াই কেয়ার করেন। তিনি জানেন ১০ লাখ টাকার জরিমানা তার কাছে কিছুই না। ওই টাকা উসুল করতে তার ১০ জন রোগীরও দরকার হবে না।

এত সাহস ডা. মিজানরা কোথায় পান? কারা তাদের এত সাহস জোগায়? কারা তাদের সাহসের উৎস? মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করার, ব্যবসা করার লাইসেন্স তাদের কারা দিয়ে রেখেছে? এ বিষয়ে আমার ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস লিখেছিলাম। সেটা পড়ে অনেকেই তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তার ওখানের একজন সাবেক কর্মচারী জানিয়েছেন, ডা. মিজানের রাজনৈতিক হাত অনেক লম্বা। শহরের অনেক রাজনীতিকসহ রুই কাতলরা তার ওখানে যায় আড্ডা দিতে। সুতরাং এসব অভিযানে তার কিছুই হবে না, হয় না। হয়তো ওই ১০ লাখ টাকার জরিমানাও দিতে হবে

না।

ডাক্তার নেতারা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত হাসপাতালগুলোয় আরও ব্যাপকহারে রোগীদের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়, কিন্তু সেখানে প্রশাসন কোনো অভিযান চালায় না? প্রশাসনের অভিযান শুধু প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কেন? এ কথার মানে হলো রাষ্ট্রায়ত্ত হাসপাতালে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা চলে তারা তা আগে থেকেই জানেন। তবে এতদিন কেন এসব নিয়ে তারা কথা বললেননি? এসবের বিরুদ্ধে কেন প্রতিবাদ করেননি? এতদিন কেন মুখ খোলেননি? রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি অনিয়ম হয় বলে তাদেরও করতে দিতে হবে? তারাও চিকিৎসার নামে এসব অপকর্ম করার লাইসেন্স চান?  প্রশাসনের অভিযানের পর তারা দুই দিনের ধর্মঘট পালন করেছেন। পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের যুৎসই কোনো উত্তর দিতে না পেরে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের প্রসঙ্গ সামনে এনেছেন। তারা যদি এসব অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদই না করবেন তবে তাদের এত সংগঠনের দরকার কী? ওইসব অ্যাসোসিয়েশনগুলোর কাজ কী? নিজেদের দুর্নীতি অনিয়ম বিনা বাধায় চালু রাখার জন্যই কি তাদের এতগুলো অ্যাসোসিয়েশন? তারা বলেছেন, ভেজালবিরোধী অভিযানের নামে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ওষুধের দোকানে চালানো অভিযান, দণ্ড, জরিমানা  ভোক্তা আইন মেনে করা হয়নি। বাহ! তারা তো দেখি আইনকানুনও জানেন। এত আইন জানেন, এত ভোক্তা অধিকার বোঝেন, অথচ ডা. মিজানের হাসপাতালে পাওয়া ভেজাল ওষুধ, পচা রক্ত, দুর্নীতির ব্যাপারে তাদের কোনো বক্তব্য নেই কেন? ওটা কেন ডা. মিজানের নিজস্ব ব্যাপার হতে যাবে? আমার মনে হয় এমন তাজ্জব কথা বলে, এমন মানবতাবিরোধী কাণ্ড ঘটিয়ে শুধু বাংলাদেশেই পার পাওয়া যায়। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে এমনটা হয় না, হতে পারে না। কোনো সভ্য মানুষ, শিক্ষিত মানুষের দ্বারা এমন কথা, কাজ হতে পারে না। আমি চিন্তাও করতে পারি না, চিকিৎসা পেশার সাথে জড়িত মানুষরা কীভাবে ধর্মঘট, কর্ম বিরতি করতে পারে? কোনো সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের দ্বারা কি এটা করা সম্ভব? কোনো সভ্য দেশে কি এমনটা হয়, হয়েছে কখনো?

আমরা প্রায়ই দেখি ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন খাবারের দোকানে, রেস্টুরেন্টে, কারখানায় অভিযান চালিয়ে গাদা গাদা পচাগলা খাবার উদ্ধার করে। বিষাক্ত কেমিক্যাল উদ্ধার করে। নোংড়া, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আবিষ্কার করে। অথচ তাদের কিছুই হয় না। সামান্য কিছু টাকা জরিমানা দিয়ে তারা পার পেয়ে যায়। এইতো সেদিনও একটা টেলিভিশন রিপোর্টে দেখলাম, ঢাকার একটা রেস্টুরেন্টে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে দেখেছে, ওইরেস্টুরেন্টে বেসিনের পানি দিয়ে (মানুষের হাত-মুখ ধোয়া পানি) থালা বাসন, হাঁড়ি, কড়াই ধোয়া হয়। মানুষ কীভাবে পারে এমন জঘন্য কাজ করতে? বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সামান্য কিছু টাকা জরিমানা করেই প্রশাসন দায় সারে।

আমাদের সরকারদেরও কোনো মাথাব্যথা নেই। থাকবে কী করে? যারা দেশ চালান, চালিয়েছেন তারা তো এদেশে চিকিৎসা নেন না। তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরের ম্যাকডোনালস থেকে রুটি আসে, ফাস্টফুড আসে। তারা কেন এদের বিরুদ্ধে আইন করতে যাবেন, ব্যবস্থা নিতে যাবেন? এমন কী দায় পড়েছে তাদের? আমি নিজেও একজন চিকিৎসকের ছেলে। আমার বৃদ্ধ বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার। একজন চিকিৎসকের ছেলে হিসেবে আমি সত্যিই লজ্জিত, বিক্ষুব্ধ। সব পেশারই একটা দায়বদ্ধতা থাকে, থাকতে হয়। মানবতা, মানবিকতা, মনুষ্যত্ব থাকতে হয়। বিশেষ করে চিকিৎসা, খাদ্য এবং শিক্ষা, এই পেশার মানুষরা যদি পঁচে যায় তবে সেই সমাজ, দেশ টেকে না। সেখানে ভালো কিছু আশা করা যায় না।

এফএফ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ