শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


বেফাকের ওলামা সম্মেলনে দেয়া আল্লামা আহমদ শফী’র লিখিত ভাষণ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

olama_sommelan10নাহমাদুহু ওয়ানুসাল্লী আ’লা রাসূলিহিল কারীম। আম্মা বা’দ-
মুহতারাম ওলামায়ে কেরাম!

সর্বপ্রথম মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি, যিনি আমাদেরকে এই ক্রান্তিকালে মাদারিসে দ্বীনিয়্যাহ, তথা কওমী মাদরাসার সুরক্ষা, তা’লীম-তারবিয়াত, দাওরায়ে হাদীসের সনদের মান সংশ্লিষ্ট বিষয় এবং বর্তমান নানামুখী প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, ওলামায়ে কেরাম ও মাদারিসে দ্বীনিয়্যার ঐক্যকে আরো মজবুত করণের বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য এই সম্মেলনে যোগদান করার তাওফীক এনায়েত করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ, দেশের নানা প্রান্ত থেকে কষ্ট করে এতে শরীক হওয়ায়, আমি আপনাদের সকলকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আল্লাহ যেন আমাদের এই উপস্থিতি কবূল ও মঞ্জুর করেন। আমীন!

মুহতারাম হাজিরীন!
কওমী মাদ্রাসা আমাদের কাছে আকাবির ও আসলাফের রেখে যাওয়া আমানত। আমরা সবাই এই আমানত রক্ষায় বদ্ধপরিকর। কওমী মাদ্রাসার ইতিহাস-ঐতিহ্য আমাদের কারো অজানা নয়। এই মাদ্রাসাসমূহ দারুল উলূম দেওবন্দের আদলে পরিচালিত হয়ে থাকে। আর দারুল উলূম দেওবন্দ হলো একটি ইলহামী এদারা এবং এর সূচনা, শিক্ষাকারিকুলাম ও শিক্ষা ব্যবস্থা; সবই ইলহামী।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর ভারত উপমহাদেশের উলামায়ে কেরাম ও মুসলমানদের উপর যে বিপর্যয় নেমে আসে, তা থেকে উত্তরণের জন্য ১৮৬৬ সালে এই ইলহামী এদারা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অদ্যাবধি এই দারুল উলূম দেওবন্দ দ্বীন ও ইসলামের বহুমুখী খিদমত আঞ্জাম দিয়ে আসছে। যার ফলে ইসলামী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে সারা পৃথিবীতে সর্বত্র ও সর্বমহলে দারুল উলূম দেওবন্দ একটি বহুল পরিচিত নাম। বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদিদের হাত থেকে এই উপমহাদেশ মুক্ত হওয়ার পেছনে দেওবন্দের অবদান অবিস্মরণীয়। আমাদের কওমী মাদ্রাসাসমূহ সেই দারুল উলূম দেওবন্দের অনুসারী। দেওবন্দের মতই এসব প্রতিষ্ঠান ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা, ইসলামী সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঈমান-আকীদা, আমল-আখলাক ও নৈতিক চিন্তাধারা পরিগঠনে মৌলিক ভূমিকা পালন করে আসছে। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর পরিপূর্ণ বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে সৎ চরিত্রবান, দেশপ্রেমিক সুনাগরিক তৈরী করাই হচ্ছে কওমী মাদরাসার বিশেষ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ইসলামের মহান বাণী সর্বস্তরের জনসাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়াই কওমী মাদ্রাসার কাজ। দল-মত শ্রেণী-গোষ্ঠী নির্বিশেষে, প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সঙ্গে কওমী মাদ্রাসার আত্মার সম্পর্ক বিদ্যমান। এই মাদরাসাসমূহ সম্পূর্ণরূপে স্বায়ত্বশাসিত। দেওবন্দের উসূলে হাশ্তেগানা বা আট মূলনীতিই হলো এসব প্রতিষ্ঠানের পথনির্দেশিকা। এ মূলনীতিসমূহের অন্যতম হলো, এসব প্রতিষ্ঠানের স্বকীয়তা ও মৌলিকত্ব অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে ‘সরকারি সাহায্য গ্রহণ না করা ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত থাকা’। তবে এটা কোনো অর্থেই রাষ্ট্র বা সরকারের প্রতিপক্ষ হওয়া নয়। বরং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যে কোনো ত্যাগ স্বীকার ও সংবিধানের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে, যতক্ষণ পর্যন্ত তা কুরআন-সুন্নাহবিরোধী না হয়, কওমী মাদরাসা কখনও পিছপা হয়নি।

মুআজ্জাজ হাজিরীন!
দেড়শত বছর থেকে স্বাধীনভাবে চলে আসা এই কওমী মাদরাসাসমূহের শিক্ষা সনদের সরকারী মান নিয়ে এখন নানা মহলে নানা গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছি। কেউ কেউ আবার সরকার থেকে সনদের স্বীকৃতি গ্রহণের জন্য বেশ উৎসাহও দেখাচ্ছেন। গত কয়েক বছর ধরে কওমী মাদরাসা শিক্ষা কমিশন গঠন, বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইন প্রণয়ন এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম কমিটি গঠন করে বিভিন্ন প্রকার প্রজ্ঞাপন জারিসহ সরকারের নানা পদক্ষেপ এবং এসব প্রক্রিয়ার পেছনে কারো কারো অতিমাত্রার আগ্রহ সম্পর্কে আমরা সকলেই কমবেশ অবগত আছি।
এ বিষয়টি আমার কাছে অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। কারো কারো অতি উৎসাহমূলক তৎপরতা দেখে আমি কওমি মাদ্রাসার স্বকীয় বৈশিষ্ট, স্বাধীন শিক্ষাক্রম পরিচালনা, নীতি-আদর্শ অটূট রাখা এবং কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার মৌলিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অক্ষুণ্ন রেখে স্বাধীন শিক্ষাক্রম পরিচালনা বজায় রাখার বিষয়ে গভীরভাবে শংকিত ও উদ্বিগ্নবোধ করছি। আমি মনে করি, কওমী মাদরাসার শত শত বছর ধরে চলে আসা স্বকীয় নীতি-আদর্শ, স্বাধীন শিক্ষাক্রম পরিচালনা বিন্দুমাত্রও নষ্ট হবে না এবং কওমী মাদরাসার সকল কার্যক্রম পরিচালনায় সরকারের কোনরূপ নিয়ন্ত্রণ থাকবে না- এমন নিশ্চয়তা পেলেই, কেবলমাত্র আমরা সরকার থেকে দাওরায়ে হাদীসের সনদের মান নির্ধারণের বিষয়ে উলামায়ে কেরামের সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতে আলোচনায় আসতে পারি। অন্যথায় বৃটিশ শাসনামল থেকে এই পর্যন্ত আমরা যেভাবে আছি, সেভাবে থাকাকেই নিরাপদ মনে করি।

জাতীয় দৈনিকগুলোতে বেশ কিছুদিন যাবত আপনারা আমার বক্তব্য ও বিবৃতি দেখে আসছেন। আমি বার বার সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলসহ সকলের জ্ঞাতার্থে বলেছি- বাংলাদেশের সংখ্যাগষ্ঠি মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আদর্শিক ভাবধারা বিরোধী, বিদ্যমান সিলেবাস ও পাঠ্যবই আগে সংশোধন করুন। ধর্মহীন শিক্ষানীতি-২০১০ এবং খসড়া শিক্ষা আইন-২০১৬ অনতিবিলম্বে বাতিল করুন। তারপর আমরা কওমী শিক্ষা সনদের সরকারী মূল্যায়নের বিষয়ে আলোচনা করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করবো। কারণ, বিদ্যমান শিক্ষানীতি মতে দেশের সকল প্রতিষ্ঠানে পর্যায়ক্রমে একমুখী সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা চালুর যে সুপারিশ রয়েছে, তা বহাল থাকাবস্থায় এমনিতেই কওমী মাদ্রাসার স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য গভীর সংকটের মুখে পড়ার জোরালো আশংকা রয়েছে। তাছাড়া ২০১৬ সালের প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের বেশ কিছু ধারা কওমি মাদ্রাসা স্বাধীনভাবে চলার পথে প্রতিবন্ধ হওয়ার আশংকা তৈরি হয়েছে। সুতরাং শিক্ষানীতি, শিক্ষাআইন ও সিলেবাসের মতো মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সমাধানে আসার আগে আমার কোন কোন ভাইয়ের সরকারি সম্পৃক্ততায় সনদের স্বীকৃতি নিয়ে অগ্রসর হওয়ার প্রতি আগ্রহবোধ মারাত্মক আত্মঘাতি পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
সঙ্গতঃ কারণে আমাদের সকলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে এসকল বিষয়ে চূড়ান্ত অবস্থান নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। যার প্রেক্ষিতে আজকের এই ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন- “তোমরা আমার রশিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পরে বিভক্ত হয়ো না”।
হযরত হযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রাযি.) বর্ণনা করেছেন- “হে ক্বারী সাহেবগণ! সোজা চলো। তাহলে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে সবার আগে। আর যদি ডানে কিংবা বামে ঝুঁকে পড়ো, তাহলে কিন্তু গন্তব্য থেকে অনেক দূরে থেকে যাবে”।

ভাইয়েরা আমার!
এই মুহূর্তে আমাদের সবার ঐক্যবদ্ধ হওয়া খুব জরুরী। নতুবা কওমী মাদ্রাসার অপুরণীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তাই আসুন! ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আমরা একমত হই। আমরা জানি-দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষা সনদের সরকারী মূল্যায়ন ও মান বৃটিশ ও পাকিস্তান শাসনামলসহ বর্তমান ভারতে বিদ্যমান থাকলেও, বাংলাদেশে তা কার্যকর নেই। অথচ সময় ও বাস্তবতার তাগিদে কওমী মাদরাসা পড়ুয়া আলেমদের কর্মক্ষেত্র সম্প্রসারণ, তাদের মেধা-প্রতিভার মূল্যায়ন এবং সর্বোপরি দেশ ও জাতির আরো বৃহৎ পরিসরে সেবাদানের সুযোগ উন্মুক্ত করার স্বার্থে কওমী সনদের সরকারী মূল্যায়ন বা মান নির্ধারণের প্রয়োজন রয়েছে। এটি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে বহু বছর আগ থেকেই আছে। ভারত সরকার কোন প্রকার শর্ত, নিয়ন্ত্রণ ও দাপ্তরিক সম্পর্ক ছাড়াই রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে ধর্মীয় সকল ক্ষেত্রে দারুল উলূম দেওবন্দের সনদের মূল্যায়ন করে থাকে। ভারতে দারুল উলূম দেওবন্দসহ অন্যান্য কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদীসের সনদ দিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী ও ইসলামী বিষয়ে অনার্সসহ উচ্চতর গবেষণামূলক পাঠ্যক্রমে ভর্তি হতে পারে। তাছাড়া ভারতে কওমি আলেমদেরকে অন্যান্য শিক্ষিত নাগরিকদের মতোই মূল্যায়ন ও মর্যাদা দেয়া হয়।
আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, ১৯০৯ সালে কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় যখন টাইটেল খোলা হয়, তখন সেখানে এমন অনেককে মুহাদ্দিস পদে নিয়োগ দেয়া হয়, যারা দেওবন্দ অথবা দেওবন্দী ধারার কওমী মাদ্রাসা থেকে সনদপ্রাপ্ত। যেমন- মাওলানা ইসহাক বর্ধমানী, মাওলানা ইয়াহইয়া, মাওলানা আব্দুল হামিদ চট্টগ্রাম প্রমূখ। পরবর্তীতে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ইসলামী স্টাডিজ বিভাগে হযরত মাওলানা জাফর আহমাদ উসমানী ও মাওলানা ইসহাক বর্ধমানীকে (বদলী করে) অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তাঁরা উভয়েই দারুল উলূম দেবন্দের সনদধারী আলেম ছিলেন। এমনিভাবে হায়দরাবাদ উসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শাইখুল হিন্দ মাহমূদ হাসান দেওবন্দী (রাহ.)এর স্নেহধন্য বিশেষ ছাত্র দেওবন্দের সনদপ্রাপ্ত মাওলানা মুনাজির আহসান গিলানীকে প্রধান অধ্যাপক পদে নিযুক্ত করা হয়। চট্টগ্রাম আলিয়া মাদ্রাসা এবং সিলেট আলিয়া মাদরাসায়ও দেওবন্দের সনদপ্রাপ্ত আলেমরা শিক্ষকতা করেছেন। পাকিস্তান আমলেও ১৯৫৪ সালে ঢাকা আলিয়ায় হেড মুহাদ্দিস পদে নিয়োগ পান দেওবন্দের সনদপ্রাপ্ত আলেম জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের খতীব মাওলানা ওবায়দুল হক (রাহ.) এবং অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন তাঁরই ভ্রাতা দেওবন্দের সনদপ্রাপ্ত আলেম মাওলানা আব্দুল হক। কিশোরগঞ্জ হায়বত নগর আলিয়া, পাবনা আলিয়া, ফেনী আলীয়াসহ দেশের বহু আলিয়া মাদরাসায়ও দেওবন্দের সনদপ্রাপ্ত অনেক আলেম কর্মরত ছিলেন। তন্মধ্যে মাওলানা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ, শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক, মাওলানা নূরুদ্দীন গওহরপুরী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষা সনদের মান, মর্যাদা ও মূল্যায়ন বৃটিশ ও পাকিস্তান উভয় শাসনামলেই ছিল এবং এখনো ভারতে কওমি আলেমদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মূল্যায়ন আগের মতোই আছে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশেও কয়েক বছর পর্যন্ত এই ধারা চালু ছিল। এ হিসেবে আমি বলতে চাই, যেহেতু এ দেশের কওমী মাদরাসাসমূহ চিন্তা-চেতনা ও নীতি-আদর্শে সেই দেওবন্দকেই আবহমান কাল থেকে অনুসরণ করে পরিচালিত হয়ে আসছে এবং এই মাদরাসাসমূহের শিক্ষা কারিকুলাম ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনা দেওবন্দের আদলেই সুবিন্যস্ত ও নিয়ন্ত্রিত, সেহেতু দেওবন্দের আট মূলনীতি শতভাগ অক্ষুন্ন ও অটুট রেখে, বৃটিশ ও পাকিস্তান আমল এবং বর্তমান ভারত সরকারের নমূনা অনুসরণ করে, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কওমি শিক্ষাবোর্ড বেফাকের মাধ্যমে সকল বোর্ডভুক্ত মাদ্রাসমূহের দাওরায়ে হাদীসের সনদকে সরকারীভাবে মূল্যায়ন করে ধর্মীয় ও সামাজিক সকল ক্ষেত্রে কওমি সনদধারী আলেমদের সংযুক্ত হওয়ার পথ উন্মুক্ত করা হোক। পাশাপাশি দাওরায়ে হাদীসের সনদধারী তরুণ আলেমদের জন্যে সরকারী বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে আরবী ভাষা সাহিত্যসহ ইসলামধর্ম সংশ্লিষ্ট পৃথক পৃথক বিষয়ের উপর অনার্স, মাস্টার্স, পিএইচডি’সহ উচ্চতর গবেষণার সুযোগ অবারিত করা হোক। সর্বোপরি কওমি ছাত্রদের জন্যে পাবলিক পরিবহণে অর্ধ্বেক ভাড়ার সুযোগসহ সাধারণ শিক্ষার ছাত্রদের জন্যে প্রযোজ্য সকল সুযোগ দেওয়া হোক।

হাজিরীনে কেরাম!
দেওবন্দের ৮ মূলনীতির ৭ নম্বর মূলনীতি হলো ‘এর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় সরকারের অংশীদারিত্ব ক্ষতিকর’। সুতরাং সরকারের যে কোন প্রকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে আমাদের শিক্ষা সনদের মান দিলে তা এই মূলনীতির সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক হবে। আমাদের পূর্ব পুরুষদের কঠোর সাধনা, অবর্ণনীয় ত্যাগ এবং চোখের পানির ফসলই হচ্ছে এসব কওমী মাদরাসা। খেয়ে না খেয়ে যে কোন মূল্যে এগুলোকে আগলে রেখে রক্ষা করাই ছিল তাঁদের মিশন। ধৈর্য্য, সহনশীলতা, নেক আমলের মানসিকতা, দেশপ্রেম, পিতা-মাতার আনুগত্য, মুরুব্বী ও গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রশিক্ষণ, মানবসেবা, সুশৃঙ্খল জাতি গঠনে আদর্শিক ও নৈতিক শিক্ষা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সর্বোপরি আত্মার উৎকর্ষ সাধন করে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলাই হচ্ছে কওমী মাদরাসা শিক্ষাধারার মূল সৌন্দর্য। শিক্ষা ও দীক্ষার এক অপূর্ব সমন্বয় পরিলক্ষিত হয় কওমী মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায়। সে কারণেই আমরা চাই, আমাদের এসব স্বকীয়তা যেন কোন প্রকার সরকারী নিয়ন্ত্রণের ফলে কোনভাবে বিন্দুমাত্রও নষ্ট না হয়।

কওমী মাদরাসাসমূহ দুনিয়াবী স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে পরিচালিত হয় না। এসব মাদরাসার উদ্দেশ্য হলো, শুধুমাত্র মহান আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন এবং মুসলমানদের সন্তানদেরকে কুরআন-হাদীসের শিক্ষায় নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। দ্বীন ইসলামের জন্যে ওলামায়ে কেরামের এমন আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়েই কওম তথা সর্বস্তরের মুসলমানগণ ওলামায়ে কেরামের প্রতি অগাধ আস্থা ও ভালবাসা দিয়ে সব ধরণের সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়ে আসছে।

কওমী মাদরাসাসমূহের শিক্ষাক্রমসহ সকল কার্যক্রমই উন্মুক্ত। সরকারী, বেসরকারী, দেশী-বিদেশী যে কেউ যে কোন সময় এসব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করতে পারে। দেওবন্দী নীতি-আদর্শের কঠোর অনুসরণের ফলে কওমী মাদরাসাসমূহ রাজনৈতিক কারণে সরকারবিরোধী যে কোন আন্দোলন ও তৎপরতা থেকে সবসময় দূরে থাকে এবং ভবিষ্যতেও রাজনৈতিক কারণে সরকারবিরোধী কোন কিছুতে জড়িয়ে পড়ার আশংকা নেই। কওমী মাদরাসাসমূহ সকলপ্রকার উগ্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ, নাস্তিক্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার ঘোরতর বিরোধী। সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদের সাথে কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের সংশ্লিষ্টতার কোন ঘটনা নেই। কওমী মাদরাসার ক্যাম্পাসে কখনোই বিশৃংখল আচরণ বা ছাত্র সংঘাতের নজীর নেই। কওমী মাদরাসাসমূহ সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত সদকা, যাকাত ও অনুদানের অর্থ গ্রহণ করে লক্ষ লক্ষ এতীম গরীব, নিঃস্ব ও অবহেলিত পরিবারের শিশু-কিশোরদের ভরণ- পোষণের ব্যয়ভার গ্রহণ করে ধর্মীয় ও আদর্শিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার পাশাপাশি নিরক্ষরমুক্ত দেশ গঠনে বিশাল ভূমিকা ও অবদান রেখে চলেছে।

সুতরাং কোনভাবেই যেন কওমী মাদরাসা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য ও আদর্শচ্যুত হওয়ার আশংকা না জাগে, মাদরাসার সুশৃঙ্খল পরিবেশ যেন বজায় থাকে, সেই লক্ষ্যে কওমী মাদরাসা সনদের সরকারী মান থাকার বিষয়ে সরকারকে দেশের সিংহভাগ কওমী মাদরাসার প্রনিনিধিত্বকারী সর্ববৃহৎ শিক্ষাবোর্ড বেফাকসহ বৃহত্তর আলিমসমাজের মতামতকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। আলেম সমাজে যাদের গ্রহণযোগ্যতা নেই, এমন কারো মাধ্যমে প্ররোচিত হয়ে কওমী সনদের স্বীকৃতির মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোন বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সরকারের কাছে আমরা আশা করি না।
সারকথা-
১। ভারতে দারুল উলূম দেওবন্দ যেভাবে নিজ স্বাতন্ত্র্য স্বকীয়তা নিয়ে স্বাধীনভাবে চলছে বাংলাদেশের কওমী মাদরাসাসমূহও সেভাবে চলবে।

২। বর্তমান নিজস্ব ধারায় কওমী মাদরাসার প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা-দীক্ষা ও সিলেবাস ইত্যাদি সম্পূর্ণরূপে বহাল রেখে কওমী সনদের সরকারী মান বা মর্যাদা দিতে পারে সরকার। মাদ্রাসার স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, স্বাধীন শিক্ষাক্রম পরিচালনা ও স্বকীয়তা বিনষ্ট করে সনদের সরকারী মর্যাদা কোন অবস্থাতেই আমরা চাই না।

৩। প্রস্তাবিত কওমী মাদরাসা শিক্ষানীতি-২০১২ এবং তদালোকে তৈরিকৃত কওমী মাদরাসা কর্তৃপক্ষ আইন-২০১৩ বাতিল করতে হবে। কারণ এ জাতীয় কর্তৃপক্ষ বা আইন কওমী মাদরাসার ঐতিহ্যবাহী ধারাপরিপন্থী। এর ফলে দেড়শত বছর থেকে চলে আসা কওমী মাদরাসা তার চিরায়ত স্বকীয়তা হারাবে বলে আমি আশংকা করি।

৪। কওমী মাদরাসাগুলোকে সরকারী অনুদান, এমপিওভূক্তি ও নিবন্ধনসহ নিয়ন্ত্রণমূলক যে কোন রকম পদক্ষেপ থেকে সরকারকে বিরত থাকতে হবে।

৫। কওমী আলেমদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ঐক্যমত ছাড়া কওমী সনদসহ কওমী মাদরাসার ব্যাপারে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে সরকারকে বিরত থাকতে হবে।

পরিশেষে, শিক্ষানীতি-২০১০, খসড়া শিক্ষা আইন-২০১৬ ও বিতর্কিত শিক্ষা সিলেবাস সম্পর্কে দু’টি কথা না বলে পারছি না। শিক্ষানীতির ৫নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে- সাধারণ, কিন্ডারগার্টেন, ইংরেজী মাধ্যম ও সব ধরণের মাদরাসাসহ সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নিয়ম-নীতি মেনে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধন করতে হবে। এই নীতি দ্বারা নিঃসন্দেহে কুরআনী শিক্ষার বিস্তৃতি সাধন বাধাগ্রস্ত হবে এবং নতুন নতুন দ্বীনি মাদরাসা-মক্তব কায়েমের পথ প্রসারিত হওয়ার পরিবর্তে সংকুচিত হবে। এ কারণে এই শিক্ষানীতি সরকারকে বাতিল করতে হবে। এমনিভাবে শিক্ষা আইনের ১ম অধ্যায়ের ১০ নং ধারার ১ নং উপধারায় বলা হয়েছে “প্রাক প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে কিন্ডার গার্টেন,. ইংরেজি মাধ্যম, ইংলিশ ভার্সন ও ইবতেদায়ী মাদরাসাসহ সকল বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার জন্য নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের নিকট হইতে নিবন্ধন এবং পাঠদানের উপর্যুক্ত সকল বিধি-বিধান অনুসরণ বাধ্যতামূলক হইবে”।

একই ধারার ২নং উপধারায় বলা হয়েছে “কোন ব্যক্তি উপধারা (১) এর বিধান লংঘন করিলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ হিসেবে গণ্য হইবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ সর্বোচ্চ তিন লক্ষ টাকা অর্থদ- অথবা ০৬ (ছয়) মাস কারাদ- অথবা উভয় দন্ডে দ-িত হইবেন। ১১নং ধারার ২নং উপধারায় আরো বলা হয়েছে “নিবন্ধন ব্যতীত কোন অবস্থাতেই কোন বেসরকারী বিদ্যালয় বা মাদরাসা স্থাপন ও পরিচালনা করা যাইবেনা” আমরা মনে করি খসড়া শিক্ষা আইনের উপর্যুক্ত ধারাগুলো ওহীর শিক্ষাব্যবস্থার উপর কুঠারাঘাত। সুতরাং মক্তব, হাফেজিয়া মাদরাসা ও কওমী মাদরাসার স্থাপন ও পরিচালনাকে এসকল আইনের আওতামুক্ত রাখা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। তৎসঙ্গে হিন্দুত্ব ও নাস্তিক্যবাদী শিক্ষা সিলেবাস অবিলম্বে সরকারকে সংশোধন করতে হবে।

কওমি মাদ্রাসার স্বকীয়তা বজায় রাখা ও সনদের বিষয়ে উলামায়ে কেরামের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত প্রণয়ের আলোচনায় সহায়ক ভূমিকা রাখতে দূর-দুরান্ত থেকে অনেক কষ্ট করে আপনারা এখানে সমবেত হয়েছেন, এ জন্যে আমি আবারো আপনাদের শোকরিয়া প্রকাশ করছি। এবং আশাকরব, আগামীতেও যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐক্যের ডাক আসলে সর্বাত্মক সাড়া দিবেন।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে নেক হায়াত দান করুন। আমীন।

আল্লামা আহমদ শফী
সভাপতি- বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ।
মহাপরিচালক- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
আমীর- হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।
তারিখ- ১৫ মুহাররম, ১৪৩৮ হিজরী।
১৭ অক্টোবর, ২০১৬ ঈসায়ী।

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ