শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


ধর্মের নামে সন্ত্রাস : ইসলামের দৃষ্টিকোন ও আমাদের করণীয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ahmad-abdul-kaderড. আহমদ আবদুল কাদের

সাম্প্রতিককালে সর্বত্র সন্ত্রাস বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ধর্মের নামে, ইসলামের নামে সন্ত্রাস আজকের পৃথিবীর একটি বড় সমস্যা। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে ইসলামের নামে নানা ধরণের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। অথচ বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকের আগে ইসলামের নামে সন্ত্রাসের তেমন কোন অস্তিত্বই ছিল না। বর্তমান সন্ত্রাস নিয়ে সাধারণ মানুষ যেমন ভীত সন্ত্রস্থ ও উদ্বিগ্ন তেমনি আলেম-উলামা ও ইসলামি নেতৃবৃন্দও উদ্বিগ্ন। অবশ্য সন্ত্রাস কেন ঘটছে তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চলছে। বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশ ও মিডিয়া এবং তাদের দেশিয় অনুচররা এর জন্য ঢালাওভাবে ইসলাম ও ইসলামি আন্দোলনকে দায়ী করছে। অন্যদিকে কেউ কেউ এর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পলিসিকে দায়ী বলে মনে করছেন। বর্তমান নিবন্ধে আধুনিক সন্ত্রাসের উত্থানের ইতিহাস, বর্তমান সন্ত্রাসের কারণ, সন্ত্রাস সম্পর্কে ইসলামি দৃষ্টিকোন এবং সন্ত্রাস প্রতিরোধে আমাদের করণীয় ইত্যাদি নিয়ে আলোকপাত করা হবে।

সন্ত্রাস ও এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
সন্ত্রাসের ইংরেজি প্রতিশব্দ Terror সন্ত্রাসবাদ অর্থে Terrorism শব্দটি সর্বপ্রথম ইংরেজি ভাষায় গৃহীত হয় ১৭৯৮ সালে। সে শব্দটি দ্বারা ফরাসী বিপ্লবের ফলে রাজতন্ত্রের পতনের পর গঠিত ’বিপ্লবী সরকার’ কর্তৃক ’সন্ত্রাসের রাজত্ব’ কালীন সময়ে (১৭৯৪-১৭৯৫) ভীতি ও সন্ত্রাস সৃষ্টিকে বুঝানো হতো। তৎকালীন জেকোবিন নেতা ম্যাক্সিমিলিয়ান রোবস্পিয়ার সন্ত্রাস সৃষ্টিকে রাষ্ট্রীয় পলিসি হিসেবে গ্রহণ করেন। সন্ত্রাসের মহত্ত্ব (?) তুলে ধরে তিনি বলেন,
“Virtue without which terror is evil, terror without which virtue is helpless——Terror is nothing but justice, prompt, severe and inflexible; it is therefore an emanation of virtue” (quoted in Inside Terrorism, Bruce Hoffman, Revised and expanded. Columbia University Press, New York, 2006, p.3)

অর্থাৎ সদগুণাবলী ছাড়া সন্ত্রাস হচ্ছে একটি দুষ্টকর্ম। আবার সন্ত্রাস ছাড়া সদগুণাবলী অসহায় —– সন্ত্রাস ন্যায়, তরিৎ, কঠোর ও অনমনীয়তা ছাড়া আর কিছু নয়। তাই সন্ত্রাস হচ্ছে সদগুণাবলীরই বহিঃপ্রকাশ।

কাজেই রোবস্পিয়ার ফ্রান্সে এক সন্ত্রাসী রাজত্ব কায়েম করেন। তার একবছরের রাজত্বে হাজার হাজার বিরোধী মতাবলম্বী মানুষ নিহত হয়। শুধু বিরোধীরা নয় যারা রোবস্পেয়ারের সঙ্গে দ্বিমত করতেন তারাও সন্ত্রাসের শিকার হন। এমনকি শেষ পর্যন্ত রোবস্পিয়ার নিজেও একই ধরণের সন্ত্রাসের শিকার হয়ে নিহত হন।

ফরাসী বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে terrorism শব্দটি বেসরকারি ব্যক্তি বা সংস্থার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বামপন্থী নৈরাজ্যবাদীরা সন্ত্রাসকে তথাকথিত বিপ্লবী দলের নীতি-পলিসি হিসাবে গ্রহণ করে এবং তারা এর যৌক্তিকতা তুলে ধরার প্রয়াস চালায়। বিশেষত ইতালীর কার্লো পিসকেইন তার পলিটিক্যাল টেস্টামেন্টে (১৮৫৭) ও রাশিয়ার মিখাইল বাকুনিন তার পত্রাবলীতে (১৮৭০) প্রচারনার কৌশল হিসাবে শক্তি প্রয়োগের তথা সন্ত্রাস সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। মিখাইল বাকুনিন মনে করতেন যে শক্তি প্রয়োগ ছাড়া ’প্রগতি’ সম্ভব নয়। ফরাসী নৈরাজ্যবাদী পল ব্রাউস সন্ত্রাসকে তথাকথিত বিপ্লবীদের কাছে আরো জনপ্রিয় করে তুলেন। ১৮৯৫ সালে ইরিকো ম্যালাটেস্টা সন্ত্রাস বলতে ’অত্যাসন্ন বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে প্রচন্ড সহিংসতা প্রয়োগকে’ বুঝান। এমনকি কার্ল মার্ক্স পর্যন্ত রুশ নারদীয় সন্ত্রাসীদের প্রশংসা করে বলেন যে,
“Terror was historically inevitable means of action of which it is useless to discuss —- terrorists as excellent people through and through —simple,—straightforward and heroic.” (Quoted in B Nicolaesky and O maenchen-Helfen, Karl Marx: Man and Fighter, Harmodswoth, 1976,p.398)
অর্থাৎ সন্ত্রাস হচ্ছে ঐতিহাসিকভাবে অনিবার্য আন্দোলনের মাধ্যম; যে সস্পর্কে আলোচনা নিরর্থক।– সন্ত্রাসীরা আপাদমস্তক খুবই উত্তম লোক—-তারা সরল ও স্পষ্টবাদি এবং বীরোচিত ভূমিকা পালনকারী।

লেনিন ও সন্ত্রাস এবং শক্তি প্রয়োগ কে নীতিগতভাবে সমর্থন করেন। তার মতে, “Such forms of violence as were calculated to bring about the direct participation of the masses and which guaranteed that participation.Ó (Lenin,Collected works, Vol.6; Progress Publication, Moscow,1961; P.193)
অর্থাৎ লেনিন সে ধরণের সন্ত্রাস ও শক্তি প্রয়োগকে সমর্থন করেন যা জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ ঘটাবে এবং এ অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করবে।

মূলত কমিউনিস্ট নৈরাজ্যবাদী চিন্তাবিদ ও একটিভিস্টরাই আধুনিক সন্ত্রাস তত্ত্বের জন্মদাতা। তাদের তত্ত্বের মূল কথা হলো যে, সন্ত্রাসের মাধ্যমেই বিপ্লবী আদর্শকে জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে পরিচিত করা যায়। শত্রুপক্ষের মধ্যে ভয় ভীতিও সঞ্চার করা সম্ভব। তাছাড়া সাধারন লোকদের মধ্যে আতংক সৃষ্টি করে প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করা যায় সন্ত্রাসের মাধ্যমে। অতএব প্রচারণার কৌশল হিসেবে তাদের মতে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে সন্ত্রাসী কার্যক্রম। এ লক্ষ্যে তারা যাবতীয় সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে মহিয়ানরূপে উপস্থাপন করার প্রয়াস চালায় এবং তথাকথিত বিপ্লবী কর্মকা-ের অপরিহার্য কর্মসুচি হিসাবে সন্ত্রাসকে গ্রহণ করে।

শুধু তত্ত্বেই নয় বাস্তবেও তারা বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায়। ফরাসী বিপ্লবের সময়ে বিপ্লবী সরকার কর্তৃক গৃহীত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের উদাহরণ অনুসরণ করে পরবর্তী সময়ে জার্মানীর নাৎসী সরকার, ইতালীর ফ্যাসিস্ট সরকার, সোভিয়েত রাশিয়ার ট্যালিন ও ক্রুশ্চেভ এর কমিউনিস্ট সরকার, চীনের মাওসেতুং এর কমিউনিস্ট সরকার, কম্বোডিয়ার কমিউনিস্ট পলপট সরকার ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। অন্যদিকে বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠন বিভিন্ন দেশে ব্যাপক সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনা করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-

১) আঠারো শতকের শেষ দুদশকে রাশিয়ায় নারদীয় গোষ্ঠী ব্যাপক সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে ও জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারসহ বেশ কয়েকজন সরকারী কর্মকর্তাকে কে হত্যা করে।
২) নারদীয় গোষ্ঠীর অনুসরণে বিভিন্ন দেশের নৈরাজ্যবাদীরা স্ব স্ব দেশের প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ম্যাককিনলী, ফরাসী প্রেসিডেন্ট, স্পেনের প্রধানমন্ত্রী, অস্ট্রিয়ার সম্রাজ্ঞী ২য় এলিজাবেথ ও ইতালীর রাজা ১ম উমরায়ুসকে হত্যা করতে সক্ষম হয়।
৩) ১৮৯০ এর দশকে আর্মিনিয়ার রিভ্যুলিউশনারী ফেডারেশন এবং মেসিডোনিয়ার IMRO উসমানীয় খেলাফত বিরোধী ব্যাপক সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায়।
৪) আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে আইরিশ রিপাবলিকান ব্রাদারহুড ব্যাপক সন্ত্রাসী তৎপরতা শুরু করে। কার্ল মার্কস পর্যন্ত তাদের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন।
৫) প্রথম বিশ^যুদ্ধ শুরু হওয়ার অব্যবহিত আগে প্রকাশ্য রাজপথে সার্ব র‌্যাডিক্যাল গাব্রিলু প্রিনসিপ কর্তৃক অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ও তার স্ত্রীকে হত্যা করে। এর সুত্র ধরে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।
৬) ১৮৮৬ সালের মে মাসে শিকাগো শহরের হে মার্কেটে বাম নৈরাজ্যবাদী সন্ত্রাসী তৎপরতা চলে এতে পুলিশসহ বেশ কয়েকজন লোক মারা যায়।
৭) ১৯২৫ সালের ১৬ এপ্রিল বুলগেরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক রাজধানী সোফিয়ার সেন্ট ন্যাডেলিয়া চার্চে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়। এতে প্রায় ১৫০ জনের বেশি নিরীহ মানুষ নিহত হয়, আহত হয় আরো ৫০০ জন।
৮) ফিলিস্তিনি বাম সংগঠন পিএফএলপি ১৯৬৮ সালের ২২ জুলাই একটি ইসরাইলী বিমান হাইজ্যাক করতে সক্ষম হয়, দু’বছর পর তারা আরো তিনটি বিমান দুটি আমেরিকান বিমান ও একটি সুইচ বিমান হাইজ্যাক করে। ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর নামে আরেক বাম সংগঠন ১৯৭২ সালে জার্মানির মিউনিখে ১১জন ইসরাইলী খেলোয়াড়কে জিম্মি করে। শেষ পর্যন্ত জিম্মিকারী ও খেলোয়ার সবাই নিহত হয়। এর কয়েকদিন পরেই জার্মানির একটি বিমান তাদের দ্বারা হাইজ্যাক হয়ে যায়। ১৯৭৩ সালে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের আবু নাদাল গোষ্ঠী খার্তুমে সৌদী দূতাবাসে হামলা চালায়, এতে সেখানকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিহত হন।

৯) বাদার-মেইনহফ গ্যাং নামক পশ্চিম জার্মানির একটি বাম সংগঠন। এই গোষ্ঠী ব্যাংক ডাকাতি, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা, পশ্চিম জার্মানীতে মার্কিন স্থাপনাসমূহে আক্রমণ ইত্যাদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলো।
১০) ১৯৭০ ও ১৯৮০ এর দশকে ইতালীর বামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ছিলো রেড ব্রিগেড। তারা তথাকথিত সর্বহারা রাষ্ট্র কায়েমের লক্ষ্যে ইতালির বড় বড় শহরে বোমাবাজি করতো, পুলিশ কর্মকর্তাদের গুলি করতো এবং তাদের অপরহরণ করতো। তাদের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী ঘটনা হচ্ছে ইতালীর প্রধানমন্ত্রি অ্যালডু মরোকে অপহরণ ও হত্যা করা। তারা ১৪ বছরে প্রায় ৫০টি বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটায়।
১১) ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চারু মজুমদারের নেতৃত্বে নকশালবাড়ী আন্দোলন নামে একটি বাম সন্ত্রাসী আন্দোলন শুরু করে। এরা বহু সন্ত্রাসী ঘটনা ও হত্যাকা-ের নায়ক। মাওবাদী সন্ত্রাসীরাও ব্যাপক তৎপরতা চালায়। ভারত সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী ৬০০ জেলার মধ্যে ১৫০টি জেলায় মাওবাদী সন্ত্রাসীরা থানা লুট, পুলিশ ফাড়ী দখল, পুলিশ ও সাধারণ মানুষ হত্যায় লিপ্ত। নেপালে মাওবাদীরা সাত বছরে ৯৯টি সন্ত্রাসী আক্রমণ চালায়।
১২) শ্রীলংকার তামিল টাইগার গোষ্ঠী (এলটিটিএ) একটি বিছিন্নবাদী ও সন্ত্রাসী সংগঠন। মাওবাদে তারা দিক্ষিত ছিলো। তাদের আত্মঘাতি বোমা হামলার প্রধান বলি ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধি (১৯৯১) ও শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট রানাসিংয়ে প্রেমাদাসা (১৯৯৩), ’৯৬ সালে কলম্বোর কেন্দ্রিয় ব্যাংকে বোমা নিক্ষেপে ১০০ জন লোক প্রাণ হারায়। সরকার ও টাইগারদের সংঘাতে প্রায় ৭০ হাজার লোক মারা যায়। তারাই প্রথম আত্মঘাতি বোমা হামলার প্রচলন করে। পরে অন্যরা তাদের অনুসরণ করে।

১৩) পেরুর শাইনিং পাথ একটি মাওবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন। এরা বিভিন্ন শহরাঞ্চলে বোমা হামলা, খুন ইত্যাদিতে লিপ্ত ছিল। এরা তহবিল সংগ্রহের জন্য কোকেন ব্যবসার সাথেও জড়িত ছিল।
১৪) স্পেনের ইটিএ একটি মার্কসবাদী লেনিনবাদী গোষ্ঠী। এরা ’৮০ দশকে বিভিন্ন স্থানে বোমা আক্রমণ চালায় এবং সেনা সদস্য, পুলিশ ও বিচারকদের হত্যা করে। তহবিল সংগ্রহের জন্য এরা ডাকাতি, ছিনতাই, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক ’বিপ্লবী কর” আদায় করতো।
১৫) জাপানের রেড আর্মি ও একটি দুর্দষ বাম সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। ১৯৭০-১৯৯০ পর্যন্ত এ গোষ্ঠী বেশ কিছু জাপানি বিমান ছিনতাই করে ৭২ সালে ইসরাইলের তেলআবিবে হত্যাকা-ও চালায় এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকে।
১৬) ইরানের মুজাহিদে খালক ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্র বিরোধী সমাজতান্ত্রিক ভাবধারাপুষ্ট একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। তারা ইরানে বেশ কিছু সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটায়।
১৭) তুরস্কের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন পিকেকে মাওবাদী ভাবধারার বাম সংগঠন। তারা তুরস্কে সেনা পুলিশ হত্যা, বোমাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনার জন্য দায়ী।
১৮) বাংলাদেশে ইনু ও বাদল সাহেবদের দল জাসদ ’৭৩-’৭৫ সাল পর্যন্ত গণবাহিনী গঠন করে দেশময় সন্ত্রাস সৃষ্টি করে থানা লুট, মানুষ হত্যা, ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরণ করার প্রচেষ্টাসহ সবধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তারা চালিয়েছে। হক-তোয়াহর গলাকাটা রাজনীতি ও সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির সন্ত্রাসী কার্যক্রমও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

উপরোক্ত বামপন্থী পরিচালিত প্রধান প্রধান সন্ত্রাসী ঘটনা ছাড়াও বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতারা আন্দোলনের অংশ হিসেবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও চালান। বিশেষ করে কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট জুমো কেনিয়াট্টা, সাইপ্রাসের আর্চবিশব ম্যাকারাইয়ুস, আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমদ বেন বেল্লা ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট ন্যালসন মেন্ডেলার বিরুদ্ধেও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিলো। এছাড়া ১৯৩১-১৯৪৮ সালের মধ্যে ইহুদী জায়নবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন ‘আরগুন’ ব্যাপক সন্ত্রাসী তৎপরতা চালায়। শেষ আট বছরে তারা ২৫৯টি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটায়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৯৪৬ সালে জেরুজালেমের কিং ডেভিড হোটেলের বোমা বর্ষণের ঘটনা। এতে ৯১ জন নিহত ও ৪৫ জন আহত হয়। এ সন্ত্রাসী ঘটনার মূল নায়ক ছিলেন মুনাসেম বেগিন। এছাড়া আইজ্যাক রবিন, এ্যারিয়েল শ্যারনও ছিলেন ইহুদী সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতা। এরা সবাই পরে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালে বৌদ্ধ আউম শিনরিকিয়ু গোষ্ঠী টোকিও এর পাতাল রেলে নার্ভ গ্যাস দ্বারা সন্ত্রাসী আক্রমণ চালায়। এতে ১২ ব্যক্তি নিহত ও কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়। তাছাড়া থাইল্যান্ড ও বার্মায় মুসলিমবিরোধী বৌদ্ধ সন্ত্রাসী আক্রমণ এবং সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে শ্রীলংকার বৌদ্ধ সন্ত্রাসী আক্রমণও উল্লেখযোগ্য। খৃস্টান সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কু ক্লা কান আমেরিকায়, ১৯৮০ সালে ইতালীর বুলুগনায় খৃস্টান চরমপন্থী গোষ্ঠী, ১৯৯৫ সালে আমেরিকার ওকলাহামায় আরেক খৃস্টীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বোমা হামলা চালায় এতে ১৬৮ জন নিহত হয়। তাছাড়া ভারতের হিন্দুত্ববাদী ’আরএসএস’ ও ‘অভিনব ভারতের’ বিরুদ্ধে বিদেশি মিশনারীকে জীবিত পুড়িয়ে মারা, আজমীর শরীফের দরগাহতে বোমা আক্রমণ, গুজরাটে মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা সৃষ্টিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগ রয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটায় শিখ সন্ত্রাসীরা।

উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে বিশ শতকের নব্বই দশকের আগ পযন্ত যত সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে তার প্রায় ৯০% ভাগই বাম আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ ব্যক্তি ও সংগঠন দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। এ সময়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে বিপ্লবী কাণ্ড ও সন্ত্রাসীদেরকে মহিয়ান করে দুঃসাহসী বিপ্লবী বলে আখ্যায়িত করা হতো। এটা করতেন বামপন্থী তাত্ত্বিকরা আর নেতাকর্মীরা। তাছাড়া ইহুদী, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, হিন্দু, শিখ ধর্মের লোকেরাও কিছু কিছু সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটায়।

১৯৮১ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে একটি ইসলামি চরমপন্থী সংগঠন হত্যা করে। এটাই আধুনিককালে প্রথম সন্ত্রাসী কর্ম যা ইসলামি চরমপন্থীরা ঘটায়। এরপর নব্বইয়ের দশকে উসামা বিন লাদেন ও তার আল কায়দা এবং পরবর্তী সময়ে আল নুসরা ফ্রন্ট, বুকো হারাম ও সাম্প্রতিককালে আইএস ব্যাপক সন্ত্রাসী কর্মকা- চালায়। তারপরেও পরিসংখ্যানের দিক থেকে তথাকথিত ইসলামি সন্ত্রাস অন্যান্য সন্ত্রাসের তুলনায় কম। ১৯৮০-২০০৩ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মোট ৩১৫টি আত্মঘাতি হামলার মধ্যে সর্বোচ্চ ৭৬টি তামিল টাইগারদের কাজ। দ্রষ্টব্যঃ R.Rape, Dying to win,Newyork, 2005, p.4। ১৯৭০-২০১৩ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত ২৪০০টি সন্ত্রাসী হামলার মধ্যে মুসলমানরা জড়িত ৬০টিতে, ইহুদীরা জড়িত ১১৮টিতে। ইউরোপে ২০১৫ সালে সংঘটিত ২১১টি সন্ত্রাসী ঘটনার মধ্যে মাত্র ১৭টির জন্য দায়ী মুসলিমরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা (যার মধ্যে বাম গোষ্ঠীও রয়েছে) ও খৃস্টান চরমপন্থীরা (দ্রষ্টব্যঃ Wikipedia, terrorism in Europe)। শুধু মিডিয়া ও পশ্চিমা সরকারগুলো তথাকথিত ইসলামি সন্ত্রাসকে বড় করে তুলে ধরে প্রচারণা চালাচ্ছে। যদিও বাস্তবতা এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

ইসলামের নামে সন্ত্রাসের কারণ
ইসলামের নামে সন্ত্রাসের বহুবিদ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান প্রধান সাতটি কারণ হচ্ছে-
১। ইহুদী জায়নবাদী ইসরাইল নিরিহ ফিলিস্তিনিদেরকে নির্বিচারে হত্যা, সন্ত্রাস সৃষ্টি এবং লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনিদেরকে ঘরছাড়া করেছে। আর সেই ইসরাইলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শর্তহীন সমর্থন মুসলমানদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে কিছু কিছু মুসলিম সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
২। কাশ্মির, মিন্দানাও, উইঘুর, চেচেনিয়া প্রভৃতি অঞ্চলের স্বাধীকার আন্দোলনের সূত্র ধরে কিছু কিছু সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটে।
৩। আমেরিকা কর্তৃক আফগানিস্তান ও ইরাকে আক্রমণ করে সেখানকার সরকারের পতন ঘটিয়ে পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করে ও দীর্ঘদিন ধরে সেসব দেশ দখল করে রাখে। আমেরিকার উপর চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
৪। মুসলিম বিশ্বের তেল লুণ্ঠনের সাম্রাজ্যবাদী যড়যন্ত্রের প্রতিরোধ কল্পে কিছু সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটে।
৫। ইসলাম ও মুসলিম উত্থানের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত এবং এর তীব্র প্রতিক্রিয়ায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম সংঘটিত হয়।
৬। মুসলিম বিশ্বের সামরিক ও একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক সরকার, রাজাবাদশা এবং অগণতান্ত্রিক সরকারসমূহের প্রতি সাম্রাজ্যবাদের অব্যাহত সমর্থন ও তাদের টিকিয়ে রাখার জন্যে সার্বিক সহায়তার প্রতিক্রিয়ায় কিছু কিছু সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
৭। ইসলামের চরমপন্থী ব্যাখ্যায় কিছু কিছু আধুনিক ও বিক্ষুদ্ধ তরুণ আকৃষ্ট হয়ে সন্ত্রাসী কর্মে লিপ্ত হচ্ছে।

ইসলামের নামে সন্ত্রাস একটি জায়নবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী যড়যন্ত্র
বর্তমানে সন্ত্রাস যে একটি মারাত্মক সমস্যা এটা অনস্বীকার্য। বিশেষ করে ইসলামের নামে সন্ত্রাস। ইসলাম, মুসলমান ও ইসলামি আন্দোলনের বিরুদ্ধে গভীর যড়যন্ত্রের ফলশ্রুতি হচ্ছে ইসলামের নামে সন্ত্রাস সৃষ্টি। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে সবাইকে ক্ষেপিয়ে তোলাই এর অন্যতম উদ্দেশ্য। সাম্রাজ্যবাদী ইহুদী জায়নবাদী ও তার দেশিয় অনুচররা চায় মানুষ ইসলামের ছায়াতলে, ইসলামী আন্দোলনের প্রভাব বলয়ে না আসুক। তাই এ লক্ষ্যে কৌশল হিসাবে তারা ইসলামের নাম ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে। তারা অজ্ঞ ও বিক্ষুব্ধ তরুণদেরকে কৌশলে দলে ভিড়িয়ে ইসলাম কায়েমের নামে সন্ত্রাস সৃষ্টির কাজে লিপ্ত হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করছে ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ইসলামের জিহাদকে বিকৃত করে তারা তাকে সন্ত্রাসের সমার্থক হিসেবে পেশ করছে। কুরআনের কতিপয় আয়াত প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বর্তমান ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অর্থে ব্যাখ্যা করছে। বর্তমানে বহু চক্রান্তমূলক ইসলামি (?) ওয়েবসাইট চালু করা হয়েছে। যেগুলোর মাধ্যমে জিহাদ, কিতাল ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে নানাধরণের বিকৃত ব্যাখ্যা প্রচার করছে। এইসব ওয়েবসাইটগুলো ইহুদীবাদী জায়নবাদী সাম্রাজ্যবাদী এজেন্সিগুলো পরিচালনা করছে। সাধারণ মুসলিম তরুণরা মনে করছে এগুলো ইসলামের জ্ঞান দানের উদ্দেশ্যেই পরিচালিত। তাই তারা সেখান থেকে উগ্র মতবাদ গ্রহণ করছে ও সন্ত্রাসবাদে দীক্ষিত হচ্ছে। জায়নবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের লক্ষ্য হচ্ছে মুসলিম তরুণদেরকে সন্ত্রাসের কাজে লাগিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের সর্বনাশ করা। বিশেষতঃ আধুনিক তরুণ যাদের বেশিরভাগই ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ; তাদের মধ্যে ইসলামের বিকৃত ধারণা দিয়ে তাদেরকে সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করে ইসলাম ও মুসলমানদের অগ্রগতিকে রোধ করার ব্যবস্থা করা। মূলতঃ সন্ত্রাসের মাধ্যমে তারা কতিপয় উদ্দেশ্য সাধন করতে চায়-
১. ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক ভুল ধারণা দিয়ে ইসলামের ক্রমপ্রসারকে ঠেকানো।
২. ফিলিস্তিন ইস্যুকে আড়াল করে দেয়া।
৩. মুসলিম দেশগুলোতে উপনিবেশিক যুগের লিগ্যাসী তথা তাদের রেখে যাওয়া সেক্যুলার ব্যবস্থা ও সেক্যুলার নেতৃত্ব বহাল রাখা।
৪. উম্মাহকেন্দ্রিক ভাবাধারাকে দুর্বল করে দেয়া।
৫. ইসলামি জ্ঞানের ধারক-বাহক আলেমসমাজকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেয়া।
৬. ধর্মীয় শিক্ষাকে বিপজ্জনক হিসেবে উপস্থাপন করা।
৭. মুসলিম দেশগুলোর সম্পদ বিশেষত তেল সম্পদ লুণ্ঠন করা।
৮. ইসলামের উত্থানকামী আন্দোলনকে বিপজ্জনক হিসেবে তুলে ধরা- তাদের সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করা। এই নয়টি লক্ষ্য অর্জনের জন্যেই ইহুদী জায়নবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী চক্র বিশ্বজোড়া ইসলামের নামে সন্ত্রাস তৈরির কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের সবাইকে এ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।

সন্ত্রাস সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিকোন
নিরাপরাধ কোন মানুষকে হত্যা করা যায় না। অথচ সন্ত্রাসের ফলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নিরাপরাধ মানুষ মারা যায়; যা ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গর্হিত কর্ম। কেননা একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা গোটা মানবজাতিকে হত্যার শামিল। আর একজন মানুষকে বাঁচিয়ে দেয়া গোটা মানবতাকে বাচিয়ে দেয়ার শামিল। আল কুরআন বলছে- “নরহত্যা বা বিপর্যয় সৃষ্টির কারণ ছাড়া (অর্থাৎ নিরাপরাধ) কোন মানুষকে যে হত্যা করল সে যেন সারা দুনিয়ার মানুষকে হত্যা করলো, আর কেউ কারো প্রাণ বাচালো সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করলো। (সুরা মায়েদা : আয়াত নং ৩২)
“এবং কেউ ইচ্ছকৃতভাবে কোন মুমিন ব্যক্তিকে হত্যা করলে তার শাস্তি হবে জাহান্নাম। সেখানে সে স্থায়ীভাবে থাকবে ও তার প্রতি আল্লাহর গযব ও অভিসম্পাত বর্ষিত হবে এবং তিনি তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।” (সুরা নিসা : আয়াত নং ৯৩)

বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে মহানবী সা. বলেন,” হে লোক সকল! তোমাদের জান মাল ও ইজ্জত-আবরুর উপর হস্তক্ষেপ তোমাদের উপর হারাম করা হলো—” (বুখারী, আবুদাউদ, নাসাঈ, মুসনাদে আহমদ)
মহানবী সা. আরো বলেছেন,” যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ কোন অমুসলিমকে হত্যা করলো সে কখনও জান্নাতের সুগন্ধি পাবে না।” (বুখারী)
অর্থাৎ কোন মুসলমানকে তো হত্যা করা যাবেই না এমনকি চুক্তির আওতাধীন (বর্তমান যুগে প্রায় সব অমুসলিম দেশের সঙ্গে মুসলিম দেশগুলোর কূটনৈতিক চুক্তি ও সম্পর্ক রয়েছে) কোন অমুসলমানকেও হত্যা করা মারাত্মক গোনাহের কাজ। তাছাড়া কোন মুসলিম দেশ যখন অমুসলিম নাগরিকদের ভিসা প্রদান করে তখন তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। এ প্রসঙ্গে একটি হাদিসে মহানবী সা. বলেছেন –
“একজন নারীও কোন (কাফের) সম্প্রদায়ের জন্য নিরাপত্তা দিতে পারে অর্থাৎ (সে যদি কোন কাফেরকে নিরাপত্তা দেয়) তবে মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর তা মেনে নেয়া কর্তব্য।” (তিরমিযি/মিশকাত, বাবুল আমান, হাদিস নং-৩৮০১)

হানাফী উলামা ও ইমামদের মতে কোন স্বাধীন পুরুষ বা নারী যদি একজন অথবা একদল কাফেরকে বা কোন দূর্গবাসীকে কিংবা কোন শহর বাসীকে আশ্রয় বা নিরাপত্তা দান করে তা বৈধ বলে পরিগণিত হবে। অন্যকোন মুসলমান তার বা তাদের সাথে লড়াই করা (বা হত্যা করা) জায়েয নয়। কেননা, মুহাম্মদ সা. বলেছেন,” সুতরাং যে কোন একজন নিরাপত্তা প্রদান করলে তা মানা সকলের উপর ওয়াজিব।” (মিশকাত, বাবুল আমান, সূচনা বক্তব্য।) কাজেই দেশি বিদেশি কোন অমুসলিমকে হত্যার কোন সুযোগ ইসলামে নেই।

কোন দূতাবাস ও তার লোকজনের জান মালের ব্যাপারে ইসলাম খুবই গুরুত্ব দিয়েছে। যিনি বা যারা দূতাবাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদেরকে হত্যা করা নিষিদ্ধ। নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার মুসায়লামার দূতকে মহানবী সা. বলেছিলেন- “যদি দূতকে হত্যা করা নিষিদ্ধ না হতো তাহলে আমি তোমাদের গর্দান মেরে দিতাম (অর্থাৎ হত্যা করতাম)।” (আহমদ ও আবুদাউদ/ মিশকাত, বাবুল আমান; হাদিস নং ৩৮০৫)

যুদ্ধের সময়েও কতকগুলো নিয়ম মেনে চলতে ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। যুদ্ধ ক্ষেত্রেও সামরিক কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া আর কাউকে হত্যা করা ইসলামে পুরাপুরি নিষেধ। মহানবী সা. বলেছেন- “(সাবধান)! অতি বৃদ্ধ, শিশু এবং কোন মহিলাকে হত্যা করো না।—” (আবু দাউদ)
“যাও খালেদকে বলে দাও, কোন মহিলা ও কোন খাদেমকে যেন হত্যা না করা হয়।” (আবু দাউদ)

সেনাবাহিনীর প্রতি হযরত আবু বকরের রা.’র নির্দেশ ছিলো-
”মানুষের হাত-পা কেটে দেহ বিকৃত করবে না। শিশুদের হত্যা করবে না, যুদ্ধে অসমর্থ বুড়ো মানুষকে হত্যা করবে না। নারীদের একেবারেই উত্যক্ত করবে না। বাগ-বাগিচা ও ফসলের ক্ষেত নষ্ট করবে না, আগুন লাগাবে না, কোন ফলবান বৃক্ষ কাটবে না। খাবার প্রয়োজনে কোন অতিরিক্ত পশুকে জবাই করবে না। বিভিন্ন ধর্মের উপাসনালয়ে যারা নিজেদেরকে উপাসনায় নিয়োজিত রেখেছে, তারা যে যেভাবে আছে সেভাবেই থাকতে দেবে এবং তারা যে কাজ করার জন্য মনোনিবেশ করেছে তা করতে কোন রকম বাধা দেবে না।” (মোস্তফা আস সিবায়ী, ‘মিন রওয়ায়িয়ে হাযারাতিনা’, ৭ম অধ্যায়)

কাজেই যেখানে যুদ্ধ ক্ষেত্রেই নারী, শিশু, বয়স্ক লোক ও বিভিন্ন উপাসনালয়ে নিয়োজিত পুরোহিতকে হত্যা করা যায় না, সেখানে সন্ত্রাসী তৎপরতার মাধ্যমে তাদের হত্যা করাতো আরো অধিক নিষিদ্ধ হবে। তাছাড়া ইসলামের যুদ্ধ আইনানুযায়ী নারীদের উত্যক্ত করা, বাগ বাগিচা ও ক্ষেতের ফল নষ্ট করা, আগুন লাগিয়ে ঘরবাড়ি ধ্বংস করা, ফলবান বৃক্ষ কেটে ফেলা যাবে না। সে অবস্থায় সন্ত্রাস চালিয়ে মানুষের বাড়িঘর, মালামাল, স্থাপনা ইত্যাদি ধ্বংস করার কোন সুযোগ ইসলামে নেই।

আত্মঘাতি বোমা হামলাসহ যাবতীয় আত্মঘাতি কর্ম ইসলামে অনুমোদিত নয়। কেননা, ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা মহাপাপ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলছেন,
“তোমরা আত্মহত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর অতীব দয়ালু।” (সুরা নিসা : আয়াত নং ২৯)

একটি হাদিসে আছে, জনৈক ব্যক্তি আহত হয়েছিল। সে আত্মহত্যা করলে আল্লাহতায়ালা বললেন, ‘আমার বান্দা নিজের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করলো। আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম।’ (বুখারী)
কোন ব্যক্তিকে না হক অস্ত্র দ্বারা ভীতি প্রদর্শন নিষিদ্ধ। এ প্রসঙ্গে মহানবী সা. বলেছেন, “তোমাদের কেউ যেন তার ভাইয়ের প্রতি অস্ত্রের দ্বারা ইঙ্গিত না করে।” (বুখারী, মুসলিম)
“যে ব্যক্তি তার ভাইকে লোহার অস্ত্র দ্বারা ইংগিত করলো তখন সে অস্ত্র হাত থেকে ফেলে না দেয়া পর্যন্ত ফেরেশতারা তার উপর অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকেন—-।” (বুখারী)

ধর্ম বিষয়ে উগ্রতা ও চরমপন্থা সন্ত্রাসের অন্যতম কারণ। কেউ উগ্রপন্থী বা চরমপন্থী হলে সে সহজেই সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যে ইসলামে চরমপন্থার স্থান নেই। ইসলাম হচ্ছে মধ্যপন্থার ধারক- সিরাতুল মুস্তাকিম। কাজেই উগ্রতা ও চরমপন্থা উম্মাহর ধ্বংসের কারণ। কেননা, মহানবী সা. বলেছেন,“সাবধান ! কঠোরতাকারী চরমপন্থীরা ধ্বংস হয়ে গেছে—ধ্বংস হয়ে গেছে—ধ্বংস হয়ে গেছে”। (মুসলিম, আহমদ, আবু দাউদ)। সুতরাং চরমপন্থা সর্বদাই নিন্দনীয়। চরমপন্থী তৎপরতা উম্মাহর ধ্বংসের কারণ।
তাছাড়া আল কুরআন বারবার ফাসাদ বা বিপর্যয় সৃষ্টি করতে নিষেধ করেছে। আর সন্ত্রাসের মাধ্যমে নির্বিচারে মানুষ হত্যা, তাদের মধ্যে আতংক ও ভীতি সৃষ্টি, কোন স্থাপনা ধ্বংস করা সবই ফাসাদী কর্ম; যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
মোটকথা- নিরপরাধ মানুষকে ভয় দেখানো, তাদের মনে আতংক সৃষ্টি করা, তাদেরকে হত্যা করা, কোন দূতাবাসে আক্রমণ করা, তাদেরকে হত্যা করা, তাদেরকে জিম্মি করা, কোন স্থাপনা ধ্বংস করা, বিমান ছিনতাই করা সবই নিষিদ্ধ কর্ম। অর্থাৎ সমস্ত রকমের সন্ত্রাসই ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ইসলাম শান্তির ধর্ম, মানবতার কল্যাণের আদর্শ। কাজেই বিক্ষুদ্ধ হয়ে ইসলামের বিপরীত পন্থায় কোন পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ নেই।

সন্ত্রাস প্রতিরোধে আমাদের করণীয়
বাংলাদেশের আলেম উলামা ও ইসলামী দলগুলো সম্মিলিতভাবে ইসলামের নামে সৃষ্ট সন্ত্রাস মুকাবিলার জন্য কর্মসূচি নিতে হবে। মসজিদের খুতবা, ওয়াজ মাহফিল সহ বিভিন্ন ধর্মীয় সমাবেশে ইসলামে যে কোন সন্ত্রাসের স্থান নেই তা স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করতে হবে। যতই বিক্ষুব্ধ হই না কেন কোন ক্রমেই আইন হাতে তুলে নেয়া যায় না। কোন মানুষকে হত্যা করা যায় না। যারা জিহাদ ও কিতাল সংক্রান্ত আয়াতগুলোকে বিকৃত করে মানুষ মারার লাইসেন্স খুঁজছে তারা যে মারাত্মক বিভ্রান্তির মধ্যে আছে তা তুলে ধরতে হবে। তারা মুলত অতীত জমানার খারেজিদের মতো মুসলমানদের রক্তপাতকে হালাল করার চেষ্টায় আছে। খারেজিরা যে গোমরাহ, বিভ্রান্ত এ ব্যাপারে খারেজী ছাড়া মুসলমানদের সব ফির্কার ঐকমত্য রয়েছে। খারেজিরা এতটা উগ্র ছিলো যে হযরত আলীর রা. মতো ব্যক্তির রক্তকেও হালাল মনে করেছিল এবং জনৈক খারেজির হাতেই তিনি শাহাদত বরণ করেন। আজকের যুগে নব্য খারেজি ভাবধারা সম্পন্ন সন্ত্রাসীদের হাত থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে হবে। ইসলামের দুশমনদের পাতানো ফাদে পা দেয়া থেকে বিক্ষুদ্ধ যুব সমাজকে সতর্ক করতে হবে। আমাদের ক্ষোভ প্রকাশ করার নিয়মতান্ত্রিক পথের বাইরে গিয়ে এমন কিছু করা যাবে না যে কারণে গোটা ইসলাম ও উম্মাহ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সন্ত্রাসের মাধ্যমে এমন সুযোগ দুশমনদের দেয়া যাবে না যাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে সা¤্রাজ্যবাদী ইহুদী-জায়নবাদীরা মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পায়। সন্ত্রাস যেমন ইসলামে নিষিদ্ধ তেমনি কৌশলগতভাবেও উম্মাহর জন্য মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক। কাজেই দলমত নির্বিশেষে সবাইকে সন্ত্রাসী ভাবধারা ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। সন্ত্রাসের অন্যতম উদ্দেশ্য আলেম সমাজ ও ইসলামি দলগুলোকে দুর্বল করা। তাই আলেম সমাজ ও ইসলামী দলগুলোকে এর বিরুদ্ধে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে এবং ব্যাপক জনমত তৈরি করতে হবে। মনে রাখতে হবে আন্তর্জাতিক ও তাদের দেশীয় সমর্থক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রধান টার্গেট হচ্ছে এমন সব আধূনিক তরুণদের রিক্রুট করা যারা মূলত বর্তমান ব্যবস্থা ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতি খুবই ক্ষুব্ধ। যেহেতু সেসব তরুণ শ্রেণি ইসলাম সম্পর্কে খুব কমই জ্ঞান রাখে তাই তাদেরকে জিহাদের ব্যাপারে বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে পরকালে অতি সহজেই বেহেশত লাভের পথ দেখায়। সে সব তরুণরা জানে না যে অমুসলমানকে হত্যা করলেই বেহেশতে যাওয়া যায় না বরং এর মাধ্যমে তারা মারাত্মক পাপে লিপ্ত হচ্ছে এবং ইসলাম ও মুসলমানদের সমূহ ক্ষতি সাধন করছে। ফলে জাহান্নামে যাওয়ার পথই তারা প্রশস্ত করছে। মনে রাখতে হবে যে ধর্ম বিষয়ে বাড়াবাড়ি, উগ্রতা ও চরমপন্থা নিজেদের ও উম্মাহর ধ্বংসের কারন। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার প্রসারই হচ্ছে চরমপন্থা ও সন্ত্রাস মোকাবিলার প্রকৃষ্ট পথ। মুসলিম দেশে যারা ইসলামের শিক্ষার প্রসারকে উন্নতি, অগ্রগতি ও শান্তির অন্তরায় মনে করে তারাও মূলতঃ চরমভাবে ভ্রান্ত। সন্ত্রাসবাদের হাত থেকে যেমন তরুণদের রক্ষা করতে হবে ঠিক তেমনিভাবে ঐসব বিভ্রান্ত এবং আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের দালাল শ্রেণির হাত থেকেও তাদের রক্ষা করতে হবে। আর এ দায়িত্ব পালন করার জন্য উম্মাহর হিতাকাঙ্খী শ্রেণি তথা আলেম উলামা ও উম্মাহপ্রেমিক শ্রেণিকে এগিয়ে আসতে হবে।

শেষ কথা
মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী-জায়নবাদী যড়যন্ত্র চক্রান্ত বন্ধ হলেই সন্ত্রাস স্থায়ীভাবে বন্ধ হতে পারে। এও মনে রাখা দরকার যে যেসব পণ্ডিত ব্যক্তি ও মিডিয়া প্রতিদিন ইসলামের শিক্ষার বিরুদ্ধে, আলেম সমাজের বিরুদ্ধে, ইসলামি আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন এবং দেশকে ধর্মহীন সেক্যুলার বানাবার উপদেশ খয়রাত করেন তারাই বরং বিক্ষুব্ধ তরুণদের আরো ক্ষেপিয়ে তুলছেন এবং পরোক্ষভাবে হলেও সন্ত্রাসের উস্কানি দিচ্ছেন। যারা জিহাদি বইয়ের নামে ইসলাম সংক্রান্ত বইয়ের প্রসার বন্ধ করার যড়যন্ত্র করছেন তারাও সন্ত্রাসকে বন্ধ নয় বরং উসকে দিচ্ছেন। মূলত ইসলামের মহান ও মানবিক বাণী তুলে ধরতে পারলেই সমাজে মানবিকতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হবে। ইসলামের বিরুদ্ধে, ইসলামি শিক্ষার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা বন্ধ করলেই আমাদের সমাজে সন্ত্রাস সৃষ্টির কার্যকারণ অনেকটা বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া সর্বস্তরে বিশেষতঃ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইসলামের আলোকে পুনর্গঠন করলেই আমরা তরুণদের মধ্যে ইসলামের মানবিক ভাবধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হবো। তাই সরকার যদি আন্তরিকভাবে সন্ত্রাস নির্মূল করতে চান তাহলে বর্তমান সেক্যুলার ভাবধারা পরিবর্তন করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইসলামী ভাবধারায় গড়ে তুলতে হবে। সাথে সাথে আমরা আশা করি পশ্চিমাপন্থী পণ্ডিত ব্যক্তিরা তাদের জাতি ও ধর্মবিরোধী ভূমিকা পরিবর্তন করে ইতিবাচক ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসবেন। তাতেই সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্মের কল্যাণ। চলুন আমরা সবাই সে কল্যাণকেই আকড়ে ধরি এবং সমাজ থেকে সন্ত্রাস ও চরমপন্থা নির্মূলে এগিয়ে আসি।

মহাসচিব, খেলাফত মজলিস।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ