শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


নিভৃতচারী চার আলেম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আবদুল্লাহ বিন রফিক
আওয়ার ইসলাম

অল্প-বিস্তর পড়া-শোনা অনেকেই করেন। লক্ষ্য থাকে অনেক বড় হওয়ার। ধ্যানে জ্ঞানে পরমে থাকে ডানা মেলে আকাশে উড়বার অদম্য বাসনা। তাদের অনেকে বড়ও হন একদিন। যশ-খ্যাতি তাদের গলায় ফুলের মাল্য পরিয়ে দেয়। সবাই তাকে চেনে। শ্রদ্ধা করে। বরণ করে। তারা নন্দিত।

কিন্তু আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানুষ আমাদের সবার আড়ালে থেকে যায়। যারা নীরবে নিরালায় সবার অজান্তে মানুষের জন্য, সমাজের কল্যাণে, দেশের হিতে এবং বিশ্ব মানবতার সেবায় তিলতিল করে আপন অস্তিত্ব বিকিয়ে দিয়ে চলেছেন। জীবনের উষালগ্ন থেকে যারা ব্রতী হয়েছেন উন্নত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে, আদর্শ জাতি গঠনে এবং বিশ্ব সংসারের কুশল কামনায়।

সাফল্য ও কর্মবৈচিত্রের এই পড়ন্ত বেলায়ও যারা নিরন্তর সাধনা করে চলেছেন। তাদের ভুলে যাওয়া বড় অন্যায়। বরং তারা আরও বেশি শ্রদ্ধার পাত্র। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা আসে অন্তরের গহন থেকে। তাদের গলায় সাফল্যের মালা দান হয় ভালোবাসার টানে, আত্মার শক্তিতে। তাদের মহানুভবতা আকাশসম বরং তারও ওপরে। তাদের নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।

মাওলানা মাহমুদুল হাসান

শৈশবের খুব মেধাবী কারো কথা নিয়ে যদি আলোচনা করা হয় তাহলে মাওলানা মাহমুদুল হাসান সাহেবের নাম বলতেই হবে। সবার মাঝে খুব মেধাবী ও প্রতিভাবান হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন ছেলেবেলাতেই। মাত্র এক মাসে হাফেয হয়েছেন তিনি।

তাও আবার রমযান মাসের তারাবীহকে কেন্দ্র করে। আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে রয়েছে তার গভীর সম্পর্ক। স্রষ্টার সঙ্গে নিবিড় সেতুবন্ধন আরো প্রগাঢ় করে তুলতে এবং সান্নিধ্য পেতে রাতের বেলা ঢুকে পড়েন বিশেষ কক্ষে। এভাবে দীর্ধকালব্যাপী সাধনা করে চলেছেন।

এই মনীষীর জন্ম ১৯৫০ সালে মোমেনশাহী জেলার কোতোয়ালী থানার চরখরিচা গ্রামে। পিতা গালীম উদ্দিন আহমাদ পেশায় ছিলেন একজন শিক্ষক। ছেলেবেলাতেই আলেম হওয়ার বাসনা তীব্র হয়ে উঠে। দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেন পাকিস্তানের বিন্নুরি টাউন থেকে। এরপর হাদিস, ফিকহ, তাফসীর ও আরবি ভাষা বিষয়ে আরো চার চারটি ডিগ্রি অর্জন করেন পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদরাসা থেকে।

অবদান ও কর্মজীবন

খতীব, গুলশান সেন্ট্রাল আজাদ মসজিদ ও ঈদগাহ সোসাইটি।(২৭ বছর যাবত)। প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদিস,
জামি‘আ ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ি (৩৭ বছর)। ভূতপূর্ব সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামি‘আ ফারুকিয়া করাচি, পাকিস্তান। আমীর, মজলিসে দাওয়াতুল হক বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্ঠপোষক, ইসলামি ম্যাগাজিন মাসিক আল-জামিয়া।

তার উল্লেখযোগ্য উস্তাদবৃন্দ হলেন, যুগের অন্যতম খ্যাতনামা হাদিস বিশারদ মাআরিফুস সুনান রচয়িতা শায়খ ইউসুফ বানূরী। পাকিস্তানের মুফতীয়ে আজম শায়খ ওয়ালী হাসান রহ.। পাকিস্তানের বেফাক প্রধান ও মুরুব্বি শায়খ সালিমুল্লাহ খান

তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। উল্লেখযোগ্য রচনাবলীর মধ্যে আছে-

তাফসীরে বুরহানুল কুরআন

কুরআনে কারীমের শব্দের তারকীবী অবস্থান ও বালাগাত ফাসাহাত-এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তাৎপর্যকে সামনে রেখে কৃত বিশুদ্ধ ও বৈশিষ্ট্যময় তর্জমা এবং সংক্ষিপ্তভাবে যাবতীয় ফাওয়ায়েদ সম্বলিত তাফসীর। মাদরাসার ছাত্র ও কুরআন বুঝতে আগ্রহী জ্ঞান পিপাসু পাঠকদের জন্য বিশেষ উপকারী।

আর রদ্দূল জামীল

শিক্ষালয়, পথঘাট ও কর্মস্থলসহ সর্বত্রই আজ পুরুষ-মহিলার অবাধ মেলামেশা ব্যাপকতা পাচ্ছে। এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহল তাতে হাওয়া দিচ্ছে। বিগত ২০০৯ ইং সালের ডিসেম্বরে মক্কা মোকাররমার ‘আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার’ বিভাগের প্রধান ড. আহমদ আল গামেদীও সেটাকে বৈধতা দেয়ার ব্যর্থ প্রয়াস চালান।

গ্রন্থটি তারই জবাবে সাহিত্যপূর্ণ আরবি ভাষায় রচিত। প্রকাশের পরক্ষণেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে এটি আরববিশ্বে ঝড় তুলে। ড.গামেদী স্বীয় অভিমত প্রত্যাহার করেন। পুরো বিশ্বের ওলামায়ে কেরামের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে। পবিত্র কুরআন-হাদিসের সুস্পষ্ট দলিল ও মানব-বিবেকের রশ্মিতে রচিত গ্রন্থটি আরবি ভাষাজ্ঞানে সমৃদ্ধ প্রতিটি আলেমের পাথেয় হতে পারে।

আরইরশাদ ইলা সাবিলীর রাশাদ

মুহিউসসুন্নাহ হযরতের কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, কুয়েতসহ বেশ কয়েকটি আরব দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশগুলোতে সফরকালে তার জ্ঞানগর্ভ ও আধ্যত্মপূর্ণ বয়ানের আরবি সংকলন।

এছাড়াও তার রচিত ও অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে আছে-

নবী পরিবারের প্রতি ভালবাসা, আল-বুরহানুল মুআইয়াদ, তোহফায়ে আবরার, আহকামে মাসাজিদ এক মিনিটের মাদ্রাসা, যুবক-যুবতীদের প্রতি উপদেশ, বর্তমান পরিস্থিতি এবং আমাদের করণীয়, মা’আরেফে আবরার মাজালিসে আবরার, হায়াতে আবরার, হক্বের দাওয়াত, হজ্বের হুকূক, নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাবা চত্বরের আহবান, ওযীফাতুস সালেকীন, হজ্ব মোবারক, আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব, শবে বরাতের আ’মল, হাদীসের আলোকে মুক্তির সঠিক পথ, আশরাফুন নেযাম ও আশরাফুন নাসায়েহ, দুনিয়া-আখেরাতে সফলতার পাথেয় ইত্যাদি।

মাওলানা আবূ তাহের মিসবাহ

সবার কাছে অতি পরিচিত এক নাম। বিশেষত আরবি ভাষা শিক্ষার্থী ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় এক অধ্যায়ের নাম আবু তাহের মিসবাহ। বাংলাদেশে যারা আরবি ভাষা নিয়ে যারা নিরন্তর সাধনা করে যাচ্ছেন তিনি তাদের অন্যতম এবং শীর্ষস্থানীয় একজন আলেমে দ্বীন। জীবনভর ইলম ও ভাষা চর্চায় ছিলেন আত্মনিবেদিত।

জীবনের সোনালী মুহূর্তগুলো বিকিয়ে দিয়েছেন সাধনা, ত্যাগ ও বলিদানের উপাখ্যান তৈরিতে। তাঁর জীবনে মার্গ দর্শনের ভূমিকায় ছিলেন শায়খুল হাদিস মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী দা. বা.। কওমী মাদরাসার শরহে বেকায়া, জালালাইনের শিক্ষাবর্ষগুলো পড়েছেন পটিয়া মাদরাসায়। তখন শায়খ সুলতান যওক নদভী ছিলেন তার জীবনের পরম আলোকবর্তিকা।

আরবি ভাষার রুচি ও সাহিত্যবোধের শেকড় রোপিত হয় সেখান থেকেই। নদীর স্রোতে বহমান সময়ের তালে জীবনের ছন্দকে সমান গতিতে এগিয়ে নিতে তৎপর থেকেছেন সদা। সময়ের প্রতি যত্নশীলের ভূমিকা পালন করে আসছেন তারুণ্যের সেই বসন্ত বেলা থেকে।

জীবন বিনির্মাণের আঁধার লগ্নের সূচনা থেকে। তখন থেকেই ছন্দবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল জীবনের পণ গ্রহণ করেছেন। নেমেছেন শিক্ষা-সংস্কারের মহৎ উদ্দোগে। আধুনিক ও সংস্কারবাদী ‘মুজাদ্দিদ’ বলে তখন গালমন্দ শুনেছিলেন অনেক পরিচিত ও অপরিচিত সজ্জন পুরুষদের কাছ থেকে। নাক ছিটকানিও কম শুনতে হয়নি ঘনিষ্ঠজনদের তরফ থেকে।

আলোচনা ও সমালোচনার সূতিকাগারে পরিণত হয়েছিলেন একদিন। থামেননি তবুও। এগিয়ে গেছেন মাতৃসম স্নেহ ও ভালোবাসা ছড়িয়ে। পরিবর্তনের আশায়।

সমালোচনায় যারা কোমরে দড়ি দিয়েছিলেন তারাও একদিন বরণ করে নিলেন এই প্রতিভাবানকে। সাফল্যের পতাকা সবে উড়াতে শুরু করেছেন তিনি। মানযিল অনেক দূর। এখনো অনেকটা পথ চলা বাকি আছে। তাই থেমে নেই তিনি। অবিরাম চলেছেন ভবিষ্যতের দিকে। সেই ত্যাগ তিতিক্ষায় ধোয়া সাফল্যের ছোঁয়া এখন পেতে শুরু করেছে অনেকে।

খ্যাতির বাহনে কখনও উড়েননি। তিনি চান না সেই বাহনে উড়তে। খ্যাতি দিয়ে মানুষ মাপা যায় না তা তিনি ভালো করেই জানেন। তাই নির্জন নিরালা আড়ালই তাঁর প্রিয় সঙ্গ। সেখানে বন্ধু কেবল কলম ও কালি। জ্ঞান ও কর্মরাই সেখানে প্রতীকি মশাল । তারাই সেই নিঃসঙ্গতাকে অপার্থিব সৌন্দর্যে ভরিয়ে তোলে। তবু গুণীজনদের কর্ম, শ্রম ও অবদান বেশিদিন চাপা থাকে না। একদিন তার আলো ছড়াবেই। তার সুবাসে চারিদিক মোহিত হবেই। ফুলকলিরা আসবেই সেখানে জ্ঞানমধু সংগ্রহ করতে।

তার লিখিত সিলেবাস গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-

এসো আরবি শিখি, এটি শিশুদের আরবি ভাষা শেখার প্রাথমিক পর্যায়ের বই। বলতে গেলে গোটা বাংলাদেশেই প্রাথমিক স্তরের ছাত্রদের জন্য এটি বাধ্যতামূলক পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভূক্ত।

এসো কুরআন শিখি, এসো সরফ শিখি, এসো নাহব শিখি, এসো ফিকাহ শিখি, এসো বালাগাত শিখি, এসো উর্দূ শিখি, এসো কলম মেরামত করি, ইসলামকে জানতে হলে।

এছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন ছোটকাগজ ‘পুষ্প’ এবং আরবি ম্যাগাজিন ‘আল-কলম’। পুষ্পের বৃহৎ দুটি ভলিয়ম নিয়েও বের হয়েছে ‘পুষ্পসমগ্র’। প্রবন্ধ, অনুবাদ ও সংকলনের সংখ্যাও কম নয়। যেমন-

বায়তুল্লাহর মুসাফির (সফরনামা), বায়তুল্লাহর ছায়ায় (সফরনামা), আল-হিদায়া (দুই খন্ড), যুহাল ইসলাম (মূল: ড. আহমাদ আমীন), মুসলমানদের পতনে বিশ্বের কী ক্ষতি হলো? (মূল: আলী নাদাবী), আরকানে আরবা‘আ (মূল: আলী নাদাবী), আলমানার (আরবি-বাংলা), আলমানার (বাংলা-আরবি), আপনার আমানত (মূল: শায়খ কালীম সিদ্দীকী) ইত্যাদি।

মুফতী দিলাওয়ার হোসাইন

খুবই সাদামাটা সরল নির্মোহ এক মানুষের নাম। বিনয়ী অথচ উদারচেতা। চাল-চলনে ও উঠা-বসায় বিনয় যেনো মানুষটির নিত্যসঙ্গী। ছাত্রবৎসল ও চিন্তাশীল আলেম হিসেবে সবার কাছে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। প্রাজ্ঞ ফকীহ ও গবেষক বলেই তাঁকে মান্য করেন বর্তমান সময়ের আলিমগণ। আধুনিক অর্থনীতি ও বর্তমান বিশ্বের খুটিনাটি অনেক বিষয়ের জ্ঞান রাখেন তিনি।

হযরত শাহজালালের সাথে ইয়ামান থেকে ৩৬০ আওলিয়ার যে দল বাংলায় এসেছিলেন তাদের একজন হলেন মোল্লা দিওয়ান রহ.। তাঁর পরম্পরার একাদশ পুরুষ হলেন এই মুফতী দিলাওয়ার। পিতা মাও. দ্বীন মুহাম্মাদ।

১৩৮৭ হি. মোতাবেক ১৯৬৭ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। ১৩৯৪ হি. মোতাবেক ১৯৭৩ সালে জামিয়া হুসাইনিয়া মাদানিয়া মুনশিরহাট ভর্তি হয়ে হিদায়াতুন্নাহু পর্যন্ত পড়া-লেখা শেষ করেন। এখানকার প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। উর্দূ ও ফার্সিতে বেশ পাকাপোক্ত হয়ে উঠেন এখানে এসে ।

তখনকার চিঠি-পত্রগুলো তাই উর্দূ-ফার্সিতেই লিখতেন। ১৩৯৯ হি. মোতাবেক ১৯৭৮ সালে চাঁদপুর শাহরাস্তির খেড়ীহর মাদরাসায় কাফিয়াতে (নবম শ্রেণিতে) ভর্তি হন। আগের মতো প্রথম স্থান ধরে রেখে এখানেও চার বছরের শিক্ষাবর্ষ সমাপ্ত করেন।

১৯৮২ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য চলে আসেন ঢাকার ‘জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদরাসায়। ১৯৮৫ সালে এখানকার শিক্ষা সমাপনী শেষে চলে যান পাকিস্তানের করাচিতে। সেখানে ভর্তি হন পাকিস্তানের আযহার খ্যাত জামিয়া দারুল উলূম করাচিতে। এবং দীর্ঘ এগারো বছর শায়খুল ইসলাম তাকী দা. বা. এর সান্নিধ্যে থাকেন। কিছুকাল করাচীতেও অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯৫ সালে ফিরে আসেন ঢাকায়। যোগদান করেন মারকাযুদ্দাওয়া আল-ইসলামিয়াতে। ২০০০ সালে মসজিদুল আকবার কমপ্লেক্সকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলেন জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম ঢাকা। এই মসজিদের খতিবও তিনি। শুক্রবার বাদ মাগরিব শায়খের তাফসীর মাহফিলে অংশগ্রহন করেন প্রায় হাজারখানেক মানুষ।

দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ চলে আসে এই তাফসীর মাহফিল শুনতে। তাফসীর মাহফিল শেষে মাহফিলের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্ব ‘উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব’ অনুষ্ঠিত হয়। এখানে যে কেউ স্বাধীনভাবে শরীয়তের যে কোনো বিষয় নিয়ে উন্মুক্ত প্রশ্ন করতে পারেন।

ফিকাহ শাস্ত্রে তার দক্ষতা তখন উজ্জ্বল হয়ে উঠে। বাংলাদেশের বিভিন্ন উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিকহ ও ফাতাওয়া গবেষণা কর্মের সাথে তিনি জড়িত।

তার উল্লেখযোগ্য রচনাবলীর মধ্যে আছে-

ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসাম, শবে বরাতের তত্ত্বকথা, আশ শরহুন নাযির (তাসকীনুল আরওয়াহ ওয়ায যমায়ির) (আরবি), আস সরাহা ফি লায়লাতিল বরাআহ (আরবি), শবে বরাত কী হাকীকত উর্দূ), আততিবয়ান ফী লাইলাতিন নিসফ মিন শা’বান (আরবি), এছাড়াও তাঁর লিখিত আরবিতে অনেক গ্রন্থাবলী আছে।

মাওলানা আব্দুল মালেক

এই মহান মণীষীর জন্ম ১৯৬৯ সালে কুমিল্লায়। পিতাও একজন আলেমে দ্বীন। বিদ্যা, প্রজ্ঞা ও মার্জিত আচরণের জন্য যিনি গোটা উপমহাদেশের আলিম সমাজের কাছে অতি পরিচিত। শুধু উপমহাদেশ কেনো, আরব বিশ্বের কাছেও যিনি গবেষক ও জ্ঞানপিপাসুর খেতাব জিতে নিয়েছেন। ধ্যান-জ্ঞান ও একাগ্রতাই ছিলো যার সারা জীবনের শিক্ষা। শিক্ষাজীবন শুরু হয় চাঁদপুর শাহরাস্তির খেড়িহর কওমী মাদরাসা দিয়ে।

তারপর পাকিস্তানের করাচি বিননূরী টাউন জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া থেকে তাকমীল সমাপ্ত করেন। তারপর সেখানেই শায়খ আব্দুর রশিদ নু’মানীর তত্ত্বাবধানে তিন বছর হাদীসশাস্ত্রে তাখাস্সুস করেন। তাখাস্সুস শেষ করেন ১৯৯১ সালে। তারপর দু’ বছর দারুল উলূম করাচিতে শায়েখ তাকী উসমানীর তত্ত্বাবধানে ফিকাহশাস্ত্রে তাখাস্সুস শুরু করে ১৯৯৩ সালে সমাপ্ত করেন।

তাখস্সুস সমাপনী শেষে সৌদি আরবের রিয়াদে শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ-এর তত্ত্বাবধানে প্রায় আড়াই বছর ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত হাদীসশাস্ত্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণার কাজ করেন।

জ্ঞান সাধনায় অনুরাগ ও একাগ্রতার উদাহরণ পাওয়া যায় একটি ঘটনায়-পরম একাগ্রতা ও আত্মনিবিষ্ট হয়ে অধ্যয়ন করছিলেন দারুল উলূম করাচির লাইব্রেরীতে। এদিকে লাইব্রেরীয়ান নির্ধারিত সময় দায়িত্ব পালন শেষে লাইব্রেরীয়ান তালাবন্ধ করে চলে যায়।

ওদিকে তিনি লাইব্রেরীতে বসে তিনি অধ্যয়ন করছেন। পড়া-শোনায় এতটাই নিমগ্ন ছিলেন যে. লাইব্রেরী খোলা না বন্ধ ওদিকে খেয়ালই আসেনি। পরে উস্তাদগণ খোঁজা-খুজি করে তাঁকে লাইব্রেরী থেকে আবিষ্কার করেন। একটি বিষয় সমাধানের জন্য ঘেঁটেছেন হাজার হাজার গ্রন্থ। সমাধান ও আবিষ্কারের প্রতি এই শায়খের আগ্রহ অদম্য ও ঈর্ষণীয়। চোখে পড়ার মতো।

১৯৯৬ সালে তিনি ও তার বড় ভাই মুফতী আবুল হাসান আব্দুল্লাহ এবং মুফতী দিলাওয়ার সাহেব মিলে ঢাকায় উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা ও দাওয়া প্রতিষ্ঠান ‘মারকাযুদ দাওয়াহ আল-ইসলামিয়া’ প্রতিষ্ঠা করেন।

বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাসচিব এবং উলূমুল হাদীস অনুষদের প্রধান। ২০০৫ সাল থেকে মারকাযুদ দাওয়াহ আল-ইসলামিয়ার মুখপত্র মাসিক আল-কাউসারের প্রকাশনা শুরু হয়। তখন থেকে আজ অবধি এই জনপ্রিয় ম্যাগাজিনের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

তাছাড়া তিনি ঢাকার শান্তিনগর আজরুন কারীম জামে মসজিদের খতিবের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ২০১২ সালে গঠিত বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা কমিশনেরও তিনি একজন সদস্য।

তিনি মাসিক আল-কাউসারসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ফিকহ, হাদীস, তাফসীর ও আকীদাসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণালব্ধ যেসব প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও ভূমিকা লিখেছেন তার সংখ্যাও কম নয়। দীর্ঘকালের গবেষণা ও শ্রমলদ্ধ সাধনার পর যে সারাংশ ও সারনির্যাস উপস্থাপন করেছেন তা মণি-মানিক্যের চে’ বহুগুণে দামি ও মূল্যবান।

যা আমাদের মতো সাধারণ ছাত্রদের সমাধান করতে বেশ সময় লেগে যাবে। তার রচনা ও গ্রন্থাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো,।

১. তালিবুল ইলমের পথ ও পাথেয়

এই বইটি মূলত ছাত্রদের বিভিন্ন বিষয় ও গ্রন্থে আরোপিত আপত্তি ও জটিল সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে মাসিক আল-কাউসারে যে সব প্রশ্ন করা হয়েছে তার খোলাখুলি সমাধান দেওয়া হয়েছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে বিশদভাবে জ্ঞানমূলক তথা অ্যাকাডেমিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যার ফলে এই বইটি একজন তালিবুল ইলম তথা শিক্ষার্থী ও আলেম উভয়ের জন্য এক অতুলনীয় নাযরানা।

২. উম্মাহর ঐক্য: পথ ও পন্থা

এটি মূলত ‘উম্মাহের ঐক্য’ শিরোনামে একটি সেমিনারের ভাষণের লিখিত রূপ। একশ্রেণীর মানুষ আছেন যারা হাদিসের কিছু বই পড়ে গড়গড় করে ফাতাওয়া দিতে থাকেন। যারা মাযহাব মানেন তাদেরকে এবং তাদের আমলকে ঢালাওভাবে ভুল বলতে থাকেন । আহলে হাদীস বা গায়রে মুকাল্লিদ নামে যারা বেশ পরিচিত।

শতবর্ষব্যাপী উম্মাহের দলিলসিদ্ধ স্বীকৃত নিয়ম ও সুন্নাহকে পর্যন্ত অস্বীকার করে দিতে একটুও চিন্তা করেন না তারা। বিশেষতঃ তাদের এমন কর্মের ভয়াবহ পরিণতির দিকে আলোকপাত করেছেন । গায়রে মুকাল্লিদ ভাইদের প্রতি এবং যারা মাযহাব মানেন তাদের প্রতিও তিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জোড়ালো চিন্তা-ভাবনার পরামর্শ দিয়েছেন বক্ষমাণ বইটিতে।

৩. প্রচলিত ভুল

এটি মূলত মাসিক আল-কাউসারে প্রকাশিত সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন ভূল, কুসংস্কার ও হাদীসের নামে প্রচলিত বানোয়াট গাল-গল্প ইত্যাদি এসব বিষয় নিয়ে যা কিছু লেখা হয়েছে তার সংকলন। এই বইটি সকল পাঠকের জন্য সমান উপকারী।

৪. হাদীস ও সুন্নায় নামাযের পদ্ধতি, ৫. তারাবীর রাকাআত সংখ্যা ও ঈদের নামায, ৬. ঈমান সবার আগে
৭. তাছাউফ ও তত্ত্ব বিশ্লেষণ, ৮. প্রচলিত জাল হাদিস, ৯. প্রবন্ধ সমগ্র ১, ২, ১০. আল-মাদখাল ইলা উলূমিল হাদীসিশ শরীফ (আরবি)।

এই বইটি উলূমুল হাদিস বিষয়ক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যা বিভিন্ন গ্রন্থে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শায়েখ এতে সেগুলো একত্রিত করে দিয়েছেন। তাছাড়া শায়খ আব্দুর রশিদ নুমানী রহ.-এর মূল্যবান একটি ভূমিকাও আছে এতে।

আরবের একজন খ্যাতনামা বিদ্যান শায়খ আওয়ামা দা.বা. ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এই বইটির। এই বইটি আফ্রিকা সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন মাদরাসার উলূমুল হাদিস অনুষদে পাঠ্যতালিকার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

‘ইসলামি দলগুলোকে জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে সর্বদলীয় প্লাটফরম জরুরি’

রক্তনদী পেরিয়ে কুরআন পাঠ

আরআর


সম্পর্কিত খবর