শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


কওমি সনদের স্বীকৃতি : বির্তকের ডান বাম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ এহসানুল হক

ehsanবর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় কওমি সনদের স্বীকৃতি। ঘরে-বাইরে, গল্পে-আড্ডায় সবার মাঝে একই আলোচনা। কেউ পক্ষে কেউ বিপক্ষে। চলছে আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বির্তক। প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন প্রেক্ষাপট। ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি।

ফরিদ মাসুদ সাহেবের নেতৃত্বাধীণ ৯ সদস্য বিশিষ্ট আহবায়ক কমিটি গঠন নিয়ে বির্তক শুরু হবার পর গত রবিবার সরকার আবার নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। আল্লামা আহমদ শফি সাহেব নেতৃত্বাধিন কমিশনের মেয়াদ তিন মাস বৃদ্ধি করা হয়েছে। অনেকে এটাকে বিজয় হিসেবে দেখলেও এটাকে বিজয় ভাববার কোন অবকাশ নেই। সরকার মূলত পরিস্থিতি দেখে ভোল পাল্টাচ্ছে।

এই কমিশনের উপর যদি সরকারের আস্থা থেকেই থাকে তাহলে এই কমিশনের সাথে আলোচনা না করে ফরিদ মাসুদ সাহেবের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি করে বির্তক সৃষ্টি করা হলো কেন? বির্তক পূর্ণমাত্রায় জমে উঠার পর এখন আবার কেন আগের কমিটির মেয়াদ বাড়ানো হলো? আসল কথা হলো, একবার বেফাককে মাইনাস করে অন্যদের আগানো হয়েছে, এখন আবার তাদেরকে কিছুটা পিছনে ফেলে বেফাক ও সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমদের এগিয়ে দেয়া হয়েছে। যেন জমজমাট খেলা। চলছে টানটান উত্তেজনা। যে কোন মূহুর্তে এগিয়ে যেতে পারে যে কেউ। খুব সহজেই বুঝা যায় এখানে সরকারের সদিচ্ছা নেই। সদিচ্ছা থাকার কোন কারণও নেই।

কওমি সনদের স্বীকৃতির আলোচনায় অনেক ধরণের পক্ষ থাকলেও বিবাদমান পক্ষ দুটি। এক. ফরিদ মাসুদ সাহেব ও তার সঙ্গে অন্যান্য বোর্ড। দুই. বেফাক ও সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামায়ে কেরাম। প্রথম পক্ষ স্বীকৃতি চাচ্ছে। বিভিন্ন কারণে তারা সরকারি আনুকল্য প্রাপ্ত হওয়ায় সরকারও তাদের মাধ্যমে স্বীকৃতি প্রদানে আগ্রহ দেখাচ্ছে। অপরদিকে দ্বিতীয় পক্ষ স্বীকৃতির ব্যাপারে আগ্রহী হলেও সরকার প্রণিত পদ্ধতিতে স্বীকৃতি গ্রহণ করতে চাচ্ছে না।
স্বীকৃতি গ্রহনের ব্যাপারে দুই পক্ষ এক মত হলেও বিরোধ পদ্ধতিগত ব্যাপার নিয়ে। এখন বেফাকের দাবি হচ্ছে, ‘সরকারের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি বাতিল করতে হবে, তার আগে স্বীকৃতি নয়।’ এখান বির্তক হওয়া উচিত শুধু মাত্র স্বীকৃতি গ্রহনের পদ্ধতিগত বিষয় নিয়ে। অন্য কিছু নয়। কিন্তু মূল পয়েন্টে বিতর্ক দেখছি না। বির্তক হচ্ছে সব ভিন্ন বিষয় নিয়ে। বেফাকের মিটিং এ কে গেল, আর কে গেল না। কে বিমানের টিকেট পেল, আর কে পেল না। কে বিএনপি, কে আওয়ামী লীগ, বেফাকের এতদিনের ব্যার্থতা কি কি?

আলোচনা হচ্ছে এসব ডান বামের বিষয় নিয়ে। স্বীকৃতি নিয়ে বেফাকের মূল দাবি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। বেফাকের অন্যান্য বিষয় নিয়ে যে কারো প্রশ্ন থাকতেই পারে। থাকতে পারে আপত্তি। কিন্তু এখন সেই আপত্তির সময় নয়। এখনকার আলোচ্য বিষয় একমাত্র কওমি সনদের স্বীকৃতি। স্বীকৃতি বিষয়ে বেফাকের বক্তব্যের সাথে হয়তো সহমত পোষন করতে হবে, নয়তো দ্বিমত। কিন্তু এখন বেফাকের অন্যান্য বিষয় নিয়ে আপত্তি তুলে পরিবেশ ঘোলা করার কোন সুযোগ নেই। যদি তা করা হয়, তাহলে বুঝতে হবে এখানে মহল বিশেষের দুরভিসন্ধি সক্রিয় আছে।

চলমান বির্তকের অনেকই দলীয় রাজনীতি টেনে আনছেন। হাটহাজারির বৈঠকে জমিয়ত ছাড়া আর কেউ যায়নি। বেফাকের উপর জমিয়তের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এসব আলোচনা এখন কেন? বেফাক কি জমিয়তের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে? বেফাকে তাদের লোক সংখ্যায় বেশি হলে তো বেফাক অগ্রহণযোগ্য হয়ে যেতে পারে না। বেফাকের বর্তমান অবস্থানের সাথে যদি দ্বিমত থাকে তাহলে সেটা বলুন। জমিয়তকে কেন টেনে আনছেন? আমরা হয়তো নূর হোসাইন কাছেমি সাহেবের দল করি না। কিন্তু তিনি যখন বেফাকের পক্ষ থেকে কোন ভুমিকা পালন করবেন তখন তাকে জমিয়ত নেতা হিসেবে দেখা হবো কোন। দেখতে হবে তার ভুমিকা কি? যদি তার ভুমিকার সাথে একমত না হন তাহলে সেটা বলুন। কিন্তু সেটা না বলে তিনি জমিয়ত নেতা এই দোহাই দেয়া অন্যায়।

তবে হ্যা এক্ষেত্রে জমিয়তেরও উচিত সতর্ক পদক্ষেপ রাখা। যাতে করে প্রভাব খাটানোর অথবা কোন সুযোগ গ্রহণের অভিযোগ তাদের উপর না আসে। বেফাকের মিটিংয়ে যদি বেফাকের দায়িত্বশীল না হয়েও জমিয়তের নেতা এই প্রভাবে কয়েকজন মিটিং এ হাজির হয়ে যায়, তাহলে নিন্দুকেরা এসব তো বলবেই।

স্বীকৃতির ব্যাপারে সরকারের বক্তব্য এবং সরকারপন্থি আলেমদের তৎপরতা দেখে অনেকেই ভাবছেন স্বীকৃতি তারা দিবেই। অযথা বির্তক করে লাভ কি। অনেকের মত এমন হলেও আমি মনে করি স্বীকৃতির ঘোষণা হয়তো হবে। কিন্তু স্বীকৃতির প্রকৃতরূপ বাস্তবায়িত হবে না। আমার এটা মনে করার যথেষ্ট কারণও আছে। কারণটা বলি। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি আরেকটি শিক্ষা ধারা চলমান আছে আলিয়া মাদরাসা নামে। আলিয়া মাদরাসাগুলোর সাথে সরকারের আচরণ লক্ষ্য করলেই আপনি বুঝতে পারবেন কেন আমি এই কথা বলছি।

আলিয়া মাদরাসা গুলোতে ধর্মীয় শিক্ষা পূর্ণতা তো দূরের কথা আংশিক পূরণ না হলেও তাদের সঙ্গে বরাবরই সরকার বিমাতা সূলভ আচরণ করছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে মাদরাসা পরিচয় ধারণকারীরা যাতে ভালো সাবজেক্ট না পায় সেই ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে। ভর্তি পরিক্ষাগুলোতে মাদরাসা ছাত্ররা লাগাতার প্রথম স্থান অধিকার করার পরও তারা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শুধুমাত্র মাদরাসা সিলটা থাকার অপরাধে। এই সিলের কারণে ভার্সিটিগুলোতে মাদরাসা ছাত্ররা নিগৃত হচ্ছে। এরপর তারা মাদরাসা পরিচয়টা গোপন করে পড়াশুনা করছে। মাদরাসা এই সিলটা থাকা যেন ক্ষমাহীন অপরাধ। কওমি মাদরাসার ভীতরে বসে থেকে সেটা অনুমান করাও সম্ভব না যে প্রকৃত অবস্থাটা আসলে কি।
এই পরিস্থিতি কিভাবে হয়েছে? সন্দেহ নেই সরকারি মনোভাবের কারণেই হয়েছে। এই হলো যেখানের অবস্থা সেখানে ইসলামের প্রকৃত অনুসারী কওমি মাদরাসার ছাত্ররা নির্ভিগ্নে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর সৌন্দর্য বর্ধন করবে সেটা আপনি কিভাবে কল্পনা করেন। আশপাশের খোজঁ খবর না রাখার কারণে অনেকে এটা বিশ্বাস করলেও আমি করি না। আপনি বলবেন তারা শিবির করে? সব আলিয়ার ছাত্ররা শিবির করে না। আর করলেও কওমিয়ানদের ধরে ধরে শিবির বানিয়ে দেয়া হবে না তার গ্যারান্টি কি? এখন যারা শিবিরের পিছনে লেগেছে তারা কওমিয়ানদের পিছনে লাগবে না তারই গ্যারান্টি কি? আমি বলছি না যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যাবে না। আমি সরকারের মনোভাবটাই বুঝাতে চাচ্ছি।

স্বীকৃতি হয়তো হবে। হয়তো হবে না। সেটা সময়ই বলে দিবে। তবে স্বীকৃতি হোক বা না হোক, একটা কাজ এতদিনে ঠিক মতই হচ্ছে তাহলো- বিবাদ, বির্তক, লাগামহীন কথাবার্তা, বড়দের সাথে বেয়াদবি। বেফাকের পক্ষের লোকদের বলা হচ্ছে বিএনপি ও জামাতের দালাল। আর ফরিদ মাসুদ সাহেবদের পক্ষের লোকদের বলা হচ্ছে আওয়ামী লীগের দালাল।

সন্দেহ নেই কাজটা করছে অল্প বয়স্ক কিছু অবুঝ ফেসবুক ইউজার। কিন্তু দুঃখজনক হলো, বেফাকের উর্ধতন কোন দায়িত্বশীল সরাসরি এধরণের কোন বক্তব্যে না জড়ালেও জনাব ফরিদ মাসুদ সাহেব কিন্তু ঠিকই জড়িয়েছেন। তিনি টিভি ইন্টারভিউতে নির্দ্ধিধায় বলে যাচ্ছেন, ‘স্বীকৃতি তারাই চায় না, যারা জামাত শিবিরের রাজনীতি করে।’ তারা বিএনপির রাজনীতি করে এতটুকু সম্মান দেখাতেও তিনি রাজি নন।

তাহলে বেফাক ও হাটহাজারিসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ সবাই জামাত শিবিরের রাজনীতি করেন? তিনি একথা কিভাবে বললেন? তার মত একজন ব্যক্তি থেকে এধরণের বক্তব্য কাম্য ছিল না। তিনি যখন বক্তব্য দেন আমার মাথার মূল্য শফি সাহেবের পায়ের সমান না তখন এধরণের বক্তব্য রাখা অন্যায়। দ্বিমুখিতা ছাড়া আর কিছু নয়।

বেফাকের উদ্দেশ্যেও কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করে। আমরা অনেক ছোট। আমরা বেফাককে পরামর্শ দেয়ারও যোগ্যতা রাখি না। তবে সন্তান হিসেবে কিছু আবদার করতে পারি। বেফাককে ভালোবাসি। কোন অবস্থাতেই বেফাক দূর্বল হোক সেটা কামনা করি না। ভালোবাসার এই দাবি থেকেই দুই একটা কথা আরজ করতে চাই।

এক. বেফাক দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে স্বীকৃতির দাবি করেছে। আজ যখন সরকার স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছে তখন বেফাক সেটা নিতে চাচ্ছে না। হতে পারে এই নিতে না চাওয়ার পিছনে যথেষ্ট পরিমাণ যৌক্তিক কারণ আছে। কিন্তু কোন কারণ ব্যাখ্যা করা ব্যতিত যদি বলে দেয়া হয় ‘আমরা স্বীকৃতি চাই না’ তাহলে সেটা মানুষ কিভাবে গ্রহণ করবে? স্বীকৃতি নিতে না চাইলে কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। সেটা শুধু সরকারের কাছে নয়। বেফাকের মূল বক্তব্য কি? বেফাকের মূল আপত্তি কোথায়? সেটা স্পষ্ট করে বলতে হবে। বুঝাতে হবে। কওমি প্রতিটা সন্তান যেন ব্যাপারটা বুঝতে সক্ষম হয়। এতদিন কেন চেয়েছি। এখন কেন চাচ্ছি না। এখন কিভাবে চাই। এই ব্যাপারগুলো স্পষ্ট থাকা প্রয়োজন।

দুই. বেফাকের দায়িত্বশীলগন সবাই অনেক সিনিয়র। মূল দায়িত্বশীলগণ সিনিয়র হবারই কথা। তবে আমাদের কাছে মনে হয় মূল দায়িত্বশীল আর ছাত্রদের মাঝে বিশাল একটা গ্যাপ রয়ে গেছে। এই গ্যাপ দূর করা প্রয়োজন। পরিচ্ছন্ন মন মানসিকতার অধিকারি কওমি মাদরাসার প্রকৃত চেতনাধারী কিছু নবীন আলেমদের কাজে লাগানো দরকার। তাদের মাধ্যমে এই দূরত্ব কমিয়ে আনা প্রয়োজন।

তিন. আলেমগন রাজনীতি করবেন। বেফাকের মধ্যেও ইসলামি রাজনৈতিক দলের নেতারা থাকবেন তাদের যোগ্যতা অনুসারে এতে কোন আপত্তি নাই। তবে কথা আছে। কথা হলো, কিছু রাজনীতিবিদ আলেম কি শুধু বেফাকের জন্য তৈরি হতে পারেন না? রাজনীতিবিদ আলেমদের বেফাক থেকে বাদ দেয়া হোক সেটা বলতে চাই না। বরং বেফাকের জন্য কিছু রাজনীতিবিদ আলেম নিবেদিত হোক। রাজনীতি ছেড়ে আসার কোন প্রয়োজন নেই। শুধু মহাসচিব জাতীয় ভাইটাল পোষ্ট থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া যায় না। দলীয় রাজনীতি করার মানুষের অভাব নেই। কিন্তু আপনাদের মত কিছু ব্যক্তির অভাব বেফাকে রয়েছে। কিছু মানুষ যদি এ কাজটা করতে পারেন তাহলে একদিকে বেফাক তাদের দ্বারা উপকৃত হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের নেতা এই অভিযোগের মাত্রাটাও কমে আসবে।

এ কথা সবাই স্বীকার করবে। আমাদের মাঝে এখন সবচেয়ে বেশি অভাব ঐক্যের। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আমাদের মাঝে অনৈক্য বিরাজ করছে। ছোট ছোট দলে উপদলে আমরা বিভক্ত হয়ে পড়েছি। যেখানে সবশ্রেণির উলামায়ে কেরাম একত্রে বসতে পারে এমন জায়গার সংখ্যা অনেক কম। দুএকটি জায়গা যা আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো বেফাক। যেখানে সবাই এসে এক কাতারে শামিল হয়। বেফাক এখনো আস্থার প্রতিক। তাই এই জায়গা যেন নষ্ট না হয়। একটা জায়গা অন্তত বিতর্কের উর্ধে থাকা দরকার। আমাদের আকাবের উলামায়ে কেরামের অনেক ত্যাগও কুরবানির ফসল এই বেফাক। এই প্রতিষ্ঠান কোনভাবে আমরা ধ্বংস হতে দিতে পারি না।

এফএফ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ