শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫


সব ইসলামি শক্তি একত্রিত হলে কোনো অপশক্তিই আমাদের রুখতে পারবে না: অধ্যক্ষ ইউনুস আহমাদ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

unus_ahmadবাংলাদেশের অন্যতম বড় একটি রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় সংগঠনের নাম ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বরিশালের প্রত্যন্ত অঞ্চল চরমোনাইয়ের দীর্ঘদিনের একটি ঐতিহ্যবাহী পীর পরিবারের প্রথাগত গদীনশীনতার ধারা ভেঙ্গে সহসা রাজনীতির মাঠে আবির্ভূত হয়েই চমক লাগিয়েছেন এবং দ্রুততম সময়ে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন যিনি তার নাম মরহুম মাওলানা ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাই। বর্তমানে এ সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারই ছেলে মুফতি রেজাউল করীম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির। দলটির মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমাদ। আওয়ার ইসলামের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে কথা বলেছেন আমাদের সিনিয়র প্রতিবেদক জাকির মাহদিন

জাকির মাহদিন : ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশে’র সঙ্গে দেশের চলমান অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর পার্থক্য কোথায়?
ইউনুস আহমাদ : ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সবাই একটি বিশেষ চেতনা লালন করে। তা হচ্ছে, সর্বাবস্থায় ইসলামের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া; ইসলাম-দেশ-জাতি-মানবতার স্বার্থে কাজ করা। জাগতিক কোনো স্বার্থ, ভয় বা লোভ-লালসার কারণে ইসলামের আদর্শ থেকে বিচ্যুতি- এটা ইসলামী আন্দোলনের কেউ করে না। যে কারণে বিভিন্ন দিক থেবে বহু অফার পাওয়া সত্ত্বেও আমরা সেসবে যাই না। বিশেষ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ রাজনীতিকে নামাজ-রোজা-হজ-যাকাতসহ অন্যান্য ইবাদতের মতোই একটি ইবাদত মনে করে।

জাকির মাহদিন : সব ইসলামি রাজনৈতিক দলই তো ইসলামের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয় বলে জানায়। এক্ষেত্রে কারা অধিক সত্যবাদী এবং সবাইকে সাথে নিয়ে চলার চেষ্টা করছে উদ্যোগ নিচ্ছে তা আমরা কিভাবে বুঝব?
ইউনুস আহমাদ : আমরা এক্ষেত্রে খুব সহজ একটা কথা বলি, জাগতিক লোভ-লালসা ও ভোগবাদী রাজনীতির মানসিকতা পরিহার করে ইসলামের স্বার্থে আসুন আমরা সবাই এক জায়গায় চলে আসি। ইসলামি শক্তি যাই আছে এখনো, মসজিদ-মাদরাসা, ওলামা-মাশায়েশ, পীর-খানকা। আমাদের মোহতারাম আমিরের কথা হচ্ছে, এখনো ইসলামি শক্তি যা আছে তা যদি এক জায়গায় চলে আসে তাহলে কোনো অপশক্তিই আমাদের রুখে দিতে পারবে না। তবে শর্ত একটাই, জাগতিক লোভ-লালসা ও ভোগবাদী রাজনীতির মানসিকতা পরিহার করতে হবে। এ নিয়ে আমরা বারবার বৈঠক করি। এখন কারও ইচ্ছে হলে আসতে পারে, নাও আসতে পারে।

জাকির মাহদিন : আপনি বাংলাদেশের বৃহত্তম একটা ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের মহাসচিব। এত বড় একটি দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দায়িত্বপালন করতে পারায় যখন বিশেষ বিশেষ জনসভায় লাখ লাখ কর্মী-সমর্থক-জনতার সামনে ভাষণ দেন তখন আপনার অনুভূতি কেমন থাকে?
ইউনুস আহমাদ : অনুভূতি খুবই আনন্দের। কারণ আমরা একটা আদর্শ লালন করি, ইসলামি আদর্শ। দেশের সর্বস্তরের মানুষও এখন বোঝেন যে আমরা আসলে কী চাই, কেন চাই। আমাদের প্রতি জনগণের একটা অভূতপূর্ব সাড়া সৃষ্টি হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে সমর্থন ও সহযোগিতা এসব আপনারাও জানেন। অন্যান্য ইসলামি দলে সাধারণ মানুষ ইসলামের নাম শুনে এসে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়। কিন্তু এটা এমন এক কাফেলা যেখানে কথা ও কাজের মিল আছে।

জাকির মাহদিন : সম্প্রতি মাদরাসা শিক্ষার স্বীকৃতি নিয়ে আলেমসমাজ ব্যস্ত সময় পার করছেন। এ নিয়ে আপনাদের ভূমিকা কী?
ইউনুস আহমাদ : আগে তো আমাদের মন্তব্য, তারপর ভূমিকা। স্বীকৃতি নিয়ে চর্চাটা এখন শুরু হয়নি বরং অনেক আগে থেকেই চলছে। ২০০৬ সালে শায়খুল হাদীস আজীজুল হক সাহেব মুক্তাঙ্গনে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং আমাদের মরহুম আমির ফজলুল করীম (পীর সাহেব, চরমোনাই) সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে আমরা স্বীকৃতি চাই। কিন্তু এখন বিষয়টাতে অনেকটা রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা প্রবেশের কারণে নানা মতবিরোধ এবং মতবিরোধ থেকে মনোবিরোধের সৃষ্টি হচ্ছে। মূলত আলেমদের মনোবিরোধের কারণেই ইসলামবিরোধিরা স্বীকৃতি নিয়ে সময়ক্ষেপনের সুযোগ পাচ্ছে। তাই আলেমদের এসব মতবিরোধ ও মনোবিরোধ পরিহারের বিকল্প নেই।

জাকির মাহদিন : স্বীকৃতি বাস্তবায়ন এবং এ পথের সমস্ত বাধাবিপত্তি দূর করতে বিশেষ করে এ দেশের আলেম-ওলামা ও ধর্র্মীয় দল-সংগঠনগুলোর ঐক্য সৃষ্টির লক্ষে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মতো একটা মজবুত ও বৃহত্তর ধর্মীয় রাজনৈতিক দল কী ভূমিকা রাখছে?
ইউনুস আহমাদ : স্বীকৃতির বিষয়টা শিক্ষা বিষয়ক। এর জন্য বেফাক এবং অন্যান্য কিছু প্রতিষ্ঠান আছে। ওলামায়েকেরামও চেষ্টা করছেন। আর আমাদেরটা যেহেতু রাজনৈতিক সংগঠন, তাই রাজনৈতিক কোনো সমস্যা-ষড়যন্ত্র-অপতৎপরতা দেখা দিলে বা সরকার স্বীকৃতি দিতে না চাইলে সেক্ষেত্রে আমরা জোরালো ভূমিকা পালন করব।

জাকির মাহদিন : ষড়যন্ত্র অপতৎপরতা তো সার্বক্ষণিক চলছেই। তাছাড়া একটি ধর্মীয়-রাজনৈতিক দলের পক্ষে কি ধর্মীয় মতবিরোধগুলো নিরসনের এবং শিক্ষা ও অন্যান্য সমস্যার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই?
ইউনুস আহমাদ : রাজনৈতিক পরিচয়ে রাজনৈতিক মতবিরোধগুলো নিরসনে একটা ভূমিকা থাকে। আর শিক্ষা বা অন্যকোনো বিষয় হলে তার জন্য ওলামায়েকেরাম আছেন। তারপরও যদি স্বীকৃতির পথে বিশেষ প্রতিবন্ধকতা আসে তবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ অবশ্যই এক্ষেত্রে কাজ করবে এবং বিশেষ পদক্ষেপ নেবে।

জাকির মাহদিন : একটা বৃহৎ রাজনৈতিক দল বা গুরুত্বপূর্ণ সংঘ-সংগঠনের উঁচু পদে যেতে কি কষ্ট-কুরবানির পাশাপাশি নিজের স্বাধীন চিন্তা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যও বিসর্জন দিতে হয়?
ইউনুস আহমাদ : আমরা এখন যা দেখছি তাতে কোনো যোগ্যতা বা ত্যাগ-কুরবানির প্রয়োজন হয় না। কোনো বিশেষ সুযোগ পেয়েই উঁচু পদে চলে যেতে পারে। তবে আমাদের সংগঠনে এটা নেই। এখানে অনেক পর্যায় আছে, কঠোর নিয়ম-নীতি আছে। এসব ধাপে ধাপে পার হতে হয়।

জাকির মাহদিন : প্রচলিত কোনো ধর্মীয় দল-সংগঠন বা আপনাদের বক্তব্য-বিবৃতিগুলো খুব সহজেই কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে যা নবী মুহাম্মদ সা. এর সময়ে তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি সমাজে প্রথমে সুপরিচিত ও বিশ্বস্ত হলেও ইসলামের আওয়াজ তোলার সাথে সাথেই কোণঠাসা হয়ে পড়েন। সেখান থেকে অবিশ্বাস্যভাবে দ্রুততম সময়ে পৃথিবী বদলে দিলেন। অথচ আজকের এই গ্লোবাল ভিলেজে অসংখ্য নেতাকর্মী, মিডিয়া এবং বিশ্ববাসীর সামনে আপনারা গরম বক্তৃতা দিয়ে মাঠ কাঁপাচ্ছেন। কিন্তু ন্যূনতম পরিবর্তন কোথায়?
ইউনুস আহমাদ : তখনকার সময় এবং এখনকার সময়ে অনেক পার্থক্য। তবে গতি ধীর হলেও আমাদের অবস্থা প্রতিবছর সামনে যাচ্ছে। জনশক্তি, জনসমর্থন ইত্যাদি আমরা যা আশা করি তারচেয়েও বেশি পাই। এটাকে বর্থতা বলা যাবে না। আল্লাহপাকের কবুলিয়াত যতটুকু আছে ততটুকুই হবে। আমরা চেষ্টা করছি।

জাকির মাহদিন : একদিকে মসজিদ-মাদরাসা বাড়ছে, আপনাদের জনশক্তি ও জনসমর্থন বাড়ছে। অন্যদিকে পাপাচার, অন্যায়-অত্যাচারও ভয়াবহভাবে বাড়ছে। তো দুটো একসঙ্গে বাড়ে কী করে?
ইউনুস আহমাদ : হাদিসে আছে- এমন একদিন আসবে, আল্লাহর নামটি নেওয়ার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটা একটা অবনতি, নৈতিক অবক্ষয়। এমনটা বাড়তেই থাকবে। কিন্তু এর বিপরীতে আপনারা লক্ষ করেছেন প্রতিটি নির্বাচনে আমাদের ভোট বাড়ছে। এই যে সিটি নির্বাচন গেল, এতগুলো বড় দল অংশ নিল, ভোট ডাকাতি হল, এরপরও আমাদের অবস্থান অনেক ভালো, ঢাকার মতো জায়গায়। আর ইউনিয়ন পর্যায়ে তো আমাদের পক্ষে ঢল নেমেছে।

[caption id="attachment_9126" align="aligncenter" width="693"]younus (2) আমাদের প্রতি জনগণের একটা অভূতপূর্ব সাড়া সৃষ্টি হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে সমর্থন ও সহযোগিতা এসব আপনারাও জানেন। অন্যান্য ইসলামি দলে সাধারণ মানুষ ইসলামের নাম শুনে এসে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়। কিন্তু এটা এমন এক কাফেলা যেখানে কথা ও কাজের মিল আছে।[/caption]

জাকির মাহদিন : আপনাদের এই উন্নতিটা কি বাহ্যিক না অভ্যন্তরীণ? তাছাড়া দলীয় নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের অভ্যন্তরীণ ইসলামি চর্চার প্রতি তাগিদ কতটুকু? এরা কি সমসাময়িক নাস্তিক্যবাদী চিন্তা-চেতনা ও প্রশ্ন-বক্তব্যগুলোর যথাযথ উত্তর দিতে সক্ষম, অথবা এদের বা আপনাদের জ্ঞান ও চিন্তাগত শক্তির প্রভাবে বাতিলের ভিত হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ছে?
ইউনুস আহমাদ : উন্নতিটা অভ্যন্তরীণও এবং চিন্তা ও জ্ঞানগত উন্নতির জন্য দলের ভেতরে বিভিন্ন স্তরের কর্মীদের জন্য আমরা বিভিন্নরকম কোর্স ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রেখেছি। বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে নেতা-কর্মী-জীম্মাদারদের চাঙ্গা করতে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ নিয়মিত সফর করেন এবং বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে থাকেন। তাছাড়া এ বিষয়ে আমাদের সুনির্দিষ্ট দশটি কর্মসূচি রয়েছে। দাওয়াত, শিক্ষা, শিক্ষাসংস্কার, সমাজসংস্কার, সমাজকল্যাণ, অর্থনৈতিক মুক্তি, অপশক্তি ও অপসংস্কৃতি প্রতিরোধ, সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রতিরোধ এবং সবশেষে গণআন্দোলন। তাছাড়া ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের প্রায় ৫৭টি শাখা বা সহযোগী সংগঠন আছে। ছাত্রসমাজ, রিক্সাওয়ালা, কুলি-শ্রমিক, মৎস্যজীবী, আইনজীবীদের নিয়ে সারাদেশে আমাদের ব্যাপক কাজ চলছে। এখন শুরু হয়েছে ইসলামি যুব আন্দোলন। যারা ছাত্রত্ব শেষ করে এবং চল্লিশের নিচে বয়স, এদের নিয়ে।

জাকির মাহদিন : মূল প্রশ্ন কিন্তু সাধারণ নেতাকর্মীদের প্রতি নয় বরং আপনাদের প্রতি, কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি। তাবলীগ ও আপনারাসহ আরো যেসব বড় বড় দল ও গোষ্ঠীর ব্যাপক কার্যক্রম চলছে, জনশক্তি, জনসম্পৃক্ততা ও জনসমর্থনেরও অভাব নেই, এসবের পরও আপনাদের কথিত নাস্তিক্যবাদী ও বাতিলপন্থী চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি-কার্যকলাপ নি:শেষ হচ্ছে না কেন?
ইউনুস আহমাদ : আমরা কিন্তু যথেষ্ট শক্ত বক্তব্য দিচ্ছি। আমাদের কথায় সরকারও অনেক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে। অনেক ধর্মবিরোধী আইন সরকার করতে চাইলেও আমাদের জন্য পারে না। কিছুদিন আগেও সরকার এবং কথিত বুদ্ধিজীবী সুশীলসমাজ বলত কওমি মাদরাসা জঙ্গিসংশ্লিষ্ট, কিন্তু এখন বলতে পারে না। তাদের ভাষা এখন পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। আর এটাও সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে কওমি মাদরাসাগুলো ওসবে নেই।

জাকির মাহদিন : আপনারা সারাদেশে সাপ্তাহিক জিকিরের কর্মসূচি দিয়ে রেখেছেন। আত্মশুদ্ধির জন্য ‘জিকির’ এবং ‘ইলম’ এ দুইটার মধ্যে গুরুত্ব বেশি কোনটার?
ইউনুস আহমাদ : দুটোরই গুরুত্ব বেশি। আমরা সমানভাবেই এ দুটিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। জিকিরের পাশাপাশি তালিম বা শিক্ষাও এর সাথে আছে।

আগামী পর্বে সমাপ্যি

আরো পড়ুন: কওমি সনদের স্বীকৃতি; একটি কোটি টাকার প্রশ্ন: মাওলানা মামুনুল হক

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ