বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৫ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিরোনাম :
উপজেলা নির্বাচনে যাচ্ছে কি ইসলামি দলগুলো? পাঠ্যপুস্তকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে স্মার্ট জেনারেশন সৃষ্টি সম্ভব নয়: শিক্ষামন্ত্রী বিচ্ছিন্নভাবে দে‌শের স্বার্থ অর্জন করার সুযোগ নেই : সেনা প্রধান স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন সংসদে পাশ করব : স্বাস্থ্যমন্ত্রী যাত্রাবাড়ীতে দুই বাসের মাঝে পড়ে ট্রাফিক কনস্টেবল আহত আ.লীগের মন্ত্রী-এমপির আত্মীয়দের উপজেলা নির্বাচনে নিষেধাজ্ঞা; অমান্য করলে ব্যবস্থা ফকিহুল মিল্লাত রহ. এর পরামর্শ -‘ফারেগিন কার সঙ্গে পরামর্শ করবে’ ঢাকায় চালু হলো চীনা ভিসা সেন্টার ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য পদ দেওয়া নিয়ে ভোট শুক্রবার ৬ দিনের সফরে থাইল্যান্ড যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

কওমি স্বীকৃতি নিয়ে সিলেটের আলেমরা যা বললেন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

masudul-copyমাসউদুল কাদির

কওমি মাদরাসার স্বকীয়তা রক্ষা আন্দোলনে সবসময় সিলেটের আলেমসমাজ তৎপর। অর্থ, সময় আর ত্যাগ ও কুরবানির নজির আছে তাদের। হযরত নূরউদ্দীন গহরপুরী রহ.ও কওমী মাদরাসার স্বীকৃতি মনে প্রাণে চাইতেন। পিছিয়ে পড়া এই আলেমসমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা তিনি করতেন। মাদরাসাগুলোকে একত্র করে শক্তির অনন্য সোপানে পরিণত করতেই তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি হিসেবে।

শাইখুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক রহ.ও কওমী মাদরাসার শিক্ষাসনদের জন্য যে আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি করেছিলেন তা-ও দারুল উলূম দেওবন্দের উত্তরসূরী হযরত গহরপুরী রহ.-এর ইশারাতেই করেছিলেন।

স্বীকৃতির পক্ষে জনমত তৈরির জন্য গত আগস্টে  কওমী শিক্ষাসনদ বাস্তবায়ন পরিষদ কাফেলা ব্রাম্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, পুণ্যভূমি সিলেটে সফর করে।

প্রথমেই আমাদের এই বহর ব্রহ্মণবাড়িয়ার সন্তান হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ.-এর  গড়া জামিআ রহমতে আলমে যাই। আমাদের অভ্যার্থনা জানান, জামিয়ার প্রিন্সিপাল মুফতি তৈয়্যব উল্লাহ ও তাঁর শিক্ষকবৃন্দ। কওমী শিক্ষাসনদের স্বীকৃতি বিষয়ে তারা একাত্মতা ঘোষণা করে বলেন, আমরা আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের নেতৃত্বে স্বীকৃতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যে কোনো ত্যাগ দিতে প্রস্তুত।

শিক্ষাসনদের এই কাফেলার সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য ছুটে এসেছিলেন হরষপুর মাদরাসার কয়েকজন শিক্ষকও। বৈঠকে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য সব কাজে আগ্রহ প্রকাশ করে তারা বলেন, স্বীকৃতি নিয়ে আর দ্বীমত নয়, আলেমগণ স্বীকৃতির পক্ষে। যেকোনো মূল্যে আমরা স্বীকৃতি চাই।
সকাল ১১টায় আমরা জামিয়া ইউনুসিয়ায় পৌঁছি। মাওলানা শামসুল হক ছাতিয়ানি হুযূর, মাওলানা বেলায়েত উল্লাহ স্বীকৃতির এই কাফেলাকে অভ্যার্থনা জানান। স্বীকৃতির বিষয়ে আলোচনায় তারা বলেন, ব্রাম্মণবাড়িয়ার বোর্ডের সবার সঙ্গে আমরা কথা বলবো। আমেলার বৈঠকে কথা বলে সিদ্ধান্ত জানাবো ইনশাআল্লাহ।

মৌলভীবাজারের জামিয়া লুৎফিয়া হামিদনগর বরুণায় পৌঁছুতে পৌঁছুতে দুপুর পেরিয়ে যায়। বাইক্কা বিলের মাছ দিয়ে অপূর্ব এক মেহমানদারি করেন তারা। পৌঁছার পর আমাদের অভ্যার্থনা জানান জামিয়ার নাজিমে তালিমাত হযরত মাওলানা রশিদ আহমদ। স্বীকৃতি নিয়ে জামিয়ার শিক্ষাবিষয়ক অফিসে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তারা স্বীকৃতির বিষয়ে আকাবীরদের মেহনতের সঙ্গে ঐকমত্য জানিয়ে বলেন, আমরা কওমী শিক্ষা সনদ স্বীকৃতি বাস্তবায়ন পরিষদের এই চেষ্টাকে স্বাগত জানাই। তারা বলেন, আমরা সবসময় স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আন্দোলন করে আসছি। এখনো স্বীকৃতির বিষয়ে আমরা একমত। জামিয়া লুৎফিয়ার ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা নূরে আলম হামিদী জানান, স্বীকৃতি চাই। এর জন্য আমাদের যা যা করার প্রয়োজন আমরা সব করতে রাজি আছি। আপনারা এগিয়ে যান।

জামিআ দারুল উলূম ইন্দেশ্বরের মাওলানা মাসঊদ আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে কওমী মাদরাসার স্বীকৃতির বিষয়ে কথা হয়। তিনি আমাদের এ বিষয়ক সব কাগজপত্র বুঝে রাখেন।

মৌলভীবাজার ইকরা বাংলাদেশ-এর পরিচালক মাওলানা নোমান আহমদ চৌধুরী ও মাওলানা সুফিয়ান আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে মতবিনিময় হয়। তারাও স্বীকৃতির পক্ষে ঐকমত্য প্রকাশ করেন।

স্বীকৃতি কাফেলা এবার মৌলভীবাজার থেকে সোজা আল্লামা নূরউদ্দীন গহরপুরী রহ. প্রতিষ্ঠিত জামিআ হোসাইনিয়া গহরপুর পৌঁছে। সেখানে হযরতের তনয় মাওলানা মুসলেহ উদ্দীন রাজু অপেক্ষা করছিলেন। ততক্ষণে পৃথিবীতে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। কথা হলো স্বীকৃতিসহ নানা বিষয় নিয়ে। ব্যক্তিগতভাবে সবসময় তিনি স্বীকৃতির পক্ষে বলে জানান। তবে মুুরুব্বীদের সঙ্গে স্বীকৃতির বিষয়ে কথা বলবেন বলেও জানান তিনি।

মাওলানা রাজু বলেন, যারা এগিয়ে যায় জাতি তাদের সঙ্গেই থাকে। কাজের কোনো বিকল্প নেই।

স্বীকৃতি কাফেলা এবার সরাসরি সিলেটের কানাইঘাটে আমাদের সফরসঙ্গী মাওলানা আবদুল্লাহ শাকিরের বাড়িতে। তখন মধ্যরাত। রাত জেগে অপেক্ষা করছিলেন তার বাবা মাওলানা রহমতুল্লাহ। কানাইঘাটের মাদানিভক্ত আরো অনেক তারুণ্য। মাওলানা মাশুক আহমদ, মাওলানা শহীদুল ইসলাম, আসাদ আহমদ, জুনাইদ আল হাবিব, মারুফ জাকিরসহ আরো অনেকেই স্বীকৃতি কাফেলার এই অগ্রযাত্রাকে স্বাগত জানাতে রাত জাগছিলেন।

সেখানে রাত্রি যাপনের পর ভোরে পূর্ব সিলেট বেসরকারী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের মহাসচিব মাওলানা আলিম উদ্দীন দুর্লভপুরীর বাসভবনে তার সঙ্গে কাফেলার সাক্ষাত হয়। তিনি বলেন, হযরত মোশাহিদ বায়মপুরী রহ.-এর নসিহত অনুযায়ি স্বীকৃতি নিয়ে আমাদের ভিন্নচিন্তা আছে। তারপরও স্বীকৃতি যাতে হয় আপনাদের জন্য আমি আরাফার ময়দানে দুআ করবো ইনশাআল্লাহ। তবে বলতে চাই, স্বীকৃতি আনার জন্য যোগ্য ব্যক্তিত্ব আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। স্বীকৃতি আনতে হলে তাকেই প্রয়োজন। তার সহযোগিতায় স্বীকৃতি এলে ওলামায়ে কেরাম বিভ্রান্ত হবেন না।

ওই দিনই স্বীকৃতি বাস্তবায়ন পরিষদের সদস্য সচিব মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ বিমানে সিলেটে পৌঁছান। তিনি বেশকটি মাদরাসা এবং আলেমদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ ছাড়া আমাদের কাফেলার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কওমী শিক্ষা সনদ বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক মুফতি আবুল কাসেম। তার সঙ্গে ছিলেন, মাওলানা ইমদাদুল্লাহ কাসেমী, মাওলানা সদরুদ্দীন মাকনুন, মাওলানা আবুল হোসেন চতুলী, মাওলানা মুহাম্মদ শোয়াইব, মুফতি আখতার হোসাইন, মুফতি তৈয়্যব উল্লাহ,  মাওলানা আবদুল্লাহ শাকির ও মাওলানা আরিফ বিল্লাহ।

পরের দিন সকালে সময় দিতে সম্মত হন সিলেট আজাদদ্বীনি এদারার মহাসচিব মাওলানা আবদুল বাসেত বরকতপুরী।

আমরা কানাইঘাট থেকে সরাসরি মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ সাহেবের সঙ্গে সিলেট শহরে এসে যুক্ত হলাম। তারপর সবাই মিলে মাওলানা আবদুল বাসেত বরকতপুরীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তার বাসায় গেলাম। অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও তিনি আমাদের যে সময় দিলেন তাতে অভিভূত না হয়ে পারলাম না। কথা শুনলেন, কাগজপত্র দেখলেন, অত্যন্ত সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বললেন, দেখুন, ৮০% আলেমই স্বীকৃতি বিষয়টাই বুঝে না। এটা সবাইকে আগে অনুধাবন করা দরকার। না বুঝে কথা বলা তো অর্থহীন।

মাওলানা বরকতপুরী স্বীকৃতিকে ইফতারের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, স্বীকৃতি হলো ইফতারের সওয়াবের মতো। কেউ ইফতার করালো মানে আপনার সওয়াব সে নিয়ে নিলো না। স্বীকৃতি দিয়েও কেউ আপনার সব কিছু নিয়ে যেতে পারবে না। কেউ দাওয়াত দিলে আপনার ইচ্ছা হলে তা গ্রহণ করবেন আর না হলে করবেন না। কিন্তু এ নিয়ে জল ঘোলাটে করাটা ঠিক নয়।

মাওলানা বরকতপুরীর জ্যেষ্ঠ তনয় মাওলানা উনাইস আহমেদ কাফেলার সবার প্রতি যে দরদিয়া মেহমানদারি করেছেন তা অনেক দিন মনে রাখার মতো।

এরপর আমরা দেশের পরিচিত মুখ, পুণ্যভূমি সিলেটের একসময়ের আন্দোলনের রূপকার জামিয়া মাদানিয়া কাজিরবাজারের প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতে যাই। তিনি হাস্যোজ্জ্বল মুখে কাফেলাকে বরণ করে নেন। স্বীকৃতির জন্য আমরা আওয়াজ তুলছি শুনে তিনি ভারী খুশি হন। তিনি বলেন, যারা হেফাজতের নামে এ দেশের আলেম উলামাকে হাজার বছর পিছিয়ে নিয়েছে তাদের পিছনে না পড়ে আপনারা এগিয়ে যান। আমি আপনাদের এই স্বীকৃতি আন্দোলনের সঙ্গে আছি। যেকোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হলে আমি প্রস্তুত। রাজধানীতে কোনো প্রোগ্রামের আহ্বান জানালে আমি আসবো ইনশাআল্লাহ।

এরপর জামিআ মাহমুদিয়া সোবহানিঘাটের প্রিন্সিপাল মাওলানা শফিকুল হক আমকুনীর সঙ্গে এই কাফেলা মতবিনিময় করে।

সফরসঙ্গী মাওলানা মুহাম্মদ শোয়াইব ভাইয়ের ভগ্নিপতি বারেক মিয়া ও ভগ্নিতনয় হাফেজ মাওলানা মিজানুর রহমানের দাওয়াত কোনোভাবেই আর এড়ানো গেল না। বাংলোর মতো করীমপুরের এই বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করে সন্ধ্যায় রাজধানীর দিকে যাত্রা শুরু করলাম।

একটা ‘স্বীকৃতি’ যা পুরো জাতির জন্য কল্যাণের, মঙ্গলের। একটা প্রয়োজনীয় ছাতা। এই ছাতাটা আমাদের যে কী প্রয়োজন তা বলাবাহুল্য। প্রতিটি স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি বা আলিয়া মাদরাসার কথাই যদি বলি, সব্বাই আন্দোলন করে নিজেদের অধিকার আদায় করেছে।

আফসোস আর অনুতপ্তের ভাষা আমাদের দুর্বল হয়ে পড়েছে। স্বীকৃতি চাই- তবে বলে আমরা আসলে কী বলতে চাই তা-ও স্পষ্ট নয়। সবকিছুর পর একটা কথা বলা যায়, আল্লাহ তাআলা সবকিছু করতে পারেন মাখলুক ছাড়া আর মাখলুক কিছুই করতে পারে না আল্লাহর হুকুম ছাড়া।

লেখক : যুগ্মসম্পাদক, মাসিক পাথেয় ও ইকরা বাংলাদেশ হবিগঞ্জের প্রিন্সিপাল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ