সোমবার, ১০ মার্চ ২০২৫ ।। ২৫ ফাল্গুন ১৪৩১ ।। ১০ রমজান ১৪৪৬

শিরোনাম :
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন আনিসুজ্জামান চৌধুরী বিরতিকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম ফুটবলারদের ওমরা পালন ধর্ষণের বিচারে শরয়ি আইন থাকলে, কোন শিশু আর ধর্ষিত হতো না: উলামা-জনতা ঐক্য পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি থাকায় ঈদে নতুন নোট বিতরণ স্থগিত ধর্ষণ এবং নারীর পরিচয় নিয়ে অবমাননায় ১৫১ আলেমের বিবৃতি ১০ম তারাবির নামাজে তিলাওয়াতের সারমর্ম ত্রাণ বন্ধের পর এবার গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করছে ইসরায়েল তারাবিতে ফাইভ জি স্পিডে তেলাওয়াত করবেন না: আজহারী ‘আলেমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তোলা জিহাদ নয়, সন্ত্রাসী কার্যক্রম’ পদত্যাগ করেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আমিনুল ইসলাম

কওমি শিক্ষাব্যবস্থা ও স্বীকৃতি প্রসঙ্গে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

জাকির মাহদিন; আওয়ার ইসলাম

প্রথমেই ‘শিক্ষা’ সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। ‘শিক্ষা’ বিষয়টা এতটাই মৌলিক, গভীর, ব্যাপক, সহজ, সর্বজনীন, তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রভাববিস্তারকারী যে এটা নিয়ে আমি খুব একটা বলতে পারব বলে মনে হয় না। প্রকৃত শিক্ষার সঙ্গে আজকের তথাকথিত শিক্ষার পার্থক্য আকাশ-পাতালের চেয়েও বেশি। শিক্ষার কোনো নাম-গন্ধ বর্তমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আছে বলে অন্তত আমার জানা নেই। সেটা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কওমি-আলিয়া মাদরাসা যাই হোক না কেন। মূল শিক্ষা বাদ দিয়ে বা শিক্ষার মূল লক্ষ-উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে এর গৌণ ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোকেই শিক্ষা নামে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এক বা একাধিক ভাষা শিক্ষা, বৈষয়িক শিক্ষা ও কারিগরী শিক্ষার চাপে মনুষ্যত্বের শিক্ষা, মানসিক শক্তি অনুসন্ধান ও বিকাশের শিক্ষা, সৃষ্টিগত প্রাপ্ত শিক্ষা সম্পূর্ণই হারিয়ে গেছে। জানি, এখানের কিছু কথা বা পরিভাষা পাঠকের কাছে কঠিন ঠেকবে। কারণ সেই বিষয়গুলো আমাদের চিন্তা-চেতনা এমনকি ধ্যান-ধারণা থেকেও একেবারেই হারিয়ে গেছে। যে কারণে জেনারেল শিক্ষায় দূরের কথা, মাদরাসা শিক্ষায়ও ‘সৃষ্টিগত প্রাপ্ত শিক্ষা’র কোনো অনুসন্ধান পর্যালোচনা নেই। মহান আল্লাহ কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, ‘আমি মানুষকে কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছি; এমনকিছু যা সে জানত না’। -সূরা আলাক। ‘তিনি অসীম দয়ালু। শিখিয়েছেন কোরআন। মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও শিখিয়েছেন। -সূরা রাহমান। এমনকি মহান আল্লাহ আমাদের পরীক্ষাও নিয়েছেন। জিজ্ঞেস করেছেন, আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই? এর সঠিক উত্তর দিতে আমরা সমর্থ হয়েছি। বলেছি, নিশ্চয়। অথচ এখন ধর্মীয় শিক্ষা হয়ে পড়েছে বিনিময়নির্ভর, ‘জী হুজুর’মার্কা, সার্টিফিকেটমুখী, স্বীকৃতিমুখী।

আবার সার্টিফিকেট একটা হলেও চলে না, অনেকগুলো চাই, অনেক প্রকারের চাই। এসব পাবার মূল উদ্দেশ্যই ধর্মবিরোধী। কারণ এসবের প্রতি আকর্ষণ, দুর্বলতা, ব্যস্ততা, পেরেশানি ¯্রষ্টাপ্রদত্ত শিক্ষাকে ভুলিয়ে দেয়। সৃষ্টিগত প্রাপ্ত শিক্ষা নষ্ট করে ফেলে। বর্তমান শিক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপদ্ধতি মানুষের মানসিক সুপ্ত শিক্ষা ও শক্তি বিকাশের পক্ষে সহায়ক নয় বরং উল্টো। তাই এসব যাদের ভাগ্যে জোটে তারাও অন্তরে শান্তি বোধ করেন না। আরও অধিক আশা, বিভিন্ন ব্যক্তি-দল-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মানসিক দ্বন্দ্ব, পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্কের অবনতি, জাগতিক সুখ ও প্রাপ্তিতে উচ্ছ্বাস বা কথিত তৃপ্তি আর দশজন সাধারণ মানুষ বা উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিক্ষিত শ্রেণির মতোই তারা ধারণ করেন। জেনারেল শিক্ষায় বাংলা-ইংরেজি প্রাধান্য, মাদরাসা শিক্ষায় আরবির প্রাধান্য। এসবই ভাষা। জ্ঞান (ইলম) আর ভাষা এক কথা নয়। সাধারণ ও ধর্মীয় শিক্ষায় ভাষাগত ও অন্যান্য বাহ্যিক কিছু পার্থক্য থাকলেও মূল লক্ষ-উদ্দেশ্যের দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই। কওমি অঙ্গনের যারা বড় গলায় কথা বলছেন অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত মাদরাসা শিক্ষার আখেরাতমুখিতা, আল্লাহমুখিতা, দৃঢ় চরিত্র ইত্যাদি নিয়ে, সেসব নিয়ে কথা না বাড়ালেই বরং ভালো।

 শিক্ষার বাস্তবতা, কার্যকারিতা, লক্ষ-উদ্দেশ্য, প্রভাব-পরিধি নিয়ে সীমাহীন সন্দেহ-সংশয়, দ্বন্দ্ব-হতাশা ও বিতর্ক তৈরি হওয়ার কারণেই মূলত আজকের এ সংকট। এমনকি ধর্মীয়-রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক-অর্থনৈতিক সমস্ত সংকটের মূল কারণ এখানেই- শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থায় মৌলিক ত্রুটি।

শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে গেলে সাধারণ ও ধর্মীয়- কোনো শিক্ষাকেই আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। সাধারণ মানে সাধারণ, এটা সবার লাগবেই। আর ধর্মও অপরিহার্য। সুতরাং সাধারণ শিক্ষাব্যস্থায় যেমন প্রয়োজনীয় ধর্মশিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি ধর্মীয় শিক্ষাব্যস্থায়ও প্রয়োজনীয় সাধারণশিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে (এক্ষেত্রে উভয় কর্তৃপক্ষেরই চরম দুর্বলতা ও অবহেলা লক্ষ করা যায়)। এটা সার্থকভাবে করা গেলে শেষ পর্যন্ত একমুখি শিক্ষা বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু বাংলাদেশে যা অবস্থা, যুগ যুগ ধরে পরিকল্পিতভাবে যে ‘বিভাজন’ চলে আসছে তাতে খুব শীঘ্র এ ধরনের একমুখি শিক্ষার পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। তাই মনুষ্যত্ব ও মানসিক শক্তির বিকাশকে প্রাধান্য দিয়ে, সাধারণ ও ধর্মীয় শিক্ষার সার্থক সমন্বয়ে ভবিষ্যতে একমুখি শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ দুটো শিক্ষাব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখে সমস্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে স্বীকৃতির আওতায় অবশ্যই আনতে হবে এবং বলার অপেক্ষা রাখে না যে কওমি শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারি কোনো নীতি-শাসন চাপিয়ে দেয়া যাবে না।

‘কওম’ মানে জাতি। কিন্তু জাতির সংজ্ঞা কি? বর্তমানবিশ্বে জাতি বলে যা স্বীকৃত তা ইসলাম সমর্থিত নয়। আবার ইসলামিস্টরা ‘জাতি’র যে চরিত্র দাঁড় করাচ্ছেন তা মানবতাবিরোধী, প্রকৃতপক্ষে ধর্মবিরোধীও। তাহলে কওমিপন্থিরা ‘কওমি শিক্ষা’ বলতে কী বোঝাচ্ছেন? এ শিক্ষায় ও শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীর সামগ্রিক জ্ঞান, চেতনা ও যোগ্যতা কতটুকু বিকশিত হয়? নাকি এর দ্বারা শিক্ষার্থীর মধ্যে সমাজবিচ্ছিন্নতা, জাতিবিচ্ছিন্নতা, নৈরাশ্যবোধ, উগ্রবাদ, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা, ধর্মীয় বিভ্রান্তি, রাষ্ট্রীয় অসঙ্গতি সৃষ্টি হয় তাও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অবশ্যই দেখতে হবে। তাই বলে রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থা যে ধোয়া তুলসিপাতা তা কিন্তু নয়। কথিত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের এই আধুনিক যুগে মানুষ আসলেই কতটা শিক্ষিত বা কতটা মূর্খ তা নির্ণয় ও নিশ্চিত হবার পথ-প্রয়োজন দুটোই আছে। শিক্ষার বাস্তবতা, কার্যকারিতা, লক্ষ-উদ্দেশ্য, প্রভাব-পরিধি নিয়ে সীমাহীন সন্দেহ-সংশয়, দ্বন্দ্ব-হতাশা ও বিতর্ক তৈরি হওয়ার কারণেই মূলত আজকের এ সংকট। এমনকি ধর্মীয়-রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক-অর্থনৈতিক সমস্ত সংকটের মূল কারণ এখানেই- শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থায় মৌলিক ত্রুটি। একদল নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ‘কওমি শিক্ষা’ বলে দাবি করছেন। অথচ ‘কওম’ এবং ‘শিক্ষা’র কোনো সংঘাতমুক্ত, বিতর্কমুক্ত মীমাংসাধর্মী সংজ্ঞা দিচ্ছেন না। অন্যদল সাধারণ শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা বলতে যা দেখাচ্ছে তা পুরোটাই মূর্খামূর্খি বা ‘মূর্খমূর্খ খেলা’। একদল শিশু-কিশোরের চোখ বেঁধে কানামাছি খেলার মতো।

বাংলাদেশের শতকরা ক’জন নাগরিক প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পেরানোর সুযোগ পায়? শত-সহস্র বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে যারা ‘শিক্ষার্থী’ হিসেবে নিজেদের পরিচিত প্রতিষ্ঠিত করে, তাদের মধ্যে কওমি শিক্ষার্থীদের মতো অসহায়, হতাশ, কর্মবিমুখ, সাধারণ বোধ-বোঝহীন আর হয় না। কেন? যুগ যুগ ধরে এর পেছনে দায়ি কারা?

যেহেতু বাংলাদেশের (অন্যদেশের কথা এখানে বলছি না) কোনো শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থাই ত্রুটিমুক্ত নয় এবং ব্যক্তিক সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক নয়, তাই স্বীকৃতির বাইরে রাখলে সবগুলোই রাখতে হবে, স্বীকৃতি দিলেও সবগুলোকেই দিতে হবে। তবে স্বীকৃতিটা প্রত্যেকের নাগরিক অধিকার। এটা অবশ্যপ্রাপ্ত। যারা স্বীকৃতির বাইরে থাকবে, স্বীকৃতির বাধাবিঘ্নতে ইন্ধন যোগাবে তারা নিজেদের কপাল তো পুড়বেই, লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎও ধ্বংস করবে। এমন ছেলেখেলার অনুমতি ও সুযোগ কোনোটাই দেয়া যায় না। যারা বলছেন স্বীকৃতির মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষাকে শেকল পড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে, তাদের বিনীতভাবে বলতে চাই, শিক্ষার গুণ-মান-দর্শনে জোর থাকলে, আদর্শ ও স্বনির্ভরতা থাকলে, সঠিক নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনা থাকলে রাষ্ট্র বা সরকার কোনো শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করবে দূরের কথা বরং সরকার ও রাষ্ট্র তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হবে। সুতরাং স্বীকৃতিতে ভয়ের কিছু নেই। বরং সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। বিশেষ করে জাতি গঠনের ক্ষেত্রে সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের পরও যে পরিমাণ প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হয় তাতেই কয়েক দফা কোমর ভাঙবে। আমি নিজে যদিও এসব শিক্ষা ও সার্টিফিকেটের ধার ধারি না, কিন্তু লাখ লাখ শিক্ষার্থীর পক্ষে এটা সম্ভব নয়। এই বেকারত্ব ও মন্দার সময়ে, অশিক্ষা, কুসংস্কৃতি ও মূর্খতার  স্রোতকালে কওমিদের বাঁচার ও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ন্যূনতম অধিকারের বিপক্ষে কোনো সমসঝদার ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কথা বলতে পারে না।

বাংলাদেশের শতকরা ক’জন নাগরিক প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পেরানোর সুযোগ পায়? শত-সহস্র বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে যারা ‘শিক্ষার্থী’ হিসেবে নিজেদের পরিচিত প্রতিষ্ঠিত করে, তাদের মধ্যে কওমি শিক্ষার্থীদের মতো অসহায়, হতাশ, কর্মবিমুখ, সাধারণ বোধ-বোঝহীন আর হয় না। কেন? যুগ যুগ ধরে এর পেছনে দায়ি কারা? আজ এই চূড়ান্ত সংকটকালে বাস্তবতা উপলব্ধি ও স্বীকার করা দায়িত্বশীলদের থেকে অবশ্যই নতুন প্রজন্ম আশা করতে পারে। কেন আজকের কওমি শিক্ষার্থীরা কওমি ডিগ্রির পাশাপাশি আলিয়া ও স্কুল-কলেজ থেকে ডিগ্রি নিতে মহামূল্যবান সময়, মেধা ও অর্থ অপচয় করতে বাধ্য হচ্ছে? কওমি শিক্ষকগণ কি এসব জানেন না? স্বীকৃতি-সংস্কারের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে কেন এত সংখ্যক শিক্ষার্থীর জীবন অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে? আমাদের শ্রদ্ধেয় আলেমগণের প্রতি বিনীত অনুরোধ, হয় সংস্কার ও স্বীকৃতির পক্ষে সবাই একযোগে কাজ করুন, অথবা এতই যদি আপনারা আল্লাহওয়ালা হোন তবে আর্থিক-সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিক যত সুযোগ-সুবিধা-সম্মান আপনারা দীর্ঘদিন ধরে ভোগ করছেন তা ত্যাগ করে ‘দ্বীন শিক্ষা’র মাঠে নামুন।

লেখক: সম্পাদক, পাক্ষিক দেশ দর্শন
zakirmahdin@yahoo.com

কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি নিয়ে আপনার মন্তব্য থাকলে নিচে মন্তব্যের ঘরে পোস্ট করুন। সবার মতামত প্রকাশ হবে ইনশাআল্লাহ।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ