বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১১ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫


স্বীকৃতির জন্য একটি সফর এবং চট্টগ্রামের আলেমদের ভাবনা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

safarমাসউদুল কাদির

স্বীকৃতিচাহিদাটা গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ কাজ করেও স্বীকৃতি চায় আবার কাজ না করেও চায়। জীবনযুদ্ধে মানুষ স্বীকৃতি ছাড়া অগ্রসর হতে পারে না। পথ হারিয়ে ফেলে। স্বামী স্ত্রীকে স্বীকৃতি না দিলে যে বিপত্তি ঘটে তা গোটাসমাজ মিলেও ঠেকাতে পারে না। তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়ে।

আগস্ট ২০১৬ -এর শেষ কটা দিনের চট্টগ্রাম সফর নিয়ে লিখবো ভেবেই কী-বোর্ডে টাচ করছি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কওমী সনদের আশ্বাসের কারণেই গঠিত হয়েছে ‘কওমী শিক্ষাসনদ বাস্তবায়ন পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন। ছোট ছোট কাফেলা করে দেশের শীর্ষ আলেমদের কাছে ও মাদরাসাগুলোতে সফর করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম সফরে কাফেলায় আমারও পা ফেলা ছিল। আমিও হেঁটেছি বহুপথ। সঙ্গে সঙ্গে আলোচনাটা সত্যিকার অর্থেই সবার মুখে মুখে উঠে এসেছে। ‘প্রধানমন্ত্রী আগ্রহীদেরই সনদের স্বীকৃতি দেবেন’ এমন কথা ঠাওর করতে পারার পর অনেকই বিভিন্নভাবে দৌড় ঝাঁপ শুরু করেছেন। তারুণ্য তো বলাবাহুল্য খুবই আশাবাদি। অন্তত তারা স্বীকৃতি দেখে যেতে চায়।

শূন্যদশকের গোড়ার দিকে আমরা হাফেজ আহমাদুল্লাহ ভাইয়ের সহযোগিতায় যুগান্তরে লিখতাম। আহমাদুল্লাহ ভাই নিজেও কওমী মাদরাসার স্বীকৃতি চাইতেন। যে কারণে তখন এ বিষয়ক অনেক লেখা ছাপা হতো। পরে শাকের হোসাইন শিবলি ভাই যুগান্তরে কাজ শুরু করলে তখনো স্বীকৃতি নিয়ে লেখালেখি হয়। সেসব লেখালেখি হালে জল না পেলেও আমাদের বুজুর্গ আলেমদের হৃদয়পটে স্বীকৃতি বিষয়ক ধারণা তৈরি করেছিলো।

যাওয়ার পথে মাওলানা হাফেজ ওবায়দুল্লাহ রহ.-এর কবর জিয়ারতের উদ্দেশে আলেকারচর জামিআ মাদানিয়া রওজাতুল উলূমে যাত্রা বিরতি করলাম। হাফেজ মুহাম্মদ তালহা আমাদের অভ্যার্থনা জানালো। বাবার অবর্তমানে ছাত্রবয়সেই অনেক দায়িত্ব নিতে হলো বেচারাকে। হাফেজ তালহাসহ তার আরো দুই ভাই মারগুবুর রহমান ও ছোটবন্ধু হোজাইফার চেহারায় এক  ধরনের বিস্ময় দেখলাম। কবর জিয়ারত করলাম। নাস্তার ব্যবস্থাও ছিলো। প্রতিটি মাদরাসায় আমাদের কাজ ছিলো ফতওয়ার পুস্তক বিতরণ, স্বীকৃতির বিষয়ে মাদরাসার সম্মতি,  কওমী শিক্ষাসনদের স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে গণস্বাক্ষরপত্র প্রদান ও স্বীকৃতি নিয়ে আলোচনা।

কুমিল্লা থেকে আমরা সরাসরি চলে গেলাম ফেনির ধুমসাদ্দা রশিদিয়া মাদরাসায়। মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদুল আউয়াল। সঙ্গে ছিলেন খুব চেনা চেনা মাওলানা আবদুল কাইউম। পরে অবশ্য রহস্য জানলাম, ইনি জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় পড়েছেন। সে সূত্রেই চেনা চেনা। শিল্পী আবদুল আহাদ সালমানের বাবা তিনি। পরে জানলাম।

এখানে কাজ হওয়ার পর সোজা আমরা চলে গেলাম জামিআ দারুল মাআরিফ চট্টগ্রাম। সেখানে মুফতি জসিম উদ্দীন নদভী আমাদের সঙ্গে কথা বললেন। তিনি আফসোস করে বললেন, স্বীকৃতি না থাকায় আমাদের কওমী মাদরাসাগুলো এখন আলিয়ার ছাত্রাবাসে পরিণত হয়েছে। মাদরাসাগুলো বাঁচাতেই স্বীকৃতি প্রয়োজন। দারুল মাআরিফে যাওয়ার পথে বিমান থেকে নেমে এসে আমাদের কাফেলায় যুক্ত হলেন মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ। এ ছাড়া কাফেলায় ছিলেন মুফতি আবুল কাসেম, মাওলানা আইয়ুব আনসারী, মাওলানা ইমদাদুল্লাহ কাসেমী, মাওলানা সদরুদ্দীন মাকনুন, মাওলানা আবূ বকর, মাওলানা মুহাম্মদ শোয়াইব, মাওলানা আবদুল্লাহ শাকির।

রাতের খাবারের জন্য শহীদ আনওয়ার শাহ’র ভাই আসাদ ও তার বাবার দাওয়াত গ্রহণ করতে হয়েছিলো। নতুন কিছু তথ্যও পেলাম। ‘শীলনের সাহিত্য সভায় আসতো আনওয়ার শাহ। বসতো, কথা বলতো, বড় আবেগী ছিলো সে। রাস্তার ওপাস থেকে দৌড়ে এসে দেখা করতো, অন্য রকম সুন্দর লুকিয়ে ছিলো তার ভেতরটায়। জান্নাতি হাওয়ায় ভেসে বেড়াক ওর আত্মা। হে আল্লাহ! ক্ষমা করো আমাদের। যেখানে আমরা ভুল করি, নিষ্পেসিত হয় মানবতা। এ যেনো আর কোনো দিন না হয়।

রাতেই চাটগাঁ শহর থেকে সোজা হামিউস সুন্নাহ মেখল মাদরাসায় গেলাম। মাওলানা যাকারিয়া নোমান ফয়জী আমাদের থাকার সব ব্যবস্থা। রাতেও আমলেও ঘ্রাণ পেলাম মেখলে। টার্গেট ছিলো নাজিরহাট, বাবুনগর এবং ফটিকছড়িতে যাবো। কিন্তু হলো না। ওদিকে মহাসমাবেশ থাকায় রুখ বদলাতে হলো।

জামিআ ইসলামিয়া পটিয়া আমার ভেতরেও সামান্য স্মৃতি ধারণ করে আছে। ২০০৬ সালের পুরো সময়টাই তো ওখানে কাটালাম। মুফতি আবদুল হালিম বোখারি, আমার পরমপ্রিয় উস্তাদ। আগামী তিনদিনই ব্যস্ত থাকবেন তিনি। সকালেই সাক্ষাতের সময় দিলেন কাফেলাকে। আমরা মেখল থেকে সরাসরি পটিয়ায় চলে আসি। যথাসময়ে হযরত বুখারির সঙ্গে বৈঠকে বসি। তিনি সব কথা শুনলেন। মানবকল্যাণে শান্তির ফতওয়ায় নিজেও স্বাক্ষর করেছেন। ফতওয়ার বই নিলেন, স্বীকৃতির কাগজপত্র নিলেন। মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ এটুজেড বুঝালেন। সবশেষে তিনি মাথা উঁচু করে বললেন, আমরা তো স্বীকৃতি চাই। আমরা চার বোর্ড একসঙ্গেই আছি। শিগগিরই কথা বলবো। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সভা আহ্বান করা হয়েছিলো। একজনের অসুবিধার কারণে বৈঠকটা হলো না। আমার সঙ্গে মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেবেরও কথা হয়েছে।

আমি আজই সবার সঙ্গে যোগাযোগ করবো। স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বীকৃতি পেতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

পটিয়ায় নাস্তা সেরে আল জামিয়াতুল আরাবিয়া আল ইসলামিয়া জিরিতে গেলাম। মাওলানা শাহ মুহাম্মদ তাইয়্যেবের সঙ্গে এই কাফেলার মিটিং অনেক্ষণ। তিনি কোনো বোর্ডের অধীন না হলেও স্বীকৃতি চান। তিনি বলেন, আমি ইজতেমার মাঠেই মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের সঙ্গে কথা বলেছি। স্বীকৃতি চাই। তিনিও সব কাগজপত্র নিলেন। ফতওয়ার বই নিয়েও দেখলেন। হযরতের সাহেবজাদা মাওলানা খোবাইব আমাদের সঙ্গে অনেক কথা বললেন। স্বীকৃতি নিয়ে তার আগ্রহও অনেক।

মুফতী জসীম উদ্দীন নদভী দুপুরের খাবারের জন্য দাওয়াত দিয়ে রেখেছেন দারুল মাআরিফে। জিরি থেকে সোজা দারুল মাআরিফ। মাওলানা মাহবুব মুজিব, লেখক তারুণ্য- তার কথা তো কিছুই বলা হলো না। অসম্ভব রকম মধুরতা দিয়ে মেহমান নেওয়াজী করেছে সে।

শাহী লাইব্রেরী, হলরুমসহ আরো অনেক কিছু দেখলাম। ভালো লাগলো। নামাজ পড়েই হযরত মাওলানা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভীর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাত করার কথা। সালাত আদায় করেই হযরতের বাসায় গেলাম। অসুস্থ আর বার্ধক্যের নানা রোগে কাবু করে রেখেছে এই গুণী আলেমকে। আলোচনা শুরু হলো। তিনি বললেন, ‘আমাকে নিয়ে এমনিই কত কথা। আমি সিলেবাস পরিবর্তন করতে আগ্রহী, এরকম আরো কত কথা। স্বীকৃতির বিষয়ে তো আমার আগ্রহের কমতি নেই। হাটহাজারি মাদরাসার মুফতি আহমদ শফি সাহেব নিজে আমাকে বলেছেন, স্বীকৃতি লাগবে। আজকাল মসজিদ, মাদরাসা ও কাজী নিতেও সনদ লাগে। ভালো ভালো মসজিদ আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।’

এ বাক্যগুলো জিরি প্রিন্সিপাল মাওলানা শাহ মুহাম্মদ তৈয়বও বলেছিলেন। তিনিও শুনেছেন।

safar2

রোজার আগে আমি গুণী এই আলেমের কাছে জঙ্গিবাদবিরোধী শান্তির ফতওয়ায় স্বাক্ষর আনতে গিয়েছিলাম। তিনি বিষয়টি ভালোভাবে দেখে স্বাক্ষর করেছিলেন। স্মৃতি রোমন্থন করে জামিআ ইমদাদিয়ার কথা স্মরণ করলেন। আমি যখন জামিআ ইমদাদিয়ায় পড়াতাম তখন মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ ওখানে পড়তো।

স্বীকৃতি নিয়ে আরবি সাহিত্যের এই প্রবীণ আলেম যে আগ্রহ দেখালেন তাতে আমি অভিভূত। যোগ্যতার মানদণ্ডে বাংলাদেশে তার সমকক্ষ কে আছে তা অনেকটা বাতি লাগিয়েই খোঁজতে হবে।

হাটহাজারি মাদরাসার মুফতি আহমদ শফি সাহেব নিজে আমাকে বলেছেন, স্বীকৃতি লাগবে। আজকাল মসজিদ, মাদরাসা ও কাজী নিতেও সনদ লাগে। ভালো ভালো মসজিদ আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।’

দারুল মাআরিফে আতিথেয়তা সেরে আমরা নাজিরহাটের খবর নিলাম। কেউ আর নিজের মসনদে নেই। তখন পথে ফেনীতে আরো দুই মাদরাসা পরিদর্শনের চিন্তা করি।

মুফতি সাঈদ আহমদ পরিচালিত লালপোল মাদরাসায় গেলাম। সাক্ষাত ও কথাবার্তার পর দেখলাম মুফতি শহীদুল্লাহ পরিচালিত জামিআ রশিদিয়ার মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ এবং আরেকজন শিক্ষক বাইকে এসে হাজির। গেলাম সেখানে। রাত ছিলো তাই আফসোস মিটিয়ে মাদরাসাটা দেখা হলো না। আগের মতোই সব কথাবার্তা হলো।

মুফতি শহীদুল্লাহ, শিক্ষকগণ আর ছাত্ররা খেদমত ও আতিথেয়তায় অনন্য নজীর দেখে এলাম ওখানে। খাবারের দস্তরখান আর আন্তরিকতার মধুরতা এখনো হৃদয়ে আন্দোলিত হয়।

ঢাকায় ফিরে বসুন্ধরা রিসার্চ সেন্টারের মুহতামিম মুফতি আরশাদ রাহমানীর সঙ্গেও স্বীকৃতি-কাফেলা বৈঠক করে।

সবকিছুর পরে আসলে স্বীকৃতি আসবে তো? এমন প্রশ্ন অনেকেই করে থাকেন। আশায় আছি আমিও। কত শত কারণে আমাদের স্বীকৃতি প্রয়োজন। আসলে সব কথা বলতে লজ্জাও হয়। অনেকেই দেখলাম লিখেছেন, পড়ে পড়ে হাসলামও, সবকথা কি ‘বিচার মানি তালগাছ আমার’ প্রক্রিয়ার কাছে হার মানবে?
তাই এখন আওয়াজ বড় করার সময়। সাহসি ছোট্ট উচ্চারণও ছিটমহলের মতো করুণ এক দশা থেকে মুক্তি দিতে পারে আমাদের কওমী শিক্ষার্থীদের।

লেখক : যুগ্মসম্পাদক, মাসিক পাথেয় ও ইকরা বাংলাদেশ হবিগঞ্জের প্রিন্সিপাল
Mkadir1983@gmail.com


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ