আব্দুল্লাহ বিন রফিক; আওয়ার ইসলাম
প্রধানমন্ত্রীর কওমী মাদরাসার স্বীকৃতি প্রদানের ঘোষণার পর থেকেই কম-বেশি সবাই কওমী মাদরাসার স্বীকৃতি বিষয়ে বেশ নড়ে-চড়ে উঠেছেন। পক্ষে-বিপক্ষে দুই-ই আছেন। কেউ আবার জল ঘোলা করার ফন্দি-ফিকিরে বেশ ব্যস্ত সময় পার করছেন। ইলেক্ট্রিক মিডিয়াতে স্বীকৃতির বিরুদ্ধে বুদ্ধিয়ানা বাণী ছুড়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত। কওমীদের মূর্খ ঠাওরে টকশোতে গোলাবাজিতে বেশ মত্ত। যে যার মতো করে বাক্যবান ছুড়ে চলেছেন। লক্ষ্য কওমী স্বীকৃতির বক্ষ ভেদ। নিজেকে জ্ঞানী বুদ্ধিজীবী যাহির করার সুযোগটাকে বেশ কাজে লাগাচ্ছেন ইন্টেলেকচুয়াল এলিট নামধারী ছদ্মবেশী সোশালিস্টরা।
গল্পের মতো মনে হলেও আসলে বড় বিচিত্র আমাদের এই পৃথিবী। ততটাই বিচিত্র এ গ্রহের মানুষ। কেউ শিক্ষাকে ধর্মের ভেতর এনে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে আবার কেউ শিক্ষাকে ভোগের হাতিয়ার হিসেবে গন্য করে চলেছে। ফলে এক বিশ্বসংসারের মানুষ হয়েও আমাদের গাঁথুনি ভিন্ন। চিন্তাধারা, রুচিশক্তি ও ইচ্ছাধারাতেও হয়ে উঠেছে যথেষ্ট ফারাক। এজন্য স্বীকৃতির কথা উঠলে নানারকম মন্তব্য শুনতে পাই নানাজনদের কাছ থেকে। ‘জাগতিক ও ধর্মীয়’ বিশেষণে শিক্ষা দু’টোকে যার যার মতো করে আলাদা করে ফেলি। মারপ্যাঁচের জটিল সমীকরন কষতে শুরু করি। অথচ শিক্ষা তো মানবতার কল্যাণে হয়ে থাকে। শিক্ষা হয়ে থাকে জাতির প্রয়োজনে। তবু বিভাজনের বড় একটি কারণের উৎপত্তি ঘটেছে এই চিন্তা-কল্পনার ফারাক থেকেই।
আমরা কথা বলেছিলাম এই কওমী মাদরাসায় পড়ুয়াদের কিছু অভিভাবক ও গার্ডিয়ানিদের সাথে। তারা এই স্বীকৃতিকে কীভাবে দেখছেন- তা জানাও আমাদের কাছে কিন্তু কম গুরত্বপূর্ন নয়। বিভিন্ন কওমী মাদরাসার অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অভিভাবকদের অধিকাংকাশেই স্বীকৃতির পক্ষে। বিপক্ষের পাল্লা বলতে গেলে খুবই হালকা। নাম না বলার শর্তে কেউ কেউ জানিয়েছেন, স্বীকৃতি দিলে আমাদের ছেলেরা সবজায়গাতে কাজ করতে পারবে। আত্মীয়দের কেউ কোন ক্লাসে পড়ে জিজ্ঞেস করলে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলতে হয়, গোজামিল দিয়ে বোঝাতে হয়। দ্বীন শেখার পর বাস্তব জীবনে এলে কর্ম-সংস্থান কেবল মসজিদ-মাদরাসার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। কর্ম ও কাজের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে জুতার তলা কয়েক জোড়া ক্ষয় হবার যোগাড়। বৃহৎ সমাজের অংশ হয়েও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ কোনো অঙ্গনে কাজ করার সুযোগ থাকে না আমাদের ছেলেদের। কেনো ধর্ম শিখলেই যে তাকে মসজিদ-মাদরাসা ছাড়া অন্য কোথাও কাজ করা চলবে না এমন কথারই বা কী যৌক্তিকতা আছে? ধর্ম শিখে সাহাবী, তাবেয়ী ও প্রাচীন যুগের ধর্মীয় বিশেষজ্ঞগণ তো অনেক কিছু্ই করেছেন। তাহলে আমরা কেনো পারবো না? ধর্ম শেখার অধিকার তো সবার জন্য। বরং এই শিক্ষাকে বর্তমানে আরো সার্বজনীন করা প্রয়োজন।
অনেকে তো অভিযোগের সুরে এ প্রশ্নও তুলেছেন, এখন তো কওমী মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগ হয় লোক দেখে। পরিচিত হলে যোগ্যতা না থাকলেও শিক্ষক হওয়া যায়। আর পরিচিতি না হলে যোগ্য লোকদেরও স্থান নেই। নাম না প্রকাশ করার শর্তে এসব শুনছিলাম কওমী ফারেগ ছাত্রের এক অভিভাবকের কাছ থেকে।
আহমাদ নগর পাইকপাড়া মিরপুর-১ এ অবস্থিত জামি‘আ ইসলামিয়া আরাবিয়া মাদরাসার মিজান জামাতের ছাত্র জাবেরের বাবার সাথে কথা বললে তিনি জানান, ‘‘আমি-আপনি আমরা সবাই চাই যে, আমার ছেলেটা স্বাবলম্বী হোক। মাথা উঁচু করে বাচুক। পরনির্ভর নয় আত্মনির্ভরশীল হোক। সমাজের চোখে একজন স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মানুষ হয়ে উঠুক। দেশের জন্য, দশের জন্য সেবা করুক। একজন প্রকৃত দায়ী হয়ে উঠুক। কেউই রাজি হবে না তার ছেলে টাকা কালেকশনের জন্য এভাবে পাড়ায় পাড়ায় দাপিয়ে বেড়াক। দান করার জন্য নয়; দান গ্রহণের জন্য। মানুষের পকেট মাপ-জোখ করার জন্য। অনেক সময় তাও আবার এমন স্বীকৃত কালোবাজারি ঘুষখোর ও সূদী মহাজনদের কাছে যেতে হয় যা সত্যি সত্যি আমাদের পক্ষে দুর্ভাগ্য ও নির্মম ব্যাপার মানতেই হবে। এগুলো বলতেও লজ্জা লাগে। দ্বীন শিখতে কেনো মানুষের দ্বারস্থ হতে হবে আমাদের? আমরা স্বাবলম্বী হলে কি কারো কোনো অসুবিধে হতো? ব্যক্তি স্বাতন্ত্রতা বলতেও তো একটা কিছু আছে। তাই আমার কাছে স্বীকৃতির মূল্য অনেক। এবং তা বাস্তবায়িত হওয়া খুবই জরুরী।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে একই মাদরাসার হিদায়াতুন নাহু জামাতের আরেক ছাত্র মনিরুল ইসলামের পিতার সাধাসিধে উত্তর, ‘শিক্ষা লাভ করেও আমাদের ছেলেদের নাম উঠেছে সরকারের নথিভূক্তে মূর্খতার খাতায়। এর চে’ আর বড় গ্লানি একজন অভিভাবকের জন্য আর কী হতে পারে? আমাদের ছেলেরা যে অনেক কিছু করে দেখাতে পারে সে সুযোগটাই তো তারা কোনদিন পায়নি! আর এ ধারা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে তাদের ভেতরকার সুপ্ত প্রতিভা চিরবিদায় জানাবে। হারিয়ে যাবে কোন অজানা অচেনায়। চাকরির প্রয়োজনে না হলেও শিক্ষার স্বীকৃতির তাগিদে হলেও স্বীকৃতির প্রয়োজন আছে’
এই মাদরাসার একজন ইফতা বিভাগের দায়িত্বশীল শিক্ষক মুফতী মাসূম বিল্লাহ অভিভাবকত্বের ভূমিকা নিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘স্বীকৃতি হলেই যে সরকার আমাদের আষ্টেপৃষ্টে বাঁধবে ব্যাপারটা আসলে তা নয়। বরং স্বীকৃতি পাওয়ার পরেও তো স্বীকৃতিপ্রাপ্তরা প্রয়োজনে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন তার উদাহরণও আমরা অনেক দেখেছি। তাই স্বীকৃতি পেলে ‘এই হবে, সেই হবে’ বলে বলে রাজনীতিবিদ আলেমরা যে সবাইকে ঘোল খাওয়ানোর চেষ্টা-তদবির করে চলেছেন তা এখন আমরা বিলক্ষন বুঝতে পারছি। এরাই আবার বিএনপির আমলে স্বীকৃতির জন্য কোমরে দড়ি দিয়ে রাজপথ দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন। মাঠে গরম থাকলে ছিলো কেবল এদের গরম। এসব রাজনীতিবিদ স্বার্থান্বেষী আলিমদের কারণে আমাদের কত কওমী প্রতিভা যে হারিয়ে যেতে বসেছে তার আদৌ কোন পরিসংখ্যান নেই। এসব নিয়ে আমাদের মুরুব্বী ও বড়দের কোন মাথাব্যথা নেই। আমরা বড়দের সমালোচনা করছি না। সমালোচনা করছি তাদের ছদ্মবেশী চাটুকার খাদেম মোসাহেবদের। যারা নিজেদের ইচ্ছেমতো স্বার্থ মোতাবেক বড়দের ওপর ছুরি ঘোরায়। আসল-নকল ঘুরিয়ে জিন-কাহেনদের মতো বড়দের কানে কথা ঢালে। তাই স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।’
আমরা কথা বলেছিলাম, জামেউল উলূম মাদরাসার মিশকাত বিভাগের ছাত্র সাজ্জাদ হুসাইনের পিতা জনাব আবূ হানিফের সাথে। তিনি বলেন, ‘কওমী মাদরাসার স্বীকৃতি দিলে কওমী মাদরাসার জন্যই ভালো হবে। পাঁচ বছর হিফযখানায়, দশ বছর কিতাবখানায়, দুই বছর অন্যান্য তাখাসসুসে পড়া-লেখা করার পর তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে মূর্খ থেকে যাচ্ছে এটা একদম বেমানান। স্বীকৃতি পেলে আলিমদের ফ্যামিলিও উন্নত হবে এবং বেশ উপকৃত হবে। তারা সবজায়গাতে কাজ করতে পারবে। অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠান যেমন সুযোগ পায় কওমীদের তেমন সুযোগ দিতে হবে। অন্যান্য সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের খরচ অর্ধেক জনগণ ও অর্ধেক সরকার যেমন বহন করে, তেমনি কওমী মাদরাসার খরচও অর্ধেক সরকার এবং অর্ধেক জনগণ ভোগ করবে।’
ঢাকার মোহাম্মদপুর লালমাটিয়ায় অবস্থিত জামি‘আ ইসলামিয়া লালমাটিয়া মাদরাসার মিজান জামাতের ছাত্র ওয়ালীউল্লাহর পিতা মাও. আব্দুল বারী স্বীকৃতি প্রসঙ্গে বলছিলেন, “স্বীকৃতির গুরুত্ব ঠিক ততটাই যতটা গুরুত্ব নাগরিকত্ব সার্টিফিকেটের। এতো বছর যাবত পড়াশোনা করে সার্টিফিকেট না থাকা সত্যি বড় আক্ষেপের বিষয়। তবে সার্টিফিকেটের নামে আধিপত্য বিস্তার কোনভাবেই গ্রহণীয় নয়। সিলেবাসে কিছু পরিবর্তন আনতে হলে বড়দের পরামর্শ সাপেক্ষে অবশ্য কিছুটা পরিবর্তন আনা যেতে পারে।”
অবশ্য কারো কারো মতামতে একটু ব্যতিক্রমও পাওয়া গেছে। তবে এই সংখ্যা অনেকটা গৌণ পর্যায়ের। তারা বলেছেন, ‘আল্লাহর রাযি-খুশির জন্য ছেলেকে মাদরাসায় দিয়েছি, তাই ওসব স্বীকৃতি-টিকৃতি আমাদের দরকার নেই।’
পরিশেষে আমরা বলবো, সবার মতামতের প্রতি আমাদের আন্তরিক সম্মান থাকা উচিৎ। তবে এই সুযোগে কেউ আবার স্বীকৃতির বিপক্ষে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের জাল যেনো বিছাতে না পারে সে দিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে সবার।
আরআর