শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


বঙ্গবন্ধু কেন বাকশালের সময় জমিয়তকে নিষিদ্ধ করেন নি?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

mibi

সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করলে দেশের সকল রাজননৈতিক দল নিষিদ্ধ করলেও আলেমদের রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে নিষিদ্ধ করেন নি। কী কারণে? কোন রহস্য ছিল এর পেছনে? এই ইতিহাস খুঁজতে গেলে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর কিছু ঘটনা প্রবাহ। দেশপ্রেমে উজ্জেবিত আলেম সমাজ সব সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ সেন্টিমেন্টের পক্ষে কথা বলেছেন। অন্যায়ের পতিবাদ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে আলেমদের রাজনৈতিক এই দলটির অসামান্য সাহসী ভুমিকার কারনে আলেম উলামাও জমিয়তের প্রতি ছিলেন গভীর শ্রদ্ধাশীল।

৭০-এর নির্বাচনে পিপলস পার্টি পরাজয় এবং আওয়ামীলীগের বিজয় হলে পিপলস পার্টি নেতা জুলফিকার আলী ভূট্টো বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অসম্মতি প্রকাশ করে বলেছিলেন-‘যারা জাতীয় পরিষদের বৈঠকে ঢাকায় যাবে তাদের পা ভেঙে দেওয়া হবে’। তখন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতারা জোর প্রতিবাদ করে বলেছিলেন- ‘বর্তমান সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট সমাধানের একমাত্র উপায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান এবং সংবিধান ও আইন বিষয়ক সকল বিষয়ই জাতীয় পরিষদে মীমাংসা করা’-(ক্বাইদে জমিয়ত মুফতি মাহমুদ, আশফাক হাশেমী)।

৭০- এর নির্বাচনের মাস-দিন পর অর্থাৎ ১৩ জানুয়ারি ১৯৭১-এ জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনার পর যখন নিশ্চয়তা পেলেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানকর্তৃক সরকার গঠিত হলেও তিনি নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকবেন, তখন ঘোষণা করেছিলেন- ‘শেখ মুজিবুর রহমান দেশের নির্বাচিত দলের প্রধান হিসেবে আগামী দিনের প্রধানমন্ত্রী। এতএব, রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে তার সিদ্ধন্তটাই চূড়ান্ত।’ কিন্তু ঢাকা থেকে ফেরার পথে দু’জন উর্ধ্বতন সেনা অফিসারসহ জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভূট্টোর সাথে ‘লারকানা’ এলাকাতে গিয়ে গোপন বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ঘোষণা দিলেন-‘শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর ও সংবিধান রচনার জন্য পূর্ব ও পশ্চিম-পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ উভয় দলের সমঝোতা পূর্বশর্ত।’ এই ফর্মূলা মূলত ছিলো পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভূট্টোর, পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য যা ছিলো যথেষ্ট। এক দেশে দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয় কীভাবে? এই প্রশ্ন উঠিয়ে তখন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতা মুফতি মাহমুদ, ন্যাপ নেতা ওয়ালী খান এবং শেখ মুজিবুর রহমান কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে বলেছিলেন-‘এমন উক্তি দেশকে দু-ভাগে বিভক্ত করার সমতুল্য।

২৭ জানুয়ারি ১৯৭১-এ ভূট্টো সাহেব ঢাকা এসে গেলেন। ফিরে গিয়ে পেশওয়ারে জমিয়ত নেতা মুফতি মাহমুদ, ন্যাপ নেতা ওয়ালী খান এবং মুসলিমলীগ নেতা কাইয়ূম খানের সাথে দেখা করে চেষ্টা করেন ৩ মার্চ আহূত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বর্জন ঘোষণা করাতে। আব্দুল কাইয়ূম খান ব্যতীত বাকি দু-জন অসম্মতি জানালেন ভূট্টো সাহেবের প্রস্তাবে। ভূট্টো সাহেব তখনই ঘোষণা করেছিলেন- ‘পিপল্স পার্টির কোনো সদস্য ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে গেলে তার পা ভেঙে ফেলা হবে এবং অন্যকোনো দলের সদস্য যদি ঢাকায় যান তা হলে তিনি যেনো পশ্চিম- পাকিস্তানে ফিরার টিকেট না করেন।’ পিপলস পার্টির নেতাকর্তৃক এই ঘোষণার প্রতিবাদে জমিয়ত নেতারা ঘোষণা করেন তারা ৪২ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য নিয়ে জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনে যোগ দিবেন।
উল্লেখ্য, এই ৪২ জনের মধ্যে ভূট্টো সাহেবের দল পিপলস পার্টির নেতা আহমদ রেজা কাসূরীও ছিলেন। ১৩ মার্চ ১৯৭১-এ জমিয়ত নেতা মুফতি মাহমুদ পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য লাহোরে সর্বদলীয় একটি বৈঠক ডাকেন। পিপলস পার্টি আর মুসলিমলীগের কাইয়ূম গ্রুপ (যা কাইয়ূমলীগ বলে পরিচিতি ছিলো) ছাড়া বাকি সকল দলের প্রতিনিধিরা এতে উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পেশকৃত চার দফা দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে পর্যালোচনা করে শেষ পর্যন্ত এই দাবিগুলোর সমর্থনে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। দাবিসমূহ ছিলো যথাক্রমে- ১. অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার, ২. সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনম্যান্টে ফেরৎ নেওয়া, ৩. সেনা অভিযানে ঘটিত প্রাণহানীর বিচারক বিভাগীয় তদন্ত, ৪. জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার আগে মতা হস্তান্তর। জমিয়ত নেতৃবৃন্দ ১৩ মার্চের বক্তব্যকে স্পষ্ট ভাষায় ইয়াহিয়া- ভূট্টোর নীতিকে ভুল আখ্যায়িত করে অবিলম্বে জনপ্রতিনিধিদের কাছে মতা হস্তান্তরের দাবি জানান। জুলফিকার আলী ভূট্টো সাহেবের প থেকে সত্তরের নির্বাচনের পর যখন ঘোষণা করা হলো- ‘ওখানে তুমি, এখানে আমি।’ তখন মুফতি মাহমুদ প্রতিবাদ করে বলেছিলেন- ‘পাকিস্তানের ঐক্য ভেঙে গেলে রাজনৈতিকভাবে পশ্চিম-পাকিস্তানের পরিভাষা অর্থহীন হয়ে যাবে। তখন কোনো দলের পে পশ্চিম-পাকিস্তানের মতা একা হাতে তোলে নেওয়া যুক্তিহীন হয়ে যাবে। কেনো না পিপলস পার্টি সারা পশ্চিম পাকিস্তানের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নয়, তারা কেবল সিন্ধু ও পাঞ্জাবের প্রতিনিধি মাত্র। সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করার কোনো অধিকার তাদের নেই। তা ছাড়া জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল একটাই থাকে, আর সে দল হলো আওয়ামী লীগ। সুতরাং প্রেসিডেন্টের উচিত তাৎকনিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান করা’- (ক্বাইদে জমিয়ত মুফতি মাহমুদ, আশফাক হাশেমী/ সাপ্তাহিক কৌমী ডাইজেষ্ট)
অপরদিকে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ভারতের সভাপতি সৈয়দ আসআদ আল মাদানী পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সিংহের মতো গর্জে উঠে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন। তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও নিরীহ বাঙালিদের পক্ষে জোরালো বক্তব্যেরর মাধ্যমে বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আর্কষণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে ভারতীয় আলেমদের সর্ববৃহৎ সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ১৯৭১ সালের ১৮ই আগস্ট মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে (কলকাতা) আয়োজিত সভায় বাংলাদেশের পক্ষে এবং পাক বাহিনীর হামলার একটি প্রতিবাদ প্রস্তাব পাশ করে। রেজুলেশনটির কিয়াদংশ নিচে উল্লেখ করা হলো : Resolution : 1 – whereas this convention of the jamiat -e – ulema is of the considered view that the freedom movement of the people of east Bengal. eighty five percent of whom are Muslim is a fight against economic exploitation and suppression of their Democratic rights by the west Pakistan military regime, And whereas this convention is satisfied that this movement is for upholding the principles of democracy, equally and social justice which Islam has contributed to mankind. the jamiat -e – ulema extends the whole hearted support to this freedom movement. ( সূত্র : শায়খুল ইসলাম সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী, ড.মুশতাক আহমদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
দিল্লিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে ভারতের উলামায়ে কেরাম তার নেতৃত্বে বিশাল জনসমাবেশ সহ প্রায় ৩০০টি প্রতিবাদ সভা করেন । এসমাবেশ থেকেই সর্বপ্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিদেশ থেকে আওয়াজ তুলা হয়। সীমানা পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধের পক্ষে ভারতের আলেমরাই সর্ব প্রথম গন আন্দোলন তৈরি করে আন্তর্জাকিক বিশ্বের দৃষ্টি আর্কষন করেন। এসব কারনে বঙ্গবন্ধু জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে নিষিদ্ধ করেন নি। যা ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদার মানসিকতা ও আলেমপ্রীতির এক অনন্য উজ্জল নমুনা।
লেখক: চিকিৎসক, গবেষক গ্রন্থপ্রণেতা

এফএফ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ