শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


সন্ত্রাসবাদ ও মুসলিম নেতাদের ভাষা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

oic_dhaka copyমুসা আল হাফিজ; আওয়ার ইসলাম

ওআইসি মহাসচিব এসেছেন। পত্রিকায় দেখলাম প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক এর বৃত্তান্ত। প্রধানত যা আলোচনায় এলো, তার প্রতিপাদ্য হচ্ছে সন্ত্রাস। পত্রিকার রিপোর্ট থেকে যে বয়ান পেলাম, তাতে মহাসচিবের ভাষ্যে কোনো নতুন বার্তা নেই। খুবই গতানুগতিক। সন্ত্রাস মুসলিম জাহানের সমস্যা, ঠিক আছে। আরেকটি প্রধান সমস্যা হচ্ছে মানসিক গোলামী, হীনমন্যতা, আমি যাকে বলি পরাজিত মানসিকতা। মুসলিম জাহানে খুব কমই বুদ্ধিজীবি আছেন, যাদের কথা ও কর্ম এই পরাজিত মানসিকতায় আচ্ছন্ন নয় ।

জঙ্গীবাদ নিয়ে যখন আমরা কথা বলি, তখন এই মানসিকতা একেবারে সহজেই ধরা দেয় । না বুঝেই বাকভঙ্গিতে বুঝাতে চাই সন্ত্রাসবাদ যেন কেবল ইসলামের ব্যাপার । ও আই সির মহাসচিব তার বক্তব্যেও একে এড়িয়ে যেতে পারেননি । সন্ত্রাসবাদ প্রশ্নে দেখলাম মুসলিম বিশ্ব এ পর্যন্ত শুধু ওজরখাহি করে আসছে । কিন্তু কেন ? সন্ত্রাস কী শুধু মুসলিমব্যাপার ? ক্রুসেডার প্রচারপ্রকল্পই কেবল বলতে চায় সব মুসলমান সন্ত্রাসী নয়, তবে সব সন্ত্রাসী মুসলমান। মানে সন্ত্রাসবাদ নিছক মুসলিমব্যাপার। মুসলিম নেতাদের কথা থেকে যেন ঘুরে ফিরে এমনই কিছু উচ্চারিত হচ্ছে । কিন্তু ১ আগস্ট ২০১৬ এ ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস তার বক্তব্যে বলতে পেরেছেন ধর্ম নয়, সামাজিক অন্যায় ও অর্থের পূজাই সন্ত্রাসের প্রধান কারণ । ইসলাম নয়, সন্ত্রাস সর্বত্রই আছে, ক্যাথলিকদের মধ্যেও আছে। ও আই সির মহাসচিব কি এমনটি বলতে পারতেন না? তিনি ইতিহাস থেকে নিয়ে আসতে পারতেন না সন্ত্রাসের উৎস ও উৎপত্তির কিছু তথ্য? তিনি বলতে পারতেন সন্ত্রাস কোনো ধর্ম বা জাতির ব্যাপার নয়। ধর্মীয় সন্ত্রাস মূলত এসেছে পাশ্চাত্য থেকে।

৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সেনাপতি টাইটাস জেরুজালেম অবরোধ করে ধ্বংস করেন। তিনি কমপক্ষে দশ লক্ষ ইহুদি হত্যা করেন ও জীবিত ইহুদিদের যুদ্ধবন্দী হিসেবে রোম তথা ইউরোপে নিয়ে যান। এ ঘটনার নয় বছর পর ৭৯ খ্রিস্টাব্দে ইতালির ভিসুবিয়াস আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণে পম্পে ও হার কুলানিয়াম শহর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। অনেকেই মনে করেন, এটা ইহুদিদের ও নব্য খ্রিস্টানদের ওপর রোমান জুলুমের খোদায়ী শাস্তি। রোমান সম্রাট নিরেন (৫৪-৬৮ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন মা ও গর্ভবতী স্ত্রী হন্তা, নব্য খ্রিস্টানদের রঙ্গমঞ্চে সিংহ দিয়ে ভক্ষণ করাবার হুকুম দেন তিনি। জোসেফাইন বেকন সম্পাদিত কোয়ান্টাম বুকস লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘দি লামট্রেটেড আটলাস অব জুয়িস সিভিলাইজেশন’ গ্রন্থ জানাচ্ছে “রোম সেনাপতি টাইটাস জুডিয়ার শতকরা পঁচিশ ভাগ ইহুদিকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং বাকি দশ ভাগকে দাস করে (পৃষ্ঠা-৪৭) এর সঙ্গে তুলনা করুন, খলিফা হযরত ওমর উটের লাগাম ধরে জেরুজালেমের দখল নিলেন ৬৩৮ সালে। আত্মসমপর্ণের পর একটা মানুষকে হত্যা করেনি মুসলমান সেনাবাহিনী। ক্রুসেডাররা নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায় আরব ভূমিতে। এতে যারা অংশ নেয় প্রায়ই জার্মান উপজাতি, যারা তখন ফ্রাঙ্ক নামে পরিচিত। ১০৯৯ সালে জেরুজালেমে ঢুকে তারা চালায় ‘সব বয়সের ও লিঙ্গের মানুষের ওপর লাগামহীন হত্যাকাণ্ড। (পিকেহিট্টি , দি হিস্ট্রি অব এ্যারাবস , পৃষ্ঠা-৬৩৯)

pope

প্রত্যক্ষদর্শী রেমন্ড ভি এজাইলেস বর্ণনা করেন, ওমরের মসজিদের দর-দালানে রক্ত জমা হয় হাঁটু পর্যন্ত আর রক্ত ঘোড়ার জিন পর্যন্ত পৌঁছে। (মিকড, হিস্টরি অব ক্রুসেডস) সত্তর হাজার জেরুজালেমবাসীকে হত্যা করা হয় (সৈয়দ আমীর আলীর হিস্টরি অব দি সারাসেনস, পৃষ্ঠা-৩২৮)। অথচ এই শহরে বিজয়ী হয়ে কোনো বন্দীকে হত্যা করেন নাই খলিফা ওমর ও সালাউদ্দিন আইয়ুবী। ১১৮৭ সালে সালাউদ্দিন আইয়ুবী ফ্রাঙ্ক জার্মানদের হাত থেকে জেরুসালেম উদ্ধার করেন। এর পরে আক্কা শহর দুই বছরে ধরে (১১৮৯-১১৯১) ক্রুসেডররা অবরোধ করে রাখে। আক্কার পতন হয় ক্রুসেডরদের কাছে। আত্মসমর্পণের একটা শর্ত ছিল দুই লাখ স্বর্ণমুদ্রা মুক্তিপণ হিসেবে শোধ করলে মুসলিম বন্দীদের ছেড়ে দেয়া হবে। যখন এক মাসের ভেতর অর্থ পরিশোধ করতে দেরি হলো, ইংরেজ রাজা রিচার্ড সাতাইশ হাজার মুসলিম বন্দীকে হত্যা করলেন। অথচ সালাউদ্দিন কর্তৃক জেরুজালেম দখলের পর স্বাধীন বন্দীদের সঙ্গে তার ব্যবহারের স্পষ্ট বিপরীত। সালাউদ্দিনও তখন খ্রিস্টান বন্দীদের মুক্তির জন্য মুক্তিপণ নির্ধারণ করেন। তবে কয়েক হাজার গরিব খ্রিস্টান বন্দী মুক্তিপণ দিতে অসমর্থ ছিল। সালাউদ্দিন তার ভাইয়ের অনুরোধে এক হাজার গরিব খ্রিস্টান বন্দীকে বিনা মুক্তিপণে ছেড়ে দেন; খ্রিস্টান পাদরির অনুরোধে আর একদল খ্রিস্টানকে ছাড়া হয় বিনা মুক্তিপণে। যখন সালাউদ্দিন দেখলেন, তার ভাই ও খ্রিস্টার পাদ্রি সওয়ার অর্জন করেছেন, আর তার নিজের সময় এসেছে এখন, তখন সালাউদ্দিন বহু নারী ও শিশুসহ বাকি খ্রিস্টান বন্দীদের অনেককে বিনা মুক্তিপণে ছেড়ে দেন।’ (হিট্রি, ঐ , পৃষ্ঠা-৬৫১)।

ইতিহাস প্রমাণ দেয়, মুসলমানরা উগ্রবাদী নয়। এ দোষে দোষী অন্যরা। ইউরোপে দ্বিতীয় তথাকথিত শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ, যা আসলে ১১৬ বছর ধরে চলে ১৩৩৭ থেকে ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত। জন ভ্যান ডুন সাউথ ওয়ার্থ লেখেন, “ইংল্যান্ডের পাঁচ রাজা, ফ্রান্সের পাঁচ রাজা এবং কমপক্ষে ফরাসি ও ইংরেজ জাতির তিন প্রজন্ম সত্যিকারের শান্তির স্বাদ থেকে বঞ্চিত ছিল।” (দি হিস্টরি অব দি ওয়ার্ল্ড, পৃষ্ঠা-১৭৮)

ত্রিশ বর্ষব্যাপী যুদ্ধ (১৬১৮-১৬৪৮) যা পশ্চিম ইউউরোপে দ্বিতীয় রোমান ক্যাথলিক ও এটেসটান্টদের ভেতর। তাতে হলি রোমান সাম্রাজ্যের প্রায় অর্ধেক মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় (সাউথ ও ওয়ার্থ, পৃষ্ঠা-২১৬)। হলি রোমান সাম্রাজ্যের ভিতর ছিল জার্মানি, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, লাইকটেনস্টেন, লুকসেমবাগ, চেক রিপাবলিক, স্লোভেনিয়া বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস এবং আধুনিক পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালির বৃহত্তর এলাকা। ধরে নিন ইতালি থেকে নেদারল্যান্ডস পর্যন্ত তার অর্ধেক লোক খ্রিস্টানরা হানাহানি করে হত্যা করেছে।

ফরাসি বিপ্লবেও (১৭৮৯) চলে নৃশংসতা। বিপ্লবীদের ‘রেন অব টেরর’ (সন্ত্রাসী শাসন), গিলোটিনে কলা কাটা চলে নির্মমভাবে বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষকে খতম করছে। সাউথওয়ার্থ লেখেছন : ‘হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় কোনো রকম সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার ছাড়াই’ (পৃষ্ঠা-২৯০)।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, জার্মানির হিটলারের নাৎসিবাদ, ইতালির মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ, রুশ বিপ্লব, মাও বিপ্লব, আরবদের উৎখাত করে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি নানা ঘটনা ছিল সহিংস ও রোমহর্ষক। এসবের প্রভূত প্রভাব মুসলিম তরুণদের ওপর এসেছে। তিনি মুসলিম তরুণদের আহ্বান করতে পারতেদন এই সব প্রভাবকে প্রত্যাখান করে ইসলামের মূলনীতিতে প্রত্যাবর্তনের জন্য । তিনি পেশ করতে পারতেন কুরআন - হাদীসের সেই দর্শন, যা একজন মুসলিমকে কোনো দিন সন্ত্রাসী হতে দেয় না!

লেখক: কবি, কলামিষ্ট ও গবেষক


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ