শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫


আরেকজন কামাল পাশার জন্ম না হোক

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মনযূরুল হক, অতিথি লেখক; আওয়ার ইসলামmanzurul hak

অভ্যুত্থানের বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারলেও প্রেসিডেন্ট এরদোগান ধীরে ধীরে নিজ থেকেই যে বিপর্যয় সৃষ্টি করে চলেছেন- তা থেকে মুক্তি পাবেন কি না, সে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

এ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন সরকারি বিভাগ থেকে প্রায় ৬০ হাজার কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করেছেন, তার মধ্যে ভার্সিটির শিক্ষকও আছেন অন্তত দেড় হাজার। তা ছাড়া আরও ১০ হাজার ব্যক্তিকে আটক করেছেন তিনি নানান উসিলায়। কয়েক হাজার সেনাকর্মকর্তাকে বিভিন্ন অভিযোগে-অজুহাতে বন্দি করেছেন। প্রেসিডেন্ট গার্ড ভেঙ্গে দেয়ার ঘোষণা শুনলাম। এই গার্ড বাহিনীরও ৩০০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।  ‘টার্কিশ এয়ারলাইন্স এর ২১১ কর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। স্থানীয় কয়েকটি গণমাধ্যম বলেছে, বরখাস্ত হওয়া কর্মীর সংখ্যা ৩৫০ জন।  এর মধ্যে ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের ১০০ কর্মকর্তা ও ২৫০ জন কেবিন ক্রু রয়েছেন।

যে ১০৪ জন সেনাকর্মকর্তা অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন, তাদেরকে তুরস্কের মাটিতে দাফন করতে না দেয়ার দাবিও উঠেছিলো জোর আওয়াজে। কারণ তারা গাদ্দার। আমাদের অনেকেই দেখলাম- গাদ্দারদের দাফন করতে না দেওয়ায় বেশ খুশি। ইতিহাসে কখন যে কে গাদ্দার হয়, কে জানে? প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফিকেও কি তার জনগণ গাদ্দার বলে নি? আমরা কি তার নারী দেহরক্ষীদের বহর দেখে আশ্চর্য হই নি? এই গাদ্দার প্রবক্তাদের মতামতই কি তুরস্কে হানড্রেড পার্সেন্ট স্বীকৃত, নাকি তারা আমাদের দেশের মতোই দলান্ধ, তা-ইবা কে জানে! ইতিহাসে এই খেলাটাই মাঠে গড়ায় সবচে বেশি।

এই যে হাজার হাজার মানুষকে বন্দি করা, এর প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই কয়েক লক্ষ পরিবার, কয়েক লক্ষ প্রতিষ্ঠান এবং অজস্র জনপদে গিয়ে পড়বে। হয়তো এই বন্দি মানুষদের সন্তান, স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীরা এরদোগানকে ভালোবাসে। তার জন্যে আদুল গায়ে ট্যাংকের সামনে দাঁড়িয়েছে হয়তো কোনো তরুণ; যার বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বিদ্রোহের অভিযোগে। এভাবে বিমানকর্মী, ফ্যাক্টরির অফিসার, সচিবালয়ের কর্মকর্তা, সেনাসদস্য কিংবা এমনতরো নানা প্রতিষ্ঠান থেকে যাদের বরখাস্ত করা হয়েছে, আটকে রেখে ইন্টারগেশনে পাঠানো হয়েছে, প্রকারন্তরে এই শ্রেণিটাকে এরদোগান নিজের ভালোবাসার মানুষদের মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এখন চাকরি হারানো বাবা, ভাই, বোন, সহপাঠী, সহকর্মীদের বেদনা দেখে এরদোগানের ভক্তদের যে প্রতিক্রিয়া হবে- মূল জটিলতাটা সৃষ্টি হবে সেখান থেকে। কোনটা বেশি শক্তিশালী- আবেগের ভালোবাসা, নাকি বাস্তবতার বেদনা?

সুতরাং এই প্রতিক্রিয়া থেকে একটা তীব্র চাপা ক্ষোভ জন্ম নিতে সময় লাগবে না; সময় লাগবে ক্ষোভটা পুঞ্জিভূত হয়ে উঠতে। কিন্তু সেই সময়টা যদি তারা পেয়ে যায় কোনোমতে, তাহলে যে বিস্ফোরণ ঘটবে, সেটা নিরসনের কোনো আয়োজন কি আমরা দেখছি? সেনাবাহিনী জানিয়েছে, অভ্যুত্থানের পর তাদের ৪২টি হেলিকপ্টার ও ১৪টি যুদ্ধজাহাজ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিস্ফোরণের কালে এই ইকুইপমেন্টগুলো বেরিয়ে না আসলে হয়। আমাদের দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাও যেই দেশে নেই, তেমন একটি দেশে এটা যে কত জটিল হয়ে উঠতে পারে- অনুমান করতে কষ্ট হয় না।

তা ছাড়া, এই অভ্যুত্থানও নিশ্চয় কোনো ক্ষোভ থেকে হয়েছে। সেই ক্ষোভটা কী- সেটা কিন্তু এখনও চিহ্নিত করা হয়নি। বরং পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি ক্ষোভ দমন করার একটা দুর্দমনীয় চেষ্টা। বিপক্ষ দলের কারও কোনো কথাই কোথাও উচ্চারিত হচ্ছে না এবং এ পর্যন্ত বিদ্রোহীদের কোনো জবানবন্দীও আমরা পাইনি। সন্দেহ নেই- অনেক সৈনিকই জানতো না বিদ্রোহের কথা। মহড়ার কথা বলে রাস্তায় নামানো হয়েছে- এমন একটা প্রচ্ছন্ন আওয়াজ উঠেছিলো। ঘটনা তেমন হলে জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া বিরাট অংশকেই নিরাপরাধ ভাবতে হবে।

turky1

আমাদের দেশের জেনারেল জিয়ার উদাহরণটা আমরা নিতে পারি। আমরা হুমায়ূন স্যারের সেই বিখ্যাত কয়েকটা লাইন স্মরণ করতে পারি, ‘জিয়াউর রহমান অতি ভাগ্যবান মানুষদের একজন। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে তিনি বাংলাদেশের সপ্তম প্রেসিডেন্ট। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েম এক ঘোষণায় জানান- ‘আমি সাদাত মোহম্মদ সায়েম শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে পড়েছি। সুতরাং আমি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করেছি এবং তার কাছে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব অর্পণ করছি।’ রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা হাতে নিয়ে জিয়াউর রহমান স্বৈরশাসক হয়ে গেলেও বাংলাদেশের অনেক মানুষ ব্যাপারটা বুঝতে পারলো না। তারা ভাবল, কী শক্তিমান প্রেসিডেন্ট! এমন মানুষই আমাদের প্রয়োজন। জিয়া কঠিন যুদ্ধাপরাধীদের পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে এনে নাগরিকত্ব দিলেন এবং বিশেষ ক্ষমতায় বসালেন। একে একে বিশেষ সামরিক আদালতে হত্যা করতে থাকলেন মুক্তিযোদ্ধা সেপাই ও অফিসারদের। এদের দীর্ঘনিঃশ্বাস জমা হলো চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে। তারিখ ৩০ মে রাত এগারোটা। জিয়া প্রাণ হারান তার এক সময়ের সাথী জেনারেল মঞ্জুরের পাঠানো ঘাতক বাহিনীর হাতে।’

তুরস্কের সেনা অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দেয়ার নায়ক নিশ্চয়ই প্রেসিডেন্ট এরদোগান। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কৃতিত্বটা তার। তবে তিনি পুরোপুরি মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ নিয়ে কাজ করছেন, এমনটি না ভাই ভালো। মন্দের ভালো বললে বলা যেতে পারে।  প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সবচে’ বড় অসুবিধাটা হলো, তিনি নিজেকে মুসলিম বিশ্বের একজন নেতা হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন। এর কারণও আছে। টুইটারে দেখলাম, ইতোমধ্যে পাকিস্তানের আল্লামা তকি সাহেব তাকে সাধুবাদ জানিয়ে দীর্ঘ পত্র লিখেছেন। এই রকম আরও বহু স্কলার থেকে তিনি অযাচিত স্বীকৃত পেয়েছেন। যেমনটা পেয়েছিলেন মিশরের মুরসি এবং লিবিয়ার গাদ্দাফি। ‘অসুবিধা’ বললাম, কারণ, মুসলিম নেতা হিসেবে দাঁড়ালে নৈতিক স্বচ্ছতা দেখাতে হয়, দায়িত্ব বাড়ে। আবার শত্রুর সংখ্যাও বাড়ে। জনসমর্থন দিয়ে এই শত্রুকে ঘায়েল করা যায় না। এরদোগান কি এই জন্যেই ইসরায়েলকে পাশে রেখেছেন? যদি তা-ই হয়, তাহলে গভীরে গেলে বুঝে আসবে, আইএস ও আমেরিকাকে সাপোর্ট করার যে অভিযোগ তার ওপর আছে তা সর্বাংশে মিথ্যা নয়। এমন হলে সিরিয়ায় আঘাত হানতে যাওয়া মার্কিন বিমানঘাঁটি খুলে দেওয়া এবং ইসরায়েলের সঙ্গে দহরম-মহরম প্রেসিডেন্টকে আজ না হোক কাল মুসলিম বিশ্ব থেকে ছিটকে ফেলার রসদ যোগাবে নিশ্চিত।

কুর্দিদের স্বাধীনতার দাবি উচ্চকিত হয়ে আছে বহুবছর ধরে। কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি বা পিকেকে’র সঙ্গে গুলেনের আন্দোলনকে তিনি বলেছেন, সন্ত্রাসবাদী। একটু বেশি হয়ে গেলো না?  গুলেন যে এক সময় তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, এটা প্রায় সবার জানা।  আর সম্প্রতি সময়ে কুর্দিরা নির্বাচনে বেশ ভালো অবস্থান গড়ে নেয়ার খবরও বলে, কুর্দিদের কোণঠাসা করে রাখার এটা কোনো কার্যকর পদ্ধতি নয়। এরদোগানের উদারতায় তারা নির্বাচনের সুযোগ পেলেও এখন কি তিনি তাদের আবার নিষিদ্ধ করতে পারবেন? যদি করেন, তাহলে কি সন্ত্রাসবাদ আরও উস্কে উঠবে না? এরদোগান কি কুর্দিদের ঠেকাতে আইএসকে আবার ঘরে তুলতে পারবেন?

turky4

তুরস্কের মানুষ বহুকাল ধর্মীয় পরিবেশে থেকেছে সত্য। কিন্তু ১৯২৪ সালের ১ মার্চ সংসদে কামাল পাশার  দেয়া বক্তব্য- ‘ইসলাম যদি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না হয় তবে তার উন্নয়ন হবে’ বলার পরে সেনাবাহিনী সেখানে পুরোপুরি সেকুলার হতে থাকে। কোন স্পেইস থেকে কামাল পাশা উঠে এসেছিলেন এবং একচ্ছত্র ক্ষমতা হাতে পেয়ে কোনখানে আঘাত করেছিলেন, মনে রাখা দরকার। ভুলে গেলে চলবে না, মধ্যপন্থী একেপি ক্ষমতায় এলেও তুর্কি সেনাবাহিনী নতুন ধার্মিক হয়ে ওঠেনি। যেমন হয়নি ইরাকি বাহিনী। হয়নি মিশরের বাহিনী। একজন সাদ্দাম, একজন জেনারেল সিসি, একজন জেনারেল আসাদ, একজন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ কোন ফাঁক গলে বেরিয়ে এসেছিলেন আমাদের ভাবতে হবে। সুতরাং আবেগে আত্মহারা হয়ে যাকে তাকে ধরে বেঁধে গাদ্দার বলে দেয়ার পরিণতি শুভ হয় না কখনোই।

আমরা চাই না, বিজয়ের অহঙ্কারে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত ভুলে যাক তুর্কিরা। আমরা চাই না, আরও একটি দেশ ইতিহাসের গর্তে পড়ে যাক। ইরাক-সিরিয়ার মতো নিজেদের দম্ভের আগুনে শেষমেষ নিজেরাই যেনো পুড়ে খাক হয়ে না যায়। এরদোগান তুর্কিস্তানের আনোয়ার পাশা হোক। আরেকজন কামাল পাশার জন্ম না হোক।

মনযূরুল হক: কলামিস্ট, গল্পকার ও অনুবাদক

আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম /আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ