বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৫ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিরোনাম :

শাহিনের ঈদ শপিং

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

aminul islamরাত তখন ৮-২৫ পি.এম.। শাহিন তার রিক্সাটা এক পাশে রেখে ‘ফোন ফ্যাক্সের দোকানে ঢুকে। নাম্বারটা লাগিয়ে অপেক্ষা করছে- টু...ট, টু...ট হ্যালো।

: হ্যালো মামি, ভালো আছেন?

: কেডা শাহিনে?

: হ মামি, মাইরে একটু দেন।

: দিতাছি।

: বাজান শাহিন.. কেমন আছস বাজান?

: হ মা আমি ভালই আছি। তুমি কেমুন আছ? নাছিমা রাকিব কেমুন আছে?

: আমডা সব্বাই বালা আছি বাজান। তুই কইলাম ঈদের দুইদিন আগেই চইললা আইবা।

: আইচ্ছা আইয়াম। আইচ্ছা মা তোমার লাইগগা কি মেষ্টা রঙের শাড়ী আনতাম নাকি আকাশি রঙের আনতাম?

: আমার লাইগা কিচ্ছু আনন লাগবো না। পারলে রাকিবের লাগি একটা পাঞ্জাবী আনিস।। বাজান! তোর ম্যালা কষ্ট হ না! আমারে তুই মাপ কইরা দিস বাজান... এতটুকু বলেই রাকিবের মা কাঁদতে শরু করেন।

: মা তুমি কাইন্দ না, কইলামতো আমার কোনো কষ্ট হয় না। তোমার দু'আ আমার লগে আছে না! মা দেইখো একদিন সত্যিই সত্যি আমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করাম। আমারে লইয়া তুমি যেই স্বপ্ন দেখতা তা আমি রাকিবরে দিয়া পূরণ করাম। রাকিবরে বড় আলেম বানাইয়াম। মা অহন তাইলে রাইখা দেয়। আল্লাহাফেজ।

: আল্লাহাফেজ। রাকিব মোবাইলটা দোকানীকে দিয়ে জিজ্ঞেস করে

: ভাই কই মিনিট হইছে ?

: আট মিনিট।

শাহিন আট মিনিটের টাকা পরিশোধ করে রিক্সার পেডেলে পা রাখে। কিছুদূর যাওয়ার পর এক ভদ্রলোক ডাক দেয়

: এই রিক্সা যাবে?

: কোথায় যাবেন স্যার?

: নিউ মার্কেট।

: উঠেন।

ভদ্রলোক রিক্সায় চেপে বসলে শাহিন পেডেল চাপাতে শুরু করে। মিনিট পাঁচেক পর লোকটি শাহিনকে জিজ্ঞেস করেন

: আচ্ছা এই বয়সেই তুমি এমন কঠোর পরিশ্রমের কাজে লেগে গেলে কেন? এখনতো তোমার লেখা-পড়ার বয়স। নিজেকে গড়ে তোলার সময়, ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন দেখার সময়।

: স্যার! স্বপ্ন দেখার অধিকার কি আর সবার থাকে? আমরাতো গরিব, আর গরিবদের তো স্বপ্ন দেখতে নাই। এতে কেবল কষ্ট ছাড়া অন্য কিছু নাই।

: না না না। তোমার কথার সাথে আমি একমত হতে পারছি না। স্বপ্ন দেখার অধিকার সবার জন্য সমান। এখানে ধনি-গরিব বলে কিছু নেই। বাই দ্যা ওয়ে, তুমিতো বেশ গুছিয়ে কথা বল। মনে হচ্ছে তুমি শিক্ষিত ফ্যামিলির ছেলে। তা এ পথে এলে কেন? নিশ্চয় তোমাদের পরিবারে খুব বড় ধরণের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমাকে কি খুলে বলবে?

: আমার কষ্ট আমার কাছেই থাক না। অযথা কেন আপনি বোরিং হবেন।

: দেখ আমি একজন লেখক। আমি চাই তোমার এই কষ্ট সবাই জানুক। আমি তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাই ওইসব মানবাধিকার নেতাদের যারা মঞ্চ কাঁপায় মিথ্যার ফুলঝুরি দিয়ে। তারা দেখুক তোমার এই কষ্ট। আমি দেখতে চাই তাদের মন আজ কতটুকু কাঁদে।

: স্যার আপনার গন্তব্য এসেছে। এই বলে শাহিন রিক্সা থামিয়ে নিচে নামে।

: আচ্ছা নাম কি তোমার?

: শাহিন।

: চলো কিছু খেয়ে নেবে।

: না স্যার, ভাড়াটা দিয়ে দেন। আমায় আরো খ্যাপ মারতে হবে। ভদ্রলোক শাহিনকে পাঁচশো টাকা দিতে চাইল কিন্তু শাহিন তা নিল না। প্রাপ্য ভাড়া নিয়ে পূনরায় রিক্সার পেডেলে পা রাখে।

ঈদের বাকি আর মাত্র দু'দিন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে শাহিন দেখল রাত ০১.০০. এ.এম। সাহিন তার ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দেয়। শাহিন দু'চোখের পাতা এক করার চেষ্টা করে। কিন্তু তা যেন সম্ভব হচ্ছে না। ঘুম পরিরা কোথায় যেন উড়ে গেছে। তার দু'চোখে ভেসে উঠে গত দু'বছর আগের ঈদ স্মৃতিগুলো। তখন সে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। সে সময়ের ঈদগুলোতে কত আনন্দ হত। বাবার ডান হাত ধরে ঈদগাহে যেত। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ত। মোনাজাতে বাবা ডুকরে ডুকরে কাঁদতেন। বাবার কাঁদা দেখে সেও কিছু না বুঝেই কেঁদে দিত। শাহিনের এখনো মনে আছে একবার শাহিন বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, বাবা আপনি মোনাজাতের সময় এত কাঁদেন কেন? সেদিন বাবা বলেছিলেন, ওনি তাঁর বাবার জন্য কাঁদেন। বাবা যেন জান্নাতি হোন সে জন্যই কেঁদে কেঁদে দু'আ করেন। শাহিন বুঝতে পারছে তার দু'চোখও অশ্রুজলে কেমন ছল ছল করছে। বাবার দেয়া পাঞ্জাবীটা এখনও আছে শুধু বাবাই নেই। শাহিন লম্বা একটা নিঃশ্বাস ছেরে অস্পষ্ট বলে, বাবা কোথায় তুমি? শাহিনের বাবা খলিল মিয়া একজন সাদা মনের মানুষ। দীনদার ও পরহেজগার। কোনো দিন কারও উপকার ছাড়া অপকার করেন নি। চেয়ারম্যানের দিঘীর প্রহরী ছিলেন। মাস শেষে যে বেতন পেতেন এতে মোটামুটি তাঁদের চলে যেত। একরাতে তিনি টহল দিচ্ছেন হঠাৎ দিঘীর পূর্ব পাশের ঝোপের ভেতর ফিসফিস আওয়াজ শুনতে পান। খলিল মিয়া ঝোপের দিকে এগিয়ে যান। তিনি দস্যুদের কথা শুনতে পেলেন। এরা মাছ চুরি করতে এসেছে। খলিল মিয়া তাদের হাতে নাতে ধরে ফেলেন। দস্যুরা তাঁকে টাকার লোভ দেখায়। কিন্তু তিনি যে খাঁটি মানুষ। ওদের টাকার থলেতে তিনি লাথি মারলেন। এতে ওরা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে। দশ-বারোজন একসাথে খলিল মিয়ার উপর চড়াও হয়। তিনিও লড়ে যান অনেক্ষন, কিন্তু একজন কি আর দশজনের সাথে পারে? তাই তিনিও ওদের সাথে পেরে ওঠলেন না। এক সময় কোনো এক দস্যুর হাতে চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় খলিল মিয়ার নিঃশ্বাস। ভোরে খবর পেয়ে শাহিন ও তার মা ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু তখন তাদের কাঁদা ছাড়া আর কিইবা করার থাকে? সেই থেকে শাহিনদের পরিবারে নেমে আসে অমাবস্যার রাত। শাহিনের মা প্রথম কয়েক মাস মানুষের বাড়ি-ঘরে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই শাহিনকেই সংসারের হাল ধরতে হল। বাধ্য হলো শহরে এসে রিক্সা চালাতে। এখান থেকেই শুরু হয় তার নতুন জীবন।

কাল ঈদ শেষ বারের মতো ব্যস্ত শহরের মানুষগুলো যেন আরো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শপিং সেন্টার থেকে শুরু করে রাস্তার পাশের ফুটপাতের দোকানগুলোতেল্লল পর্যন্ত মানুষের উপচে পরা ভীড়। আর দোকানীরাও কায়দা করে দাম হাঁকাচ্ছে সাধ্যের বাইরে। তাই ক্রেতা বিক্রেতাদের মাঝে চলতে থাকে দাম কষাকষির বাকযুদ্ধ। তারপর এক সময় ক্রেতাকেই হার মানতে হয়। চড়া দামেই নিতে বাধ্য হয় পছন্দের বস্তুটি। কেন না ঈদ বলে কথা। শাহিনও ছুটছে এক দোকান থেকে অন্য দোকানে। শাহিনের কাছে মনে হচ্ছে ও যেন ঈদের বাজারে নয়, যুদ্ধের ময়দানে এসেছে। ওর বাজেট মাত্র তিন হাজার। এর মধেই মায়ের জন্য শাড়ি, ভাই-বোনদের জন্য জামা আর সামান্য সেমাই চিনির ব্যবস্থা করতে হবে। শপিং শেষে দেখা গেল বাজেটের বাইরে চলে গেছে হিসেবের খাতা। সে যাইহোক, শাহিনের মনে আজ আনন্দের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে। এক আত্মতৃপ্তির সুখে স্বপ্নের নীলিমায় যেন সে উড়ছে। সবকিছু গুছিয়ে রাত ১২.৩০ মি. বাড়ির উদ্দেশ্যে বাসে উঠে। বাসও চলতে থাকে তার আপন গতিতে। শাহিনের পাশের সিটে বসা মাঝবয়সী লোকটি ওকে জিজ্ঞেস করে

: কোথায় যাবে বাবু?

: কুমিল্লা। আপনি?

: আমি ফেনি নামব। বাড়িতে তোমার কে কে আছে?

: মা আর ছোট দু'টি ভাইবোন।

: তোমার বাবা নেই বুঝি? শাহিন কিছু না বলে চুপ করে থাকে।

: আমিকি তোমার মন খাড়াপ করে দিলাম?

: না, ঠিক আছে।

সারাদিনের ক্লান্তি এসে ভীড় করে শাহিনের চোখের পাতায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই হারিয়ে যায় ঘুমের দেশে। সেখানে ডানা মেলে উড়তে থাকে প্রজাপতি হয়ে। হঠাৎ যেন আকাশটা তার মাথায় ভেঙে পড়ল। শাহিন অনেক কষ্টে চোখ মেলে তাকায়। শাহিন দেখতে পায় বাসের ভেতরকার লোকগুলো বাঁচার জন্য কেমন প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।তাদের বাঁচাও বাঁচাও আত্মচিৎকারে ভারী হয়ে উঠে প্রকৃতি। শাহিন বুঝতে পারল তাদের বাসটি খাদে পড়েছে। ওর পাঁ টা মনে হয় ভেঙেই গেছে। মাথাও যেন কেমন করছে। সে আর কিছুই ভাবতে পারে না। চোখ দু'টি বন্ধ হয়ে আসে। ১২ ঘন্টা পর শাহিনের জ্ঞান ফিরে, চোখ খুলে সে নিজেকে আবিষ্কার করে হাসপাতালের একটি বেডে। দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। শাহিনের চোখের পাতায় মায়ের মুখটি ভেসে উঠে। মনে পড়ে ভাই-বোনের কথা। মনে পড়ে তাদের জন্য কেনা ঈদ শপিংয়ের কথা। শাহিনের বুকের ভেতর শুরু হয় প্রলয়ঙ্কারি ঘুর্ণিঝর সিডর। দু'চোখ হতে গড়িয়ে পড়ে তপ্ত বারি। শাহিনের এখন শুধু একটাই কষ্ট কিভাবে কেটেছে তার অসহায় মা,ভাই-বোনদের ঈদের দিনটি? কেউ কি দাঁড়িয়েছিল সেই গরীবগুলোর পাশে? চোখের নোনাজলে ভেসে যায় শাহিনের ঈদের আনন্দ। গহীনে উচ্চারিত হয় একটা শব্দ গরীবেরও আবার ঈদ!

আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর/ওএস


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ