শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৫ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিরোনাম :
শিক্ষক ও বাবুর্চি নিয়োগ দেবে রাজধানীর আল্লামা শামসুল হক রহ.মাদরাসা উপজেলা নির্বাচনে যাচ্ছে কি ইসলামি দলগুলো? পাঠ্যপুস্তকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে স্মার্ট জেনারেশন সৃষ্টি সম্ভব নয়: শিক্ষামন্ত্রী বিচ্ছিন্নভাবে দে‌শের স্বার্থ অর্জন করার সুযোগ নেই : সেনা প্রধান স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন সংসদে পাশ করব : স্বাস্থ্যমন্ত্রী যাত্রাবাড়ীতে দুই বাসের মাঝে পড়ে ট্রাফিক কনস্টেবল আহত আ.লীগের মন্ত্রী-এমপির আত্মীয়দের উপজেলা নির্বাচনে নিষেধাজ্ঞা; অমান্য করলে ব্যবস্থা ফকিহুল মিল্লাত রহ. এর পরামর্শ -‘ফারেগিন কার সঙ্গে পরামর্শ করবে’ ঢাকায় চালু হলো চীনা ভিসা সেন্টার ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য পদ দেওয়া নিয়ে ভোট শুক্রবার

আমার জলশৈশব ।২য় পর্ব। জল ও জালের কাব্য

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

salahuddin

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর : চকে মাছ ধরতে ঝাকি জালের ব্যবহার করতো কেউ কেউ। তবে চকের মধ্যে ঝাকি জাল ততোটা সুবিধার জিনিস না। ঝাকি জাল দিয়ে মাছ মারতে হয় পুকুরে কিংবা নদীতে। তাছাড়া খালের মুখেও জায়গা সাফ করে ঝাকি জাল ব্যবহার করা হয়। চকে বা বিলে তো বর্ষা মৌসুমে প্রচুর আগাছা জন্মে। আবার পানি আসার আগে চকে যে ধান বা পাট থাকে, সেগুলো কেটে ফেলার পরও ফসলের গোড়াগুলো কিন্তু ক্ষেতেই রয়ে যায়। সেগুলোতে জালে গেঁথে গেলে দু’দিনেই জাল ছিঁড়ে ফেঁড়ে একাকার হয়ে যাবে। নিড়ানি বা নুচি দেয়া ধানক্ষেতের মাটিও সমান থাকে না, মাটি সমান না থাকলে ঝাকি জাল দিয়ে মাছ ধরা অসম্ভব। জালের নিচ দিয়ে মাছ ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে যাবে। এ কারণে যারা খালের মুখে ঝাকি জাল ব্যবহার করতো, তারা আগে যেটুকু জায়গায় জাল ফেলবে সেটুকু জায়গা নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধ অনুযায়ী আগে থেকেই সাফ করে মাটি সমান করে নিতো। পানি বেশি হলে ‘দাড়িলা কাস্তে’ (যেগুলো দিয়ে ধান-পাট কাটা হয়) নিয়ে ডুব দিয়ে নিচের আগাছা পরিস্কার করতো।

ঝাকি জালের বুনন সাধারণত কৃষকদের বাড়িতেই হতো। যাদের মাছ মারার বাতিক থাকতো তারা নিজেরাই জাল বুনতো বাড়িতে। ঝাকি জাল বুননের দৃশ্যটি বড় আর্টিফিশিয়াল। ঝাকি জাল সাধারণত হাট থেকে কিনে আনতে হতো না, ঘরের বারান্দায় বসে বসে অভিজ্ঞ বয়স্করা কট সুতা আর বাঁশ দিয়ে বানানো ‘চটা’ ও ‘তফিল’ দিয়ে নিজেরাই বানিয়ে নিতো। একটা জাল বানাতে দিন সাতেকের কারবার। তবে আমার নানা নাকি তিন দিনেই বানাতে পারতেন ওমন দশাসই একেকটা ঝাকি জাল।

ওই বয়সে দেখতাম, মাছের মৌসুম শুরু হওয়ার আগে আগে সকাল হলেই দাদা-দাদী বা বাবা-চাচারা বারান্দায় জলচৌকি পেতে বসে যেতেন। একটানা কাজ চলতো নাস্তার সময় পর্যন্ত। সপ্তাহ-দু’ সপ্তাহ শেষে যখন জাল বুনন শেষ হতো তখন চলতো দ্বিতীয় পর্বের কাজ। ঝাকি জালের নিচের অংশে যেখানে জাল ফেললে মাছ ধরা পড়ে, ওই অংশটাকে বলে ‘কুশ’। ওই কুশের নিচে লোহার ছোট ছোট কাঠি ব্যবহার করা হয়। যাতে জাল ফেললে জালটা তাড়াতাড়ি পানির নিচে চলে যায় এবং মাছেরা জালের বেড়ের মধ্যে আটকা পড়ে। এরপর যখন জাল টানা হয় তখন মাছগুলো ওই কুশের মধ্যে আটকে যায়।

নির্দিষ্ট দূরত্বে কুশের নিচ দিয়ে লোহার কাঠি ঝুলানোর পর জালটাকে গাবের রসে বেশ কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখতে হয়। গাবের রসও আরেক ধুন্ধুমার জিনিস। গাব বলতে দেশি গাব, বিলেতি গাব নয়। দেশি গাব পাকলে খেতেও অনেক সুস্বাদ। তবে কাঁচা গাবের ধারে কাছেও যাওয়া যাবে না। ওগুলোর কষ যদি একবার কাপড়ে লাগে তাহলে আর রক্ষে নেই, জনমকার দাগ লেগে যাবে।mas dhora

জালে দেয়ার জন্য কাঁচা গাব গাছ পেড়ে সেগুলো ঢেঁকিতে ছেঁচতে হয়। ছেঁচার পর গাবের রসালো গুড়ো বড় গামলা বা পাতিলে পানি দিয়ে বেশ করে ঘোটা হয়। ঘুটলে গাবের বর্জ্যগুলো কালো এবং আঠালো হয়ে যায়। সেই আঠালো পানিতেই সাদা কট সুতায় তৈরি ঝাকি জাল ভিজিয়ে রাখতে হয় দিন-দু’দিন। এরপর যখন জালটা উঠানো হয় তখন সেটা কালো মিশমিশে হয়ে যায়। এরপর জালটাকে একদিন রোদে শুকালে জালের গড়নটাও হয়ে যায় কড়কড়ে মজবুত। মৌসুমে দু’-তিনবার এভাবে জালে গাব দিতে হয়। নইলে জালের বান ঢিলে হয়ে জাল ছিঁড়ে যায়।

চিংড়ি, তিতাপুঁটি, চান্দা, বাইলা বা এই ধরনের রূপবতী মাছের জন্য ব্যবহার করতাম ‘উঁচি’। বাঁশের চিকন চিকন শলা দিয়ে বানানো এই বিশেষ ধরনের মৎস্যবিহারী জিনিসটা চমৎকার কাজ দেখাতে পারতো। উঁচির কয়েকটা প্রকার আছে। এক ধরনের উঁচি আছে যেগুলো হাত দিয়ে টেনে মাছ ধরতে হয়। আবার কিছু উঁচি আছে যেগুলো হাত দিয়ে ধরাধরির কারবার নেই, খালের মুখে বা যেখানে স্রোত থাকে সেখানে বাঁশের কঞ্চি গেড়ে বসিয়ে দিলেই হলো, ছোট মাছেরা নির্বিঘ্নে এগুলোর ভেতরে চলে যায়। এগুলোর আকার কোনোটা গোল আবার কোনোটা লম্বা, লম্বায় হাত দেড়-দুই, প্রস্থে হাতখানেক।

এগুলোকে ‘চাঁই’-ও বলা হয়। এগুলোর এক বা একাধিক মুখ থাকে, যেটা দিয়ে ছোট ছোট মাছ যেমন- চিংড়ি, তিতাপুঁটি, চান্দা, খলসে, পুটি, কাঁচকি, মলা, ঢেলা অনায়েসে চাঁইয়ের ভেতরে চলে যেতো। সাধারণত খাল বা বিলের যেখানে স্রোত বয়, এমন স্থানে পাতা হয় চাঁইগুলো। স্রোতের টানে চাঁইয়ের ভেতরে গেলে আর রক্ষে নেই, ওগুলোর মুখগুলো এমনভাবে বানানো হয়েছে- ভেতরে যাওয়া যাবে কিন্তু বেরুনো না-মুমকিন। সকালে চাঁই পেতে রেখে দুপুর দুপুরে তুলে আনলে দুপুর আর রাতের তরকারি হয়ে যেতো বেগুন বা আনাজ দিয়ে।

বাড়ির কাছে একটা খাল ছিলো। বর্ষা মৌসুমে সেখানে আমাদের গোসল ও মাছ ধরা দুই-ই চলতো ওখানে। আমার শৈশবের অনেক স্মৃতি জমা পড়ে আছে ওই খালের সঙ্গে। এখনও যখন মাজা খালটা দেখি, বুকের কোথাও উড়ুউড়ু করে ডাক দেয় । মনে হয় বড় করে শ্বাস নিলে এখনও পাবো সেই টাটকা মাছের ঘ্রাণ, পঁচা পাটের আঁশের গন্ধ, রোদে শুকিয়ে দেয়া পাটখড়ির বাস্ ।

বারোটায় ছিলো স্কুল, স্কুলে যাওয়ার আগে একবার; আবার চারটা-পাঁচটায় স্কুল থেকে ফিরে আরেকবার হাজিরা দিতাম খালে। সবসময় মচ্ছব লেগেই থাকতো খালের দুই পাড়ে। নানা ধরনের জাল, বড়শি, ট্যাঁটা, গাঁইতি, পলো নিয়ে টহল দিয়ে বেড়াতো মাছুরেরা। যখনই শুনতে পেতো কোথাও মাছের দেখা পাওয়া গেছে, দল বেঁধে সেদিকেই দে ছুট!

বড়শি দিয়ে মাছ শিকারের আরেকটি আধার উপকরণ ছিলো মৌমাছির চাক। মৌমাছির চাকে যে গুটি মৌমাছির বাচ্চা থাকতো, এখনও যেগুলোর পাখা গজায়নি, উড়তে পারে না- সেগুলো দিয়েও চমৎকার কাজ হতো। তবে ওগুলো পাওয়াটা অনেক দুঃসাধ্য কাজ। একে তো মৌমাছির চাক যেখানে সেখানে পাওয়া যেতো না, আবার পাওয়া গেলেও মৌমাছির চাক ভাঙার মতো দুঃসাহসী বান্দা আমাদের মধ্যে খুব কমই ছিলো।

‘ক্যাকলা’ মাছ চিনেন? চিকন লম্বা ধরনের মাছ। গায়ের রঙ একেবারে স্ফটিক সাদা। লম্বা তী মুখ, মুখের মধ্যে ছোট ছোট দাঁত। ওরা ঝাঁক বেঁধে সাঁতরালে দেখার মতো একটা প্যারেড হতো। এ মাছগুলোর অপরাধ ছিলো, ওরা পানির তল দিয়ে সাঁতরাতে পারতো না। সাঁতার কাটতে হতো পানির উপরিংশে। ফলে সহজেই তাদের দেখতে পাওয়া যেতো। তাদের আরেকটা গুরুতর অপরাধ ছিলো, ঝাঁক ছাড়া তারা চলাফেরা করতো না। শিকারীরা খালের উপর ঝিম মেরে ট্যাঁটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। ক্যাকলার ঝাঁক আসতে দেখলেই স্যাঁত করে ছুঁড়ে দিতো ছুঁচালো ট্যাঁটা। ভাগ্য ভালো থাকলে এক ট্যাঁটাতেই দু-তিনটে উঠে আসতো। রাতের বেগুন-সালুনের আয়োজনটা ও দিয়েই বেশ হয়ে যেতো। দারুণ স্বাদু মাছ।

কখনো বড়শি দিয়েও মাছ ধরা হতো। বড়শির আধার কী ছিলো, জানেন? কেঁচো। বড়শির আধার যোগাড়ের জন্য মাছশিকারের ঘণ্টাখানেক আগে থেকেই কেঁচো সংগ্রহ চলতো। মাটি খুঁড়লেই কেঁচো পাওয়া যায় না, কেঁচো পাওয়া যাবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেতে। সেখানে নিড়ানি কাঁচি বা কোদাল নিয়ে মাটি খুঁড়ে সংগ্রহ করতে হবে কেঁচো। তারপর সেগুলো কচুপাতায় করে নিয়ে যেতে হবে খালের ধারে বা যেখানে মাছ ধরার জন্য বড়শিয়ালরা মচ্ছব করে রেখেছে।borshi

বড়শি দিয়ে মাছ শিকারের আরেকটি আধার উপকরণ ছিলো মৌমাছির চাক। মৌমাছির চাকে যে গুটি মৌমাছির বাচ্চা থাকতো, এখনও যেগুলোর পাখা গজায়নি, উড়তে পারে না- সেগুলো দিয়েও চমৎকার কাজ হতো। তবে ওগুলো পাওয়াটা অনেক দুঃসাধ্য কাজ। একে তো মৌমাছির চাক যেখানে সেখানে পাওয়া যেতো না, আবার পাওয়া গেলেও মৌমাছির চাক ভাঙার মতো দুঃসাহসী বান্দা আমাদের মধ্যে খুব কমই ছিলো। তবে শুনতাম, অনেকে নাকি মন্ত্র পড়ে মৌমাছির চাক কাটতে যায়। মন্ত্র পড়ে গেলে তখন আর তাকে মৌমাছিরা আক্রমণ করতে পারে না। মাছ মারতেও নাকি অনেকে মন্ত্র শানাতো। যে মন্ত্র জানতো, তার বড়শিতে টপাটপ মাছ ধরতো। অথচ তার পাশের জনের বড়শির টোন-এ মাছের ঠোকর দেয়ার নাম নেই।

কখনো চ্যাঁপা শুঁটকি বড়শিতে গেঁথেও মাছ ধরা হতো। চ্যাঁপা শুঁটকির ঘ্রাণ আবার মাছেদের বড় প্রিয় ফুড পারফিউম। এর গন্ধ পেলে হুড়মুড়িয়ে আসে তারা বড়শির আধারের কাছে। তবে ব্যয়বহুল বলে আমাদের ভরসা ছিলো ওই খয়েরি রঙের স্যাঁতস্যাঁতে কেঁচোই। কাজ একেবারে মন্দ হতো না। দু-চারটে কৈ-জিয়ল বা টাকি পেলেই আমাদের মিশন সাকসেসফুল বলে স্বীকার করে নিতাম।

নাক সিঁটকানোর কিছু নেই মশাই, কেঁচো ছেনেছুনে মাছ ধরা শেষ হলে আমরা এ্যান্টিসেপটিক সোপ হিসেবে ব্যবহার করতাম হেঁচি শাঁক। শুদ্ধ বাংলায় মনে হয় এটাকে হেলেঞ্চা শাঁক বলা হয়। এ শাঁকের এমনই গুণাগুণ- হাতে পানি নিয়ে এ শাঁক দিয়ে কয়েকটা ঘষা দিলেই হাত ভরে যেতো সবুজ ফেনায়। ব্যাস, ফেনা তুলে আচ্ছামতো হাত ঘষে ঘষে পরিস্কার করে একদম সাফ-সুতরো হয়ে যেতাম। বাধ্য ছেলের মতো পরিপাটি হয়ে বাঁশের খালই করে কৈ-খলসে নিয়ে ফিরতাম ঘরে।

আগামী পর্বে পড়ুন : জল থৈ থৈ রোদেলা দিন

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন : জলজ ছেলে

আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম /আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ