শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


আক্রান্ত ইস্তাম্বুল ও রসুনের একমুখিতা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

turkey-airport-attackকাজী আবুল কালাম সিদ্দীক : উসমানি খেলাফতের পতনের পূর্বে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ছিল খেলাফতের অধীনে। তাদের ইতিহাস ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধ। এ সময়েই ইউরোপের বিশাল একটি অংশ মুসলিম শাসনের অধীনে আসে এবং পৃথিবীজুড়ে ইসলাম একটি অপরাজেয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। কিন্তু মুসলিম শাসকদের ইসলামবিমুখতা, স্বেচ্চাচারিতা এবং নানামুখী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই উসমানি খেলাফতের পতন ঘটে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লিথুনিয়া থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত ৩০টি পয়েন্টে সমগ্র দুনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে উসমানী সেনাবাহিনী অসম বীরত্ব প্রদর্শনের পরেও হেরে যায়। পরবর্তীতে মাত্র ৩ বছরের বাবধানে তুরস্কের আলেমদের নেতৃত্বে বর্তমান তুরস্ক স্বাধীনতা লাভ করে। এর পর ইউরোপিয়ান দেশগুলো খেলাফতের ব্যাপারে আপত্তি করতে থাকে এবং তাদের দাবির মুখে ১ নভেম্বর ১৯২২ সালে তৎকালীন সুলতান; সুলতান ওয়াহিদুদ্দীনকে তুরস্ক থেকে নির্বাসিত করা হয়। অবশেষে লোজান চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপিয়ান দেশগুলোর আপত্তির মুখে ২৯ অক্টোবর প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে এবং ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম মুসলিমগণ নেতৃত্ববিহীন হয়ে পড়ে।

সমস্যা-সংকুল মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ় হয়ে উঠছিল। একসময়কার মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী তুরস্ক বর্তমানে ফের নেতৃত্বের ভূমিকায় উঠে আসছে- এ বিষয়টা ভালো চোখে দেখেনি অন্যরা। যার খেসারত দিতে হয়েছে সম্প্রতি ইস্তাম্বুল বিমান বন্দরে। আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং এর পরপর গুলি বর্ষণে প্রাণ হারায় কমপক্ষে ৪১ ব্যক্তি। আহত হয় প্রায় ২৫০ জন।

ইরাক, সিরিয়া-সহ মধ্য এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ এখন যুদ্ধক্ষেত্র। এই দেশগুলোকে বাদ দিলে গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি নাশকতা আর জঙ্গি হামলার শিকার তুরস্ক। অবিরাম জ্বলছে মসজিদ, মাদরাসা, হাসপাতাল। ২০১৫-র জুলাই থেকে ২০১৬-র জুন পর্যন্ত ৯ বার জঙ্গি হামলায় কেঁপে উঠল দেশটি। মৃত্যু হল অন্তত ২৬০ জনের। আহত এবং ক্ষতিগ্রস্ত সহশ্রাধিক। তুরস্কের এ হামলায় বেসামরিক মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে কোনো সংগঠন মাঠে নেই। মিছিল নেই। প্রতিবাদ নেই। সংবাদপত্রে কিছু ছবি ও সংবাদ এরপর নীরব।

তুরস্কের মতো প্রায় প্রতিদিনই মধ্যপ্রাচ্যের কোথাও না কোথাও সন্ত্রাসী, আত্মঘাতী হামলায় অসংখ্য মানুষ হতাহত হচ্ছে। আলেপ্পো, দামেশক, বাগদাদ, বৈরুত, কাবুল, আঙ্কারা, লাহোর, করাচির রাস্তা, রেস্তোরাঁ অথবা মসজিদে গ্রেনেড, গাড়িবোমায় ছিন্নভিন্ন লাশের স্তূপে সয়লাব হওয়ার ঘটনাগুলোতে পশ্চিমাদের তেমন বিচলিত-বিগলিত হতে দেখা না গেলেও প্যারিস-ব্রাসেলসের ঘটনায় শতগুণ বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। পশ্চিমা সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহী ও দুষ্কৃতিকারীদের আক্রমণে সিরিয়ায়, ইরাকে, আফগানিস্তানে, ইয়েমেনে যখন বছরের পর বছর ধরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লাখ লাখ সাধারণ মানুষের মৃত্যুতে মধ্যপ্রাচ্যের হতভাগ্য মুসলমানদের প্রতি পশ্চিমা নাগরিক সমাজের মধ্যে এক ধরনের সিমপ্যাথি তৈরি হতে শুরু করে, ঠিক তখনই একটি নতুন আত্মঘাতী হামলার নাটক সাজিয়ে সেই সমবেদনাকে পুনরায় ঘৃণায় রূপান্তরিত করা হয়।

২০১৫-র জুলাই থেকে ২০১৬-র জুন পর্যন্ত ৯ বার জঙ্গি হামলায় কেঁপে উঠল দেশটি। মৃত্যু হল অন্তত ২৬০ জনের। আহত এবং ক্ষতিগ্রস্ত সহশ্রাধিক। তুরস্কের এ হামলায় বেসামরিক মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে কোনো সংগঠন মাঠে নেই। মিছিল নেই। প্রতিবাদ নেই। সংবাদপত্রে কিছু ছবি ও সংবাদ এরপর নীরব।

গত বছরের শেষ দিকে ১৩ নভেম্বর রাতে কোনো প্রকার যুদ্ধ হাঙ্গামা ছাড়াই প্যারিসে ফুটবল খেলার আসর থেকে শুরু করে কনসার্ট, রেস্তোরাঁয় হামলায় ১৬০ টি প্রাণ ঝড়ে গেল। তারপর? রসুনের একমুখিতার মতো সব দায় ইসলামের ওপর! আইএসের নামে ইসলামের ওপর কলঙ্ক লাগিয়ে দেওয়াটা এখন অতি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ইসলাম কখনো নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা সমর্থন করে না। কারো হাতে নেই খুনের ঠিকাদারি। আইএস নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। তারা কোথা হতে অস্ত্র পাচ্ছে? এটা এক অদ্ভূত রহস্য। এদের কর্মকাণ্ড কি আদৌ ইসলামের কোন পরিচয় বহন করে? নাকি ইসলামের পোশাক পড়ে ইসলামকে মূলৎপাটনের জন্যই এবং মুসলমানদের সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্যে আইএসের সৃষ্টি? এদের শক্তির উৎস কি? এ নিয়েও মাথা ব্যথা নেই বিশ্ব মোড়লদের। পশ্চিমা মিডিয়াগুলো এ নিয়ে বিস্ময়করভাবে নিশ্চুপ। মসজিদে হামলা, গুপ্ত হত্যা, আত্মঘাতী হামলা হলেই ঘণ্টা কয়েক ব্যবধানে আইএসের বিবৃতি প্রকাশ হয়। এ বিবৃতির মারপ্যাঁচও বড় রহস্যময়। এ রহস্যময় কলঙ্কটাও খুব সহজে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইসলামের ওপর আরো স্বাভাবিকভাবে।

আক্রান্ত দেশটি মুসলিম হোক অমুসলিম হোক, বিশ্বমানবতা এতে চুপ থাকতে পারে না। ফ্রান্সের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন বিশ্বের প্রায় সব দেশের রাষ্ট্রনায়কেরা। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েফ এরদোগানও সমবেদনা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন। আর এখন তিনি নিজেই আক্রান্ত হলে বিশ্বনেতারা কি তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন?

রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে তুরস্ক যখন সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল এটাকে সাম্রাজ্যবাদীরা ভাল চোখে দেখেনি। নিকট অতীতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তারা ১৯৮০ সালে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায় সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের পর সকল দলকে নিষিদ্ধ করারা পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ নাজমুদ্দিন এরবাকানসহ আরও অনেক রাজনীতিবিদকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং তাদেরকে জেলে প্রেরণ করে। হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে জেলে পুরে এবং শত শত মানুষকে হত্যা করে। সেনাবাহিনী ডানপন্থী ও বামপন্থী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই সামরিক অভ্যুত্থানের প্রভাব এতটাই প্রকোপ ছিল যে, অনেক ঐতিহাসিক এই জন্য বলে থাকেন, আধুনিক তুরস্কের ২ টি ইতিহাস রয়েছে- ১টি হল ১৯৮০’র আগে আরেকটি ১৯৮০ সালের পরের ইতিহাস।

সামরিক শাসন ৩ বছর পর্যন্ত জারি থাকে। এইভাবে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তুরগুত অজালের নেতৃত্বে মাদারল্যান্ড পার্টি তুরস্ককে শাসন করে। ১৯৯৪ সালে তাঁকে বিষপানে হত্যা করা হয়। ১৯৯৪ সালের স্থানীয় নির্বাচনে রেফাহ পার্টি বিপুল বিজয় অর্জন করে। ১৯৯৭ সালে শুধুমাত্র ফাজিলেত পার্টি ছাড়া অন্য সকল দল মিলে সরকার গঠন করে কিন্তু তাদের দুর্নীতিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠতে শুরু করে। অর্থনীতিতে মারাত্মক ধস নামে এবং মুদ্রাস্ফীতি সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। রাষ্ট্রয়াত্ত্ব ব্যাংকগুলো দেওলিয়া হয়ে পড়ে।

রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে তুরস্ক যখন সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল এটাকে সাম্রাজ্যবাদীরা ভাল চোখে দেখেনি। নিকট অতীতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তারা ১৯৮০ সালে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায় সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের পর সকল দলকে নিষিদ্ধ করারা পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ নাজমুদ্দিন এরবাকানসহ আরও অনেক রাজনীতিবিদকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং তাদেরকে জেলে প্রেরণ করে। হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে জেলে পুরে এবং শত শত মানুষকে হত্যা করে।

অবশেষে ২০০২ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। এই নির্বাচনে রজব তাইয়্যেব এরদোগানের নেতৃত্বে একে পার্টি ৩৪.৩ শতাংশ ভোট পেয়ে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, এর পর ২০০৭ সালে ৩৮.৬ এবং ২০১১ সালের নির্বাচনে ৪৯. ৮ শতাংশ ভোট পান। গত বছর ১ নভেম্বর একেপি প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট এবং ৫৫০ আসনের মধ্যে ৩১৭টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে আবারও তুরস্কের মসনদে এরদোগান। কিন্তু মুসলিম গণতান্ত্রিক কোনো দেশকে কি পাশ্চাত্য কখনো স্থির থাকতে দেবে? তারই জ্বলন্ত উপমা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। উদ্বাস্তু আইলান ভেসে ওঠে লাশ হয়ে সাগরে তাতে কী সে তো মুসলিম! রাশিয়ার সন্ত্রাস, ইরানের সন্ত্রাস ও আইএসের এই বোমা থামানোর কেউ নেই। মুসলিম শাসকরা বোবা। আরব শাসকরা চার বউয়ের চিন্তায়। সাধারণ মুসলিমরা এইসবের খবর রেখে কী করবে সিনেমা নাটক ও হিন্দি ফিল্ম দেখে সময় পার করছে। একদিন সেই বোমা আমার ঘরেই পড়তে পারে সে চিন্তা নেই আমাদের। ইরাক, লিবিয়ার পর সিরিয়া। সিরিয়ার পর? হয়তো এই বর্বররা তুরস্কের মতো নতুন কোনো মুসলিম দেশকে বেছে নেবে নতুন আবিস্কৃত বোমাগুলো পরীক্ষা করার ক্ষেত্র হিসেবে। মুসলিম শিশু ও নারী হবে গিনিপিগ সেই বোমার।

এরই ধারাবাহিকতায় একবার আমেরিকান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি (অইঈ)-এর এক প্রতিনিধি জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ড. বুট্রোস ঘালিকে সোমালিয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। জবাবে ড. ঘালি বলেন- সোমালিয়ায় মার্কিন সৈন্য প্রেরণ এ কারণেই সম্ভব হয়েছিল যে, এ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য একাধারে দীর্ঘ ১০ মাস মিডিয়া ও গণমাধ্যমকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলাম। ড. ঘালি বোঝাতে চেয়েছেন, সোমালিয়ায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ বিশ্ববাসীর সামনে গ্রহণীয় বানানোর জন্য সর্বপ্রথম মিডিয়ার মাধ্যমে সোমালিয়ায় ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের কাহিনী দুনিয়াবাসীর কাছে ভয়াবহ আকার বানিয়ে পেশ করা হয়েছিল। ড. ঘালি বলেন- ‘আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে কেবল এ সংবাদ ও চিত্রই পেশ করতে লাগলাম যে, সোমালিয়ার জনগণ ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও রোগ-শোকে মৃত্যুবরণ করছে। টেলিভিশন ও সংবাদপত্রগুলো ক্ষুধার্ত ও উলঙ্গ সোমালী জনগণের এমন করুণ ও মজলুম চিত্র দুনিয়াবাসীর সামনে পেশ করতে থাকে- যাতে বিশ্ববাসী বুঝে, এই মরুভূমিতে না পানি আছে, না খাবার আছে, না মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে, আর না আছে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেখানকার জনগণ সকল মৌলিক প্রয়োজন থেকে বঞ্চিত। যদি কোথাও থেকে কোনো সাহায্য সহযোগিতা আসে, তাও আবার অসভ্য ও জংলী মানুষগুলো সেগুলো নিয়ে পরস্পরে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। এভাবে অব্যাহত প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে আগ্রাসনের পরিবেশ তৈরি হয়ে গেলে বিশ্ববাসীর বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেল যে, সেখানে বিদেশী হস্তক্ষেপ ছাড়া জনগণকে রক্ষার আর কোন পথ নেই।’

তবে কি আমরা আশঙ্কা করতে পারি, তুরস্কের জন্যও এমন পথ তৈরি করা হচ্ছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ, ইউরোপের রিফিউজি সংকট, সিরিয়ায় মানবতার বোবাকান্না এবং প্যারিস থেকে ব্রাসেলস পর্যন্ত একের পর এক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ইসলামবিদ্বেষীদের হাতে প্রোপাগান্ডার নতুন নতুন অস্ত্র ও রসদ তুলে দিচ্ছে।

এমন তো কথা ছিল না! বর্তমানে পৃথিবীতে মুসলমানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি এবং মুসলমান দেশের সংখ্যা ৬৫-এরও অধিক। পৃথিবীতে মোট তেল ও গ্যাসের ৮০ ভাগ, কয়লার ৬০ ভাগ, স্বর্ণের ৬৫ ভাগ, রাবার ও পাটের ৭৫ ভাগ এবং খেজুরের ১০০ ভাগই মুসলমান দেশের! পৃথিবীর মোট দেশের আয়তনের তিনভাগের একভাগ এখনো মুসলমানদের দেশসমূহ। পৃথিবীর মোট ৩ কোটি সৈন্যের এক কোটিই মুসলমান। অমুসলিম বিশ্বের ৮৭ ভাগ বাণিজ্যই মুসলমানের সাথে। অমুসলিম বিশ্ব তথা লুটেরা কাফিররা মুসলমান বিশ্বের তথা মুসলমানদের সম্পদ হরণ করেই বা নির্ভর করেই বেঁচে আছে। তারপরেও সোমালিয়াসহ অপরাপর মুসলিম বিশ্বের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা পশ্চিমা হানাদার শক্তির আগ্রাসনের শিকার। তাদের সামরিক অস্ত্রের দাপটে নিজেদের সম্পদ তাদের হস্তান্তর করতে বাধ্য হচ্ছে। এখন মুসলমানরা তাদের গোলামী করছে।

ইসলামের বয়স প্রায় সাড়ে ১৪শ বছর। পরিণত এ বয়সে এসে পবিত্র ধর্মটি বিশ্বজুড়ে আজ একটি অদ্ভুত বিরূপ সময় পার করছে। একদিকে পশ্চিমা দুনিযার একাংশ ইসলাম ও সন্ত্রাসবাদকে সমার্থক করে তোলার নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে এই পশ্চিমা বিশ্বেরই আরেকাংশ ইসলামকে একটি সহনীয় গণতান্ত্রিক পরিসরে রেখে এগিয়ে নিতে আগ্রহী। তুরস্ক এদের অন্যতম। এই তুরস্কের দিকেই এখন হায়েনাদের লোলুপ দৃষ্টি।

প্রকৃত মুসলমান কখনো সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেয় না। মুসলমানরা বিশ্ব জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগের অংশীদার। ফুলার ইউরোপোলের পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন যে, ২০০৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ৪৯৮টি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৪২৪টি সংঘটিত হয়েছে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী দ্বারা, ৫৫টি চরম বামপন্থী দল দ্বারা, ১৮টি অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দ্বারা এবং মাত্র একটি ইসলামপন্থীদের দ্বারা। (সূত্র : প্রাগুক্ত)। মুসলমানদের নির্বিচারে সন্ত্রাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পাশ্চাত্যের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার বিপরীতে এটি একটি ক্ষুদ্র চপেটাঘাত বিবেচিত হতে পারে বৈকি। (সূত্র : আ ওযার্ল্ড উইদাউট ইসলাম, ইন্টারন্যাশনাল ম্যাস মার্কেট এডিশন, পৃ ৭৮-৭৯)

গত নয় মাসে ইস্তাম্বুলে ৬টি ও আঙ্কারায় চালানো ৩টি বোমা হামলার মধ্য দিয়ে তুরস্ককে এই বার্তাই দেওয়া হচ্ছে যে, দেশটির কোনো অঞ্চলই সহিংসতা মুক্ত নয়। এ ছাড়া তথাকথিত ইসলামী স্টেটের জঙ্গিরাও সক্রিয় রয়েছে দেশটিতে। পাশ্চাত্যের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কল্যাণে তথ্যের সহজলভ্যতা যেমন সুবিদিত, সমন্বয়ের কাজটাও তেমনি মুশকিল। ইসলাম আর মুসলিমবিষয়ক ওদের সব আলোচনা- হোক সেটা খবর-জরিপ-কলাম বা বক্তৃতা, শেষমেষ গিয়ে সন্ত্রাসবাদে ঠেকে। বিভিন্ন পক্ষ বা সূত্রের দাবিগুলোর মধ্যকার ব্যবধানও এতো বেশি থাকে যে, সত্যটা নির্ণয় করে ওঠা মারাত্মক কঠিন হয়ে পড়ে।istanbul-10

আসলে প্রাচ্য বলেন আর পাশ্চাত্য বলেন, ইউরোপ-আমেরিকা বলেন বা আফ্রিকা-এশিয়া বলেন- সর্বত্রই আম জনতা আজ চরম ইসলামফোবিয়ার শিকার। কোথাও শুভ্র ভোরের এক চিলতে আলোকরেখা প্রতিভাত হলে, একটু সময় না গড়াতেই অন্য প্রান্তের আকাশে উড়ে কালবৈশাখী মেঘমালা। অদূর ইতিহাস এ সাক্ষ্যই আমাদের দেয়। ১৯৭৯ সালের ১৬ এপ্রিল টাইম ম্যাগাজিনে একটা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়ছিল। ওই নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছিল মাত্র দেড় বছরের মধ্যে ৬০ হাজার এরও বেশি বই লেখা হয়েছে ইসলামের বিপক্ষে। টাইম ম্যাগাজিনের এ আর্টিকেল অনুযায়ী আপনি যদি হিসাব করেন তাহলে দেখবেন, প্রত্যেক দিন ইসলামের বিপক্ষে একাধিক বই লেখা হয়েছে। আজকে বিশেষভাবে মুসলমানদের টার্গেট করছে মিডিয়া। যেমন ধরুন, যদি কোনো মুসলমান মহিলা হিজাব পরেন, তাকে টার্গেট করা হবে। একই সাথে গির্জার ধর্মযাজক দেখেন তারাও একই রকম পোশাক পরেন, মুখ আর হাত বাদে পুরো শরীর ঢাকা। মানুষ তাদের শ্রদ্ধা করে কেন? পার্থক্যটা কোথায়? যদি কোনো মুসলমান দাড়ি রাখে, তার মানে হচ্ছে সে একজন সন্ত্রাসী। কিন্তু শিখরাও দাড়ি রাখে, তাতে কোনো সমস্যা নেই। ওরা পাগড়ি পরে, তাতেও সমস্যা নেই। একজন শিখ কোর্টে মামলা করেছেন। তিনি ছিলেন কানাডিয়ান, আর তিনি কেস করছেন কানাডিয়ান আর্মিতে পাগড়ি না খোলার দাবি নিয়ে। পরে তিনি মামলায় জিতেছিলেন। আর এখানে দেখি যদি কোনো মুসলমান দাড়ি রাখেন মানুষ তখন অন্য কিছু ভাবে। দাড়ি কী ক্ষতি করতে পারে! একটা টুপি কী ক্ষতি করতে পারে?

অমুসলিমপ্রধান দেশগুলোর পাশাপাশি আমাদের মুসলিমপ্রধান দেশগুলোও ইসলামফোবিয়ার ক্ষেত্রে কম যান না। এর নেপথ্যে মোটাদাগে যে হেতুটি ধরা পড়ছে, তা হচ্ছেÑ মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে আজ সামাজিক সংহতি ও ঐক্যের বড়ই অভাব। যার কারণে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠিত হতে পারছে না। অথচ কুরআনে আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে সুদৃঢ়হস্তে ধারণ করে কখনো পরস্পর বিচ্ছিন্ন না হওয়ার নির্দেশ এসেছে। বর্তমান মুসলিম বিশ্বের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যায়, রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থাৎ হরতাল, অবরোধ, ধর্মঘট, ভাংচুর, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কা-কারখানা।

কই? মুসলিম কোনো দেশ তো এদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি! অথচ মুসলমানরা ভালো করে জানে যে, ইসলামী শিক্ষা, আদর্শ ও জীবনবোধের দিক থেকে সারা বিশ্ব মুসলিম একই দেহসত্তাতুল্য। দেহের কোনো অংশে কোনো প্রকার কষ্ট অনুভূত হলে যেমন এর অন্যান্য অংশেও তা অনুভূত হয়, সে কষ্ট দূরীকরণার্থে সম্ভাব্য সকল চেষ্টা করা হয়, তেমনই মুসলিম উম্মাহর কোনো অংশে আঘাত অনুভূত হলে অপর মুসলমানেরও দায়িত্ব তা উপসমে এগিয়ে আসা। তুরস্ক ও ইস্তাম্বুলের বিষয়টি ডিঙ্গিয়ে আমরা যদি সামগ্রিকভাবে ব্যাপারটি মূল্যায়ন করি, তাহলে মরক্কো থেকে সুদূর ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত মুসলিম সীমান্ত রক্ষায় কার্যকর কোনো ভূমিকা কি চোখে পড়ছে?

মুসলিম বিশ্বের সংকটের কারণ উদ্ঘাটনে দেখা যায়, একদিকে ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের অভাব, অন্যদিকে পশ্চিমা শাসকদের দয়া-দাক্ষিণ্যের আকাঙ্খা। এ দু’টি ব্যাধিতে আক্রান্ত মুসলিম বিশ্বের শাসকরা। এ রোগে আক্রান্ত মুসলিম শাসকদের দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রে ন্যায় বিচারের বড়ই অভাব। ন্যায় বিচারের অভাবে আজ মুসলমানরা জুলুম ও নির্যাতনের শিকার।

লেখক : আলেম, শিক্ষক ও সাংবাদিক

আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম /আরআর


সম্পর্কিত খবর