পলাশ রহমান; ইতালি থেকে : আমার বাসা থেকে ভেনিসের বাঙালি পাড়া খানিকটা দুরে, প্রায় ৩০ কিলোমিটার। প্রতিদিন ওখানে যাওয়া হয় না। বছরের অন্যান্য সময় সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আড্ডা দিতে গেলেও রমজান মাসে তাও হয় না। কি ভাবে হবে? গ্রীষ্মের সূর্য ডুবতে ডুবতে ন’টা বেঁজে যায়। ওদিকে ভোর তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে সেহেরি শেষ করতে হয়। রমজানের কিছু বাড়তি এবাদত আছে। সব মিলিয়ে সময়ের সাথে পেরে ওঠা যায় না।
গত শনিবারে গিয়েছিলাম বাঙালি পাড়ায়। সেখানে বাংলাদেশিদের নিয়ন্ত্রণে ৩ টি মসজিদ আছে। ইসলামি কালচারাল সেন্টার নামে ভাড়া নেয়া ওই জায়গাগুলো মুসলমানরা মসজিদের মতো ব্যবহার করে। সেখানে নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ হয়, রমজানের তারাবি হয়। প্রতি সন্ধ্যায় মুসল্লিদের ইফতারি করানো হয়। প্রবাসী বাংলাদেশিদের বাসা থেকে, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে হরেক রকম ইফতারি পাঠানো হয়। আমি এক মসজিদে ইফতারি করলাম। সেখানে প্রায় আড়াই’শ মুসল্লিকে দেখলাম একসাথে ইফতারি করতে। এদের মধ্যে বড় একটা অংশ যুবক।
এ দৃশ্য শুধু ভেনিসের নয়, রাজধানী রোমসহ ইতালির বড় বড় প্রায় সব শহরের দৃশ্যই অভিন্ন। প্রতিটা শহরেই বিভিন্ন দেশের অভিবাসী মুসলমানদের কমিউনিটি আছে। তারা ইসলামি কালচারাল সেন্টারের নামে ঘর ভাড়া নিয়ে অথবা কিনে নিয়ে মসজিদের মতো ব্যবহার করে। সেখানেও প্রশাসনের বিভিন্ন বিধি নিষেধ মানতে বাধ্য করা হয়। মাঝেমধ্যে প্রতিবেশিদের তিরস্কারও সহ্য করতে হয়। শত প্রতিকুলতা উপেক্ষা করে অভিবাসী মুসলমানরা নিজেদের ধর্ম কর্ম করেন। রোজার মাসে রোজা রাখেন। সিয়াম সাধনা করেন।
সরকারিভাবে বা সামাজিকভাবে ইতালিতে রোজার মাসকে আলাদা কোনো গুরুত্ব দেয়া না হলেও গত ক’বছর যাবৎ ব্যবসায়ীদের কাছে এর গুরুত্ব বেড়েছে খানিকটা। বড় বড় সুপার মার্কেটে ‘রমজান স্পেশাল’ নামে আলাদা কর্নার করতে দেখা যায়। সেখানে খেজুরসহ আরব দেশের বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী রাখা হয়। গোস্তের দোকানে ‘হালাল’ সার্টিফিকেট টানিয়ে দেয়া হয়। ব্যবসায়ীক কারণে হলেও রমজান মাস এখন ইউরোপীয়দের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সাধারণ ইউরোপীয়ানরা রমজান সম্পর্কে জানতে পারছে। তাদের কাছে ভিন্ন উপায়ে রমজানের খবর পৌঁছাচ্ছে। যা এতদিন অনেকেই জানতো না। রমজান কী, রোজা কী, সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। মিডিয়ার কল্যাণে মুসলমান সম্পর্কে যেটুকু যা ধারণা ছিলো তার পুরাটাই নেতিবাচক।
ইতালিতে ইফতারির বিশেষ কোনো মেনু নেই। বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসন গ্রহণ করা মুসলমানরা নিজ নিজ দেশের খাদ্যাভ্যাস মতো ইফতারি করেন। সাথে স্থানীয় ফল এবং পাস্তা খান অনেকে।
ক্যাথলিক প্রধান দেশ ইতালি। এখানে মুসলামদের কোনো ধর্মীয় উৎসবে ছুটি হয় না। রোজার মাসেও কাজের সময়ে এতটুকু তারতম্য ঘটে না। সবই চলে বছরের অন্যান্য সময়ের মতো স্বাভাবিক নিয়মে। সুতরাং অনেক প্রবাসী কাজ করে এত লম্বা দিনের রোজা রাখতে পারেন না। বিশেষ করে যারা ভারী কাজ করেন তাদের জন্য খুবই কষ্ট। এর মধ্যেও অনেকে রোজা ছাড়েন না। শত কষ্ট হলে রোজা রাখেন। আমার এক বন্ধু আছেন তিনি একটি রেষ্টুরেন্টের পিজার শেফ। যে চুলাটার সামনে দাড়িয়ে তাকে সারাদিন কাজ করতে হয় তার তাপমাত্রা কম করে হলেও সাড়ে তিন’শ। তবু তিনি রোজা রাখেন। সব চেয়ে কষ্ট লাগে সারাদিন রোজা রেখে বেচারা একটু ইফতারিও করতে পারেন না। চুলার সামনে দাঁড়িয়েই এক ঢোক পানি দিয়ে ইফতারি সারেন। কারন যে সময়টা আমাদের ইফতারির সময় ঠিক ওই সময়ই ইতালিয়দের রাতের খাবারের সময় হয়। সবাই ওই সময় হুড়মুড় করে রেষ্টুরেন্টে ঢোকে। সুতরাং ইফতারির সময় থেকে অন্তত দু’ঘন্টা দম ছাড়ার সময় পান না তিনি। এর মধ্যেও চেষ্টা করেন এক চির সময় বের করে রেষ্টুরেন্টের গোডাউনে গিয়ে নামাজ আদায় করে নিতে। একান্তই যদি না পারেন যতো রাতই হোক বাসায় ফিরে কাজাসহ সব নামাজ আদায় করেন।
ইতালিতে অধিকাংশ কাজের মালিকরা রোজা রাখা পছন্দ করে না। তাদের অপছন্দের কারণ একটাই- রোজা রাখলে শ্রমিক দূর্বল হয়ে পড়বে, কাজের ব্যঘাত ঘটবে। অনেকে খুব অবাক হয়, বিশ্বাসই করতে চায় না, একজন মানুষ সারা দিন না খেয়ে থাকে। এক ঢোক পানিও না, এ যেনো তাদের বিশ্বাসই হয় না। আমার এক কলিগ একদিন আমাকে বলেছিল, তুমি তো এখন বাংলাদেশে থাকো না, এখন রোজা করার দরকার কী? এখানে তো কেউ তোমাকে বাধ্য করবে না। আমি কোনোভাবেই তাকে বোঝাতে পারিনি, রোজা এমন এক ইবাদত যা কেউ কাউকে বাধ্য করতে পারে না। এটা বাধ্য করা বা না করার বিষয় না। রোজা একান্তই গোপন ইবাদত।
গ্রীষ্মের ইউরোপে দিনের দৈর্ঘ গড়ে ১৯/২০ ঘন্টা। সাথে প্রচ- গরম। দিনের তাপমাত্রা প্রায়ই ৩০ ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে প্রবাসীদের কাজও করতে হয়। কাইক পরিশ্রমের কাজ। অনেকে ১০/১২ ঘন্টা কাজ করেন। ইউরোপের কাজ তো কাজই, নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে বসে থাকার, জিরিয়ে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। কাজের সময় কাজ করতেই হয়, কেউ কাউকে ছাড় দেয় না। সস্তা দয়া দেখায় না। রোজা রেখে এমন কাজ করা কি যে কষ্টের তা নিজে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না। কাউকে বিশ্বাস করানো যাবে না। যা অনেক সময় জীবনের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। চাকরি চলে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে পারে না। তাদের শিক্ষা জীবন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। এমন বৈরী পরিবেশের ইউরোপে ১৯/২০ ঘন্টার রোজা রাখা কি খুব জরুরি? কোনো বিকল্প কি নেই? অভিজ্ঞ ওলামারা কি বিষয়টা নিয়ে একটু ভাববেন? পৃথিবীর ওয়েদার ম্যাপ নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করবেন? যেমন গরমের দিনে এত লম্বা ঘন্টার রোজা না রেখে একটা নির্দিষ্ট সময় পরে ইউরোপের রোজাদাররা ইফতারি করে ফেলবে। নির্দিষ্ট সময়টা ১০/১২ ঘন্টার হতে পারে। সূর্য না ডুবলেও রোজাদাররা সেহেরির পর থেকে হিসাব করে ১০ অথবা ১২ ঘন্টা পরে ইফতারি করে ফেলবে। বিশেষ ক্ষেত্রে এমন কোনো সুযোগ কি ইসলাম রাখেনি? ইজমা কিয়াসের মাধ্যমে কোনো পথ কি বের করা যায় না? যদি না যায় তারা রাতের ইবাদতগুলো কখন করবে? কিভাবে করবে? পৃথিবীতে এমনও দেশ আছে যেখানে গ্রীষ্মের সময় রাতের দৈর্ঘ মাত্র এক থেকে দুই ঘণ্টা অথবা তারও কম। যদি কোনো উপায় নাই থাকে তারা কি করবে? কিভাবে রোজা রাখবে?
আমার এ কথাগুলো কাউকে বিভ্রান্ত করার জন্য না। কোনো বদ মতলবে আমি এসব কথা লিখিনি। বাস্তবতার নিরিখে বিচার বিশ্লেষণের জন্য বিজ্ঞ ওলামা বা ইসলামি এস্কলারদের কাছে একটা প্রশ্ন তুলে ধরা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। ওলামারা যদি বাস্তবতা মাথায় না নিয়ে এসব প্রশ্ন উড়িয়ে দেন, ছুড়ে ফেলে দেন তাতেও বিশেষ কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। যারা রোজা রাখেন, তারা শত কষ্ট হলেও রাখবেন। কিন্তু যারা বাস্তবতার কারণেই রোজা রাখতে পারেন না, অথচ রাখতে চান তাদের কথা ভেবেই আমার এই প্রশ্নের অবতারণা।
ইউরোপে গরমের দিনে সংযম করার চেয়ে বড় কোনো জিহাদ আছে কিনা আমার জানা নেই। গ্রীষ্ম শুরু হওয়ার সাথে সাথে চার দিকে নগ্নতার হাট বসে। নারীদেহ প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এর মধ্যে নিজেকে হেফাজত করা, নিজের দৃষ্টি সংযত রেখে সংযম করা আর আল্লাহর ওলি বনে যাওয়ায় খুব একটা পার্থক্য আছে বলে আমার মনে হয় না।
লেখক : পৌরোডিউচার, রেডিও বেইজ, ইতালি