আব্দুল্লাহ বিন রফিক : আকাশের বুকে সূর্যের অস্তিত্ব যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি জমিনে ওলামায়ে কেরাম। দীন প্রচার, মানুষকে তাকওয়া ও পরিশুদ্ধির জন্য আলেমদের অবদান অনস্বীকার্য । একজন আলেমের বিদায় বিশাল এক শূন্যতা তৈরি করে যায়। অতিতে এমন বেশ কজন আলেমকে হারিয়ে এতিম হয়েছে ধর্মপ্রাণ মানুষ। শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, মাওলানা ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাই, মুফতি ফজলুল হক আমিনী, মুফতি আবদুর রহমানসহ বিশিষ্ট আলেমদের ইন্তেকাল কাদিয়েছে অসংখ্য মানুষকে। বর্তমানে সেই ইন্তেকালের মিছিলে রয়েছেন আরো পাঁচ আলেম। তাদের অবদান নিয়ে আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোরের বিশেষ আয়োজন শুক্রবার স্পেশাল।
শাইখুল হাদীস আল্লামা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী
২০১৫ সালের রমাযানের ১০ তারিখ থেকে সেই যে বিছানায় পড়েছেন আজও তার কোনো উন্নতি হয়নি। অনেকগুলো সমস্যা নিয়ে পুরোপুরি শয্যাশায়ী। ব্রেন স্ট্রোক করার পর থেকে আর কথা বলতে পারেন না। ইবাদাত-গুজারি করতে পারেন না আগের মতো আর। শরিয়তের পক্ষ থেকে ইবাদাতের যে আদেশ ছিলো সামর্থ্য না থাকায় শায়খের উপর সেটা আর নেই। মূত্রথলিতেও আছে যথেষ্ট সমস্যা যা আর ভালো হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ডাক্তার। শায়খের ছাত্র ও ভক্তবৃন্দরা হর-হামেশা খোঁজ-খবর নিচ্ছেন তাঁর। বিশেষত মাওলানা আব্দুল মালেক, আবু তাহের মিসবাহসহ কাছের মানুষরা নিয়মিত খোঁজ রাখছেন শায়খের। অচেনা মানুষের ভালোবাসারও কমতি নেই। এমনটাই জানালেন শায়খের মেঝো ছেলে মাওলানা আবরারুল হক।
মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী’র শিক্ষাজীবনের সূচনা পাহাড়পুর এমদাদুল উলূম মাদরাসায়। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী শেষে ১৯৬৭/৬৮ সালের দিকে লালবাগ মাদরাসায় এসে মিশকাত জামাতে ভর্তি হন। শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. কৃত বুখারির ব্যাখ্যা গ্রন্থের সম্পূর্ণ প্রুফ হজরত পাহাড়পুরী হুজুরই দেখেছেন। দাওরায়ে হাদিস শেষ করার পর জামিআ নূরিয়া আশরাফাবাদ কামরাঙ্গীর চড়ে শিক্ষকতার জীবন শুরু করেন। তারপর জামিআ মুহাম্মাদিয়া শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৯৫ সালে জামিআ রাহমানিয়া আরাবিয়া মুহাম্মাদপুরে শিক্ষকতা আরম্ভ করেন। তারপর লালমাটিয়ার শায়খুল হাদিস হিসেবে এ যাবত কর্মরত আছেন।
চোখে সমস্যা হওয়ার পর থেকে বুখারির আলোচনা, লেকচার বা ব্যাখ্যা হাদিস শুনে শুনেই করতে পারতেন। ছাত্রকাল থেকেই শায়খের স্মৃতিশক্তি প্রখর। তবে শায়খের যে বিষয়টা তার জীবনে মহিমা ও গরিমা এনে দিয়েছে তা হলো, তিনি জীবনে কারও গিবত-শেকায়াত বা পরনিন্দা করেননি। এটি এমন অনন্য এক বৈশিষ্ট যা বর্তমান দুনিয়ায় বলতে গেলে ‘আনকা পাখি’র মতো দূর্লভ। হাজারো লক্ষ সাধু মানুষ চষে বেড়ালেও এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এই বৈশিষ্ট হাজারো আমলের বিপরীতে একাই একশো’র ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এই বৈশিষ্টই শায়খকে সবার থেকে আলাদা করে এক অপার মহিমায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
তিনি যখন অল্প-অল্প কথা বলতে পারতেন তখনও যে উপদেশ খুব দিয়ে গুরুত্ব বলতেন, লোকেরা যে যে পেশায় থাকুক নামাজের যেনো খুব ইহতিমাম করে। কিছুতেই যেনো লোকেরা নামাজ না ছাড়ে। সব সময় নামাজ নামাজ শব্দগুলো বলে নামাজ না ছাড়ার উপদেশ দিতেন। পাশাপাশি মানুষের হকুক তথা প্রাপ্য অধিকার যেনো পুরোপুরি আদায় করে সবাই। যেমন চার আনা, আট আনা খুঁজে খুঁজে আদায় করতে হবেÑ এই বিষয়গুলো খুবই গুরুত্ব দিয়ে বলতেন।
শায়খ ও তাঁর পরিবারের ইচ্ছে হলো, হজরত হাফেজ্জ্বী হুজুর রহ. কুরআন প্রচারের যে মিশন ও খেদমত বাংলাদেশে করে গেছেন তা যেনো পূর্ণতা পায়। হজরত পাহাড়পুরীও সারা জীবন সে চেষ্টাটাই করেছেন।
[মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ]
চার বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছেন এই আলেমে দীন। ইসলামি রাজনীতির অঙ্গনে শক্তিশালী বলয় তৈরি করার জন্য জীবনভর সংগ্রাম করেছেন তিনি। বাবার হাত ধরে রাজনৈতিক যে দর্শন করেছিলেন কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর সে পথেই হেঁটেছেন সারাটা জীবন। ব্্েরন স্ট্রোক করার পর থেকে কথা বলা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া মূত্রণালির সমস্যায়ও ভুগছেন তিনি। হাঁটুর ব্যথাও কোনো অংশে কম নয়। পা একদমই সোজা করতে পারেন না।
বছর চারেক হলো হাঁটা-চলা বন্ধ। সঙ্গে বেদনাময় ডায়াবেটিস রোগেও আক্রান্ত তিনি। সমস্যা সঙ্কুল জীবন নিয়েই বিছানায় পড়ে আছেন এই মহান রাজনীতিবিদ আলেম। এখন তিনি আর ইবাদাত-আরাধনায় মুকাল্লাফ তথা শরিয়তের বিধি-নিষেধে আদেশপ্রাপ্ত অবস্থায় নেই। খুব ঘনিষ্ঠ না হলে তিনি আর কাউকে চিনতে পারছেন না। ঘনিষ্ঠজনদেরও অনেক সময় ঠাওর করতে পারেন না। সেবায় কোনো ত্রুটি করছেন না পরিবার ও ভক্ত-অনুরক্তরা। তিন তিনজন খাদেম সবসময় হজরতের পাশে থাকছেন। অসুস্থ হওয়ার পরও মাদরাসার প্রতি তার টান ও আবেগ ছিলো দেখার মতো। একটু শক্তি পেলেই মাদরাসায় বারবার আসতে চাইতেন। মাদরাসা ও দীনি প্রতিষ্ঠানকে মনে-প্রাণে ভালোবাসতেন। যে শিক্ষা পিতার কাছ থেকে পেয়েছিলেন তা জীবনের পরতে পরতে লালন করেছেন। স্বপ্নের মতো সে বীজ বুনেছেন জীবন ও সংসারের মসৃণ ভূবৃত্তে। এভাবে তিনি জীবনের শেষ বেলাভূমিতে এসে উপনিত হয়েছেন।
কমবেশি সবাই খোঁজ-খবর নিচ্ছেন তাঁর। তবে তাঁকে যেভাবে মূল্যায়ন করার দরকার ছিলো সেভাবে তিনি মূল্যায়িত হননি। কথা হয়েছিলো তাঁর অন্যতম সুযোগ্য সাহেবজাদা জামিয়া নূরিয়া মাদ্রাসার জামে মসজিদের সম্মানিত ইমাম ও খতিব মাওলানা নাজিবুল্লাহর সাথে। ফোনে এমনটাই বলছিলেন তিনি। হজরত হাফেজ্জী হুযুর রহ. এর আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক যে কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে পরবর্তী বংশ পরম্পরা সেই কাজ পূর্ণ করবে- এটাই জাতির কাছে তাঁর শেষ প্রত্যাশা।
[কারী মাওলানা বেলায়াত]
বাংলাদেশ আল-কুরআন মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছুক এমন শ্লোগান নিয়ে যারা প্লাটফর্মে কাজ করে সফল হয়েছেন তাদের নাম নিতেই প্রথমে আসে মাওলানা বেলায়াত সাহেব। প্রিয় এই মানুষটি সাড়ে তিন বছর যাবত বিছানায় শোয়া। বয়স ১১০ ছুইছুই। বলাবলির চেষ্টা করলেও বলতে পারেন না খুব বেশি। মাঝে-মধ্যে দু-এক শব্দ করে বলেন। আর যাও বলেন তার কিছুই বুঝে আসে না। স্মৃতি এতটাই দূর্বল হয়ে পড়েছে, মুহূর্তেই সব ভুলে যান। কেউ কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলে বলেন, আল-হামদুলিল্লাহ। আর মুখে সবসময় জিকির করতে থাকেন। হজরতের সারা জীবনের এক অনবদ্য বৈশিষ্ট ছিলো, তিনি রাত দু’টোর পর আর বিছানায় থাকতেন না। ঘুম থেকে উঠে সোজা তাহাজ্জুদের সালাতে দাঁড়িয়ে যেতেন। রাতে তাহাজ্জুদ আর দিনে কুরআনের খেদমত তাঁর জীবনের বৃত্তে নির্মাণ করেছে এক অমর ও বৈচিত্রময় প্রাসাদের। যা ইতিহাসের পাতায় হাজার বছর ধরে মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাবে।
কুরআনের খেদমতের বদৌলতে মানুষের হৃদয়ে তাঁর প্রতি ভালোবাসা জিইয়ে থাকবে চিরকাল। সকলেই তার খুব খোঁজ-খবর রাখছেন। দেশের মাটিতে তার অবদান যে মূল্যায়িত হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কথা হয়েছিলো তার চতুর্থ পুত্রসন্তান জনাব মাওলানা ফয়যুল্লাহর সাথে। এমনটাই জানিয়েছেন তিনি।
[মাওলানা মুহিউদ্দিন খান]
বর্ণাঢ্য বৈচিত্রময় গুণী এই মানুষটির কথা কে না জানেন। তার অবদান সম্পর্কেও কমবেশি সবার জানা। তাফসিরে মাআরিফুল কুরআনের অনুবাদ লিখে সবার মাঝে বেশ বড়সড় জায়গা করে নিয়েছেন। রাজনীতি ও লেখালেখির প্লাটফর্মে সমান তালে হেঁটেছেন জীবন-বিপ্লবের বাঁকে বাঁকে।
লেখনি ও সম্পাদনার কাজে তিনি এগিয়ে গিয়েছেন বহুবিস্তৃত দূর সীমানায়। এখনো সম্পাদনা করে চলেছেন মাসিক মদীনা। সম্পাদিত, অনূদিত ও সংকলিত বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। সংকলিত যেমন : রওযা শরীফের ইতিকথা, দরবারে আউলিয়া, হায়াতে মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী ও দেওবন্দ আন্দোলন, কুড়ানো মানিক [১-৪ খন্ড], কোরআন পরিচিতি, আধুনিক বাংলা-আরবি এবং আধুনিক আরবি-বাংলা অভিধান আল-কাউছার, অনূদিত যেমন : মাওলানা ফযলে হক খয়রাবাদী কৃত আযাদী আন্দোলন, শহীদ হাসানুল বান্নার রচনাবলী, ইমাম গাজালীর [৪৫০-৫০৫ হি.] জগত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইয়াহইয়াউ ঊলুমিদ্দীন [১-৫ খ-], উপমহাদেশের প্রথম মুহাদ্দিস শায়খ শারফুদ্দিন আবূ তাওয়ামার ছাত্র শায়খ ইয়াহইয়া মুনায়েরী কৃত মারেফাত জ্ঞানের রত্ন ভাণ্ডার, জালালুদ্দীন সুয়ূতী [৮৪৯-৯১১হি.] কৃত বিখ্যাত সীরাত গ্রন্থ খাসায়েসুল কুবরা, মুফতী ইয়ার মুহাম্মদুল্লাহ খান কৃত দালায়েলুস সুলূকের অনুবাদ ইসলামী তাছাউফের স্বরূপসহ আরও অনেক গ্রন্থের কাজ তিনি সফলভাবে সম্পাদনা করেছেন।
ষাটের দশক থেকে তিনি বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন। প্রথমে তিনি মাওলানা আতহার আলী রহ. প্রতিষ্ঠিত নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় দায়িত্বে সমাসীন ছিলেন। পরবর্তীতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাথে ইসলামী শাসনতন্ত্রের জোরদার আন্দোলন চালিয়ে জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫/২৬ ডিসেম্বর ঢাকার পটুয়াটুলী জামে মসজিদের দ্বিতীয় তলায় জমিয়তের কাউন্সিলে তিনি জমিয়তের মহাসচিব নির্বাচিত হন। এই অধিবেশনেই তানজিমুল মাদারিস গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৮৮ সালের ২৮ মার্চ জমিয়তের সহ-সভাপতি এবং ২০০৩ সালের ১লা জুন নির্বাহী সভাপতি নির্বাচিত হন।
এছাড়া তাঁর আরও অনেক পরিচয় আছে। তিনি সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানের প্রতিষ্ঠাতা। রাবেতা আলমে ইসলামীর কাউন্সিলর। মু’তামারুল আলম ইসলামীর বাংলাদেশ শাখার প্রেসিডেন্ট। জাতীয় সীরাত কমিটি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। নাস্তিক-মুরতাদ প্রতিরোধ আন্দোলন ইসলামী মোর্চার সভাপতি। ইসলামী ঐক্যজোটের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান। জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামের প্রধান। বিচিত্র এই প্রতিভাবান ব্যক্তি এখন পুরোপুুরি শয্যাশায়ী। টানা ১৭ দিন ধরে লাইফ সাপোর্টে আছেন। প্রতিদিন ডায়ালাইসিসের জন্য ১ ব্যাগ করে রক্ত লাগছে। এখন আর শারীরিকভাবে কিছুই করতে পারছেন না। কমবেশি সবাই খোঁজ-খবর রাখছেন। তার জীবনের একান্ত ইচ্ছে ছিলো, বাংলা ভাষায় এদেশের আলিমরা বড় মযবুত ও শক্ত একটা ভাষার ভীত যেন তৈরি করে যায়। তাঁর স্বপ্ন পূরণের গুরুদায়িত্ব তিনি আলিমদের দিয়ে যেতে চান। তিনি আগামী বংশ পরম্পরার স্বপ্নীল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ দেখে যেতে চান।
[ক্বারী মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ]
বিগত কিছুদিন পূর্বেও কারী ওবায়দুল্লাহ নামটা সবার মুখে মুখে শোনা যেতো। জাতীয় অঙ্গন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সকল অঙ্গনেই মুখরিত থাকতো এই নামটি। সর্বত্র ধ্বনিত হতো সেই নাম। তবে কিছুদিন হলো হঠাৎ করেই এই নামটি যেনো কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে। তিনি আছেন না মরে গেছেন তাও জানে না অনেকে। ব্যপার কী? আসলে ব্যপারটা হলো তিনি সারা জীবনভর আমাদের খোঁজ নিলেও আমরা কিন্তু তার খোঁজ-খবর সেভাবে নেইনি। প্রচারবিমুখ এই মানুষটি গোটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন মানুষের কল্যাণে। লোভ, মোহ, বিদ্বেষ ও হিংসা থেকে জীবনকে অনেক দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। কুরআনের আলোকময় এক সুন্দর সমাজ তিনি উপহার দিতে চাইতেন এই জাতিকে।
এই মণীষীর জন্ম ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার কোদালা গ্রামে। প্রাথমিক শিক্ষা পিতা মাওলানা শাহ মেহেরুজ্জামান ইসলামাবাদীর কাছে শেষ করার পর জামিআ কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদরাসায় ভর্তি হয়ে ১৯৬২ সালে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেন। শিক্ষা সমাপনী শেষে লালবাগ মাদরাসায় শিক্ষকতা দিয়ে জীবন শুরু করেন। আর এ বছরেই রেডিও পাকিস্তানে প্রথম মধুর সুরের ঝংকার তোলেন। সূরা ফাতেহার আবেগময় টানে শ্রোতার হৃদয়ের মণিকোঠায় নিজের আসল জায়গাটা দখল করে নেন। অপার্থিব ও ঐশী সুরের মায়াবী টানে মাত করে রাখেন বাংলার শ্রোতাসকলকে। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ বেতারে যা-লিকাল কিতাবু লা-রইবাফিহ-এর প্রথম যে সুর বেজে উঠেছিলো তাও এই মণীষীর কণ্ঠেই। পার্লামেন্টের শুরুর অধিবেশন থেকে নবম পার্লামেন্ট পর্যন্ত জাতীয় সংসদকেও কুরআনের তিলাওয়াতে বিমোহিত করে রেখেছিলেন তিনি। এদেশে তার অবদান এমনই যে তা ভোলার নয়। তার অবদান এদেশের মানুষ কতটুকু মূল্যায়ন করেছেন তার বিবরণ দিয়েছেন এ যুগের একজন বিখ্যাত আলিম দারুল উলূম দেওবন্দের ক্বিরাআত বিভাগের প্রধান ক্বারী মাওলানা আব্দুর রউফ- ‘আল-কুরআন শিক্ষাদান ও তার প্রচার-প্রসারে শায়খের যে অবদান তার যথাযথ মর্যাদা ও মূল্যায়ন এ দেশের মানুষ করতে পারেনি বা করতে শেখেওনি। আমরা বাইরে থেকে শায়খের যে যশ-খ্যাতি শুনেছি তা সত্যি সত্যি ঈর্ষণীয়। শায়খের প্রশংসায় আমরা পঞ্চমুখ থাকতাম। কিন্তু এদেশের তার সে প্রতিভাকে মূল্যায়নই করেনি। মূল্যায়ন করার জন্য তো চিনতে হয়; তারা তো খোদ ব্যক্তি ও প্রতিভাকেই চিনতে পারেননি। আসলে যে মানুষের কৃতজ্ঞতা আদায় করে না সে আল্লাহরও কৃতজ্ঞতা আদায় করে না। এটা হাদিসের কথা। অবশ্য আল্লাহ যাকে কবুল করেন কেউ প্রশংসা করুক আর না করুক তার এতে কিছু আসে যায় না। আল্লাহ তাআলা শায়খের কাজে আরও বেশি সমৃদ্ধি দান করুন।’
শায়েখ ২০০০ সালে প্রথম হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থও হয়ে উঠেন। তারপর ২০০৬ সালে ঢাকার বাইরে এক মাহফিলে যাওয়ার পথে ব্রেন স্ট্রোকের শিকার হন। এ সময় চলাফেরার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। পওে কোলকাতায় চিকিৎসা দেওয়া হলে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেন। ২০০৮ সাল থেকে পরপর তিনবার ব্রেনস্ট্রোকের শিকার হন। ২০১২ তে সর্বশেষ ব্রেনস্ট্রোকের শিকার হয়ে রাজধানীর কামরাঙ্গীন চড় বাসায় অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় আছেন। এখন মোটামুটি চলাফেরা করেন। জুমআর নামাজ পড়তে পারেন। এখনও তিনি তার সেন্টারের কুরআন তিলাওয়াত অনুষ্ঠানে ঘন্টা তিন-পাচেক শান্তচিত্তে বসে থাকেন। খাওয়া-দাওয়া মোটামুটি স্বাভাবিক। কোনও কিছু বলতে বা করতে চাইলে হাতে ইশারা করেন কিংবা বাম হাত দিয়ে লিখে দেন। কারণ ডান হাত দিয়ে কিছু করতে পারেন না। আর বাংলাদেশ তাঁর যে ছাত্রসংখ্যা সে অনুপাতে কোনও খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে না বললেই চলে। তবে তাকে সাহায্য করার নাম করে কিছু মানুষ ব্যবসা করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার পরিবারের পক্ষ থেকে মাওলানা ওয়ালী উল্লাহ জানিয়েছেন, আমরা সচ্ছল সামর্থ্যবান পরিবার। আমাদের কোনো অভাব নেই। কিছু মানুষ যারা এমন অসাধু কাজে জড়িত আমরা তাদের তা থেকে বিরত থাকার আহবান জানাই । এতে আমাদের পিতার শ্রদ্ধা ও সম্মান বিনষ্ট হচ্ছে। পিতা আমদের এমন আদর্শ কখনও শিক্ষা দেননি। আমাদের পিতার সর্বশেষ ইচ্ছে হলো, বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে যেনো কুরআনের আলো পৌঁছে যায়। আগে ঘর-দুয়ার, দোকান-পাট খুললে কুরআনের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি শোনা যেতো। এখন তা আর শোনা যায় না। এমন অবস্থার যেনো পরিবর্তন হয়।
সম্পাদনা / রোকন